বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অর্থনৈতিক অঙ্গনে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বিগত দিনে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমপ্রতি কিছুটা নিচে নেমে এলে রিজার্ভ–সংক্রান্ত আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাওয়ার খবরে রীতিমত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, রিজার্ভ হ্রাসের এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ একটি দেশের এক্সটার্নাল অ্যাসেট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে না থাকলে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দেশটিকে বিপাকে পড়তে হয়। তাই প্রতিটি দেশই চেষ্টা করে কীভাবে সন্তোষজনক রিজার্ভ সংরক্ষণ করা যায়।
এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস পূর্বাভাস দিয়েছে যে, আগামী কয়েক মাস বাংলাদেশের রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকবে। এই পূর্বাভাস বলা যায়, আনন্দ ও স্থিতিশীলতার। বিশেষত আমদানি নিয়ন্ত্রণের পর চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার কারণে রিজার্ভ স্থিতিশীল হবে বলে মনে করে ওই প্রতিষ্ঠান। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বারবার ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি গত দুই বছর ধরে ডলারের মজুত ক্রমাগত কমলেও মুডিস এই পূর্বাভাস দিয়েছে। মুডিস বলেছে, গত জানুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার পর ব্যবসা–বাণিজ্যের অনিশ্চয়তা ধীরে ধীরে কমছে। সেই সঙ্গে আমদানিতে এখনো বিধিনিষেধ থাকায় চলতি হিসাবের স্থিতি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেওয়া চলমান রাখায় রিজার্ভে ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে। মুডিস বাংলাদেশের ঋণমান নিয়ে পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনার পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি স্থিতিশীল রাখাসহ ঋণমান ‘বি ওয়ান’ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি চলমান রাখতে এই ইতিবাচক ধারা জরুরি বলে মনে করে মুডিস। তবে স্থিতিশীলতা আছে বলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণসহায়তা পাচ্ছে। ২০২২ সালের জুনের আগে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর পর থেকে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কমতে থাকে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে যায়। ফলে রিজার্ভ কমে যায়। এ সময় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। মুডিসের আশা, মহামারির আগের সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতি দুর্বল হলেও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণসহায়তা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম বাংলাদেশের একটি পোশাকশিল্প রয়েছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার পেছনে এ খাতের অবদান আছে। মুডিস আরও বলছে, জোরালো প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। রাজস্বের তুলনায় বাড়তি ঋণ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় বাংলাদেশের আর্থিক স্বস্তি কমেছে।
এদিকে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এই মর্মে যে রিজার্ভ বাড়ছে। কেননা, সরকার ইতিমধ্যে বিলাসী পণ্য আমদানির রাশ টেনে ধরাসহ বহুবিধ প্রতিকারমূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। ইতিবাচক ফলও আসতে শুরু করেছে।
মুডিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক পোশাকশিল্প দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জিডিপি ও রপ্তানি আয়ে বড় ভূমিকা পালন করবে। তবে পোশাকের বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া ও আর্থিক হিসাবের ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। এ কারণে ঋণমানের ওপর চাপ বেড়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা, সক্ষমতার তুলনায় বেশি সুদ ব্যয় ও ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণের কারণে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা কমে যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় তারা বলেছে, এ পরিস্থিতি দুই থেকে তিন বছর আগের তুলনায় নাজুক থাকবে। তবে মুডিস বলেছে, মূল্যস্ফীতির চাপ থাকায় দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিও তুলনামূলকভাবে কমবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বছর–বছর রিজার্ভ বাড়ানোর চেয়ে অর্থনৈতিক খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখা, পাচার ও অপচয় রোধ, দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা বিরাজমান রাখা খুবই জরুরি। দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জমে থাকাও অর্থনীতির জন্য ভালো নয় বলে মনে করা হয়। কারণ, অতিরিক্ত রিজার্ভ অকারণ ফেলে রাখা অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়া এবং ব্যবসা–বাণিজ্যের গতি আশানুরূপ না হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে। বর্তমান সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সদ্ব্যবহার করে আসছে বিচক্ষণতার সঙ্গে। তাই রিজার্ভ নিয়ে অহেতুক উদ্বেগ তৈরি না করে এবং শঙ্কিত না হয়ে সবাইকে আত্মবিশ্বাসে সামিল হতে হবে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায়।