দেশের ক্রীড়াঙ্গন থাকুক স্বচ্ছ ও রাহুমুক্ত

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ১২ জুলাই, ২০২১ at ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

প্রায় ১৫-২০ বছর আগে বাংলাদেশের কিশোর ফুটবল দল ডেনমার্ক গিয়েছিল ডানা কাপ ও গোথিয়া কাপ টুর্নামেন্টে খেলার জন্য। সেখানে কয়েকটি ম্যাচে বাংলাদেশ দল জেতায় দেশব্যাপী হইচই পড়ে গিয়েছিল। দেশের প্রধান প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলো এই খবর ফলাও করে প্রকাশ করায় একটি উৎসবের আমেজ বিরাজ করেছিল। অনেকে তখন আগ বাড়িয়ে বলেছিলেন কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশগ্রহণ করতে পারবে। পরে সেই খেলার ভিডিওতে দেখা গেলো, যাদের সাথে খেলে বাংলাদেশ জিতেছিলো ওরা ছিল ১০-১১ বছরের শিশু আর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের বয়স ছিলো ১৫-১৬। আমাদের যুবারা শিশুদের সাথে খেলে দেশের মানুষকে দিবাস্বপ্ন দেখিয়েছিলো। অর্থাৎ আমরা চালাকি করে বয়সের ব্যরিয়ার না মেনে খেলোয়াড় পাঠিয়েছিলাম। শুধু যে ঐ টুর্নামেন্টে এই ধরনের টিম পাঠিয়েছি তা নয়। অন্যান্য খেলাধুলায়ও আমরা একই কাজ করেছি। সেইজন্য বিদেশে অনেক টুর্নামেন্টে পাঠানো খেলোয়াড় না খেলে ফেরত আসতে হয়েছে।
আশির দশকে যখন আমরা স্কুলে পড়তাম তখন সারা দেশে স্কুল ফুটবলের জমজমাট আসর বসতো। খেলা নিয়ে সেই কি উত্তেজনা। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে আমরা ফুটবলসহ অন্যান্য খেলায় মেতে উঠতাম। তখন প্রত্যেক ক্লাসের সাথে প্রত্যেক ক্লাসের ম্যাচ হতো। সে প্রেক্ষিতে খেলোয়াড় বাছাই করা হতো স্কুল টুর্নামেন্টের জন্য। এর পাশাপাশি সারাদেশে আন্তঃকলেজ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টও খুব জমজমাট হতো। সারা দেশে খেলাধুলার একটা জোয়ার বয়ে যেতো। তখন স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের বিনোদনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলো খেলাধুলা। প্রায় সব ছেলে নিয়মিত খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ও বিকালে খেলতে যেতো। এই যে খেলাধুলার একটা চর্চা ছিলো বর্তমানে তা কালের বিবর্তনে ও প্রযুক্তির ঠেলায় উধাও হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা এখন খেলাধুলা ছেড়ে মোবাইল, ফেসবুক ও বিভিন্ন ইলেকট্রনিক গেইমে সময় কাটায়। এই সুযোগে খেলার মাঠগুলো পরিত্যক্ত পড়ে থাকায় বেদখল হয়ে গেছে। কোন কোন এলাকায় খেলার মাঠে বিভিন্ন মেলা, বাজার ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে অভিভাবকরাও চান তাদের সন্তান যেন ঘর থেকে কম বের হয়। কারণ হিসাবে তারা নিরাপত্তার কথা বলেন। ফলে বাচ্চারা ঘরে বসে ফার্মের মুরগির মত ঝিমায় ও ফেসবুকসহ বিভিন্ন পর্ণো সাইটে এডিক্টেট হয়ে পড়ছে ও কোন কোন বাচ্চা বিভিন্ন ড্রাগে এডিক্টেট হয়ে পড়ছে। এসব বাচ্চার আর একটা বদ অভ্যাস হলো, তারা প্রায় সারারাত জেগে থেকে ইন্টারনেটে সময় কাটায় ফলে তারা দুপুরের আগে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। এর ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সহজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
কয়েকদিন আগে ঢাকার ঘরোয়া লিগে আবাহনী ও মোহামেডান এর মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচে মোহামেডানের সাকিব আল হাসানের একটি এলবিডব্লুর আবেদনে আম্পায়ার সাড়া না দেওয়ায় সাকিব পদাঘাত করে স্টাম্প ভাঙে ও স্টাম্প উপড়ে ফেলেন। সেই জন্য সাকিবকে শাস্তি হিসাবে কয়েক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে বিশ্বের এক নাম্বার অলরাউন্ডার কেন এই কাজ করতে গেলেন? যতটুকু বোঝা যায় সাকিব বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় খেলার অভিজ্ঞতা থেকে মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে,ঐ বলে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যান (মুশফিকুর রহিম) আউট হয়েছেন। কিন্তু আম্পায়ার সেই আউটটি দেন নাই। বিশ্বের এক নাম্বার অলরাউন্ডার হিসাবে সাকিবের আরো বেশি ধৈর্য ধরার দরকার ছিলো। তিনি তা করতে পারেননি। এটা দেশের খেলাধুলা বিশেষ ভাবে ক্রিকেটের জন্য অশনিসংকেত। তবে তার থেকেও বড় অশনিসংকেত হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটে পাতানো খেলা ও আম্পায়ারকে প্রভাবান্বিত করে ম্যাচের ফলাফল অনুকূলে নেয়ার। খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেট খেলায় সারা বিশ্বে জুয়ার একটা বিষয় আছে।এটি সাধারণত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশে প্রায় সব খেলায় প্রভাবান্বিত করে ফলাফল অনুকূলে নেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে লাভটি কার? হয়ত মুষ্টিমেয় কিছু ক্লাব কর্মকর্তার কিন্তু এতে করে দেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিরাট লোকসান হয়। সেজন্য ২০১৯ সালে অক্টোবরে দেশের ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করেছিলো ক্রিকেটের এই অনিয়মের বিরুদ্ধে। তখন তারা ১১ দফা দাবি পেশ করে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলো। সেখানে বলা হয়ে ছিলো “লিগের কোন ম্যাচে কোন দল জিতবে,তা খেলার আগে থেকে সবাই জানে”। কী ভয়াবহ অভিযোগ! যার কোন প্রতিকার হয় নি বলেই আজ সাকিবের এই আচরণ- অনেকে তা মনে করেন। অথচ সেই আন্দোলনের অবসান ঘটেছিলো বিসিবি সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে। সাকিবের শাস্তি হয়েছে বা সাকিব সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু যারা টেবিলে বসে খেলার ফলাফল নির্ধারণ করেন তারা কি অপরাধী নয়? সেটি তো ইয়ং জেনেরেশনের খেলাধুলার বিমুখ হওয়ার একটি বড় কারণ।
এরকমও শোনা যায় কিছু কর্মকর্তা- আম্পায়ার এরপর আর কোন ম্যাচের আম্পায়ারিং করার সুযোগ পাবেন কিনা তা নির্ধারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করে ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করেন। এই প্রসঙ্গে দুই বছর আগের ফতুল্লা স্টেডিয়ামের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। তখন ভুল আউটের প্রতিবাদে ব্যাটসম্যান উইকেটে বসে পড়েন। আম্পায়ার খেলোয়াড়কে অনুনয় বিনয় করে বলেছিলো “আমার কিছু করার নাই। আজ তোমাদের হারতে হবে। নাহলে আমি আর ম্যাচ পাব না”। এই বিষয়গুলো কোন গোপন বিষয় নয়। এটি সবার চোখের সামনেই ঘটছে। এরপরও আমরা এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছি না।
এ প্রসঙ্গে ২০১৬ সালে প্রকাশিত টিআইবির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়ায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনায় সুশাসনের ঘাটতি আছে। ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনা কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি প্রতিরোধে যথাযথ আইনের অভাবসহ নয় ধরনের ঘাটতি চিহ্নিত করেছিলো সংস্থাটি। যদি তাই হতো তবে ২০১৬ সালের টিআইবির প্রতিবেদনের পর এর প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হতো। সেটি নেয়া হয়নি বলেই ২০২১ সালেও টেবিলে খেলার ফলাফল নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলে। যা খুবই দুঃখজনক। এতে করে হয়ত কোন কোন ক্লাব বা ব্যক্তিবিশেষের লাভ হলেও বড় ধরনের ক্ষতি হয় দেশের ও যুবসমাজের। তাই অতি দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে খেলাধুলাকে রাহুমুক্ত করা প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধরথযাত্রা : মহামিলনের উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়