বঙ্গোপসাগরে প্রচুর জেলিফিশের দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু এদেশে প্রাণিটি খাওয়া হয় না বলে এর কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেলিফিশ খাদ্য হিসাবে এবং ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরাও দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে এই প্রাণিটিকে কাজে লাগাতে পারি। আর সেই গুরুত্ব তুলে ধরতেই আজ দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব জেলিফিশ দিবস পালন করছে কক্সবাজারের পেঁচারদ্বীপস্থ সমুদ্র গবেষণার জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট (বিওআরআই)।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদা রশিদ জানান, আজ শুক্রবার সকালে প্রতিষ্ঠানটির সেমিনার হলে আলোচনার সভার মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হবে। বর্তমানে এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির একটি গবেষণা প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরা হবে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির জেলিফিশ রয়েছে। এরমধ্যে ১২ প্রজাতির জেলিফিশ খাওয়ার উপযোগী। আর আমাদের বঙ্গোপসাগরেও অন্তত ৩ প্রজাতির খাওয়ার উপযোগী জেলিফিশ পাওয়া যায়। জেলিফিশ নিয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের পাশাপাশি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরাও গবেষণা করবেন বলে জানান কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান।
তিনি জানান, জাপানিরা জেলিফিশকে ক্যান্ডিতে রূপান্তরিত করেছে। এক ধরনের মিষ্টি ও নোনতা ক্যারামেল, চিনি, স্টার্চ সিরাপ এবং জেলিফিশ পাউডার দিয়ে তৈরি করা হয় সেই ক্যান্ডি, যা বেশ ব্যয়বহুল এবং সুস্বাদুও বটে। এছাড়াও সালাদে, নুডলসে এবং সয়া সস দিয়ে প্রায়শই এদের খাওয়া হয়। থাইল্যান্ড জেলিফিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এ ছাড়াও কোলাজেনের উৎস হিসেবে বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, ওষুধ শিল্পে এবং বিশ্বজুড়ে পাবলিক একুরিয়ামে জেলিফিশ প্রদর্শিত হয়। বর্তমানে জেলিফিশ নিয়ে একটি প্রাথমিক গবেষণা চলছে। আগামী অর্থবছরে এবিষয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
সমুদ্র বিজ্ঞানীরা জানান, প্রায়শ সমুদ্র বিজ্ঞানীরা জেলিফিশ এবং অন্যান্য জীবের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা দেখার মাধ্যমে সমুদ্রের স্বাস্থ্য নিরীক্ষা করেন। এছাড়া কার্বন ক্যাপচারে এবং গভীর সমুদ্রে মাছের বিকাশের জন্য মাইক্রোহ্যাবিটেট তৈরিতেও জেলিফিশের অবদান রয়েছে। এদের যথেষ্ট অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে। জলবায়ূ পরিবর্তনের সাথে সাথে এদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা হুমকিস্বরূপ। তবে জেলিফিশের কিছু কিছু প্রজাতি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বেশ কিছু অঞ্চলে মানুষের খাদ্যের অংশ হয়ে ওঠেছে। চীন, জাপান এবং কোরিয়ার মতো বেশ কিছু জায়গায় এটি খুব মজার খাবার হিসেবে বিবেচিত।
বিজ্ঞানীরা জানান, মানুষের চেয়েও আদিম এই প্রাণিটির পৃথিবীতে আগমন প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে। আর এই প্রাচীন প্রাণিটির প্রতি ভালবাসা জানাতে ২০১৪ সাল হতে বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। তবে নামে ফিশ বা মাছ হলেও জেলিফিশ আসলে মাছ নয়। এদের বাহ্যিক গঠনের সাথে মাছের গঠনের কোনো ধরনের মিল নেই। এরা মূলত নিডারিয়া পর্বের অমেরুদণ্ডী প্রাণি এবং এরা এতই বৈচিত্রময় যে, অনেক বিজ্ঞানী তাদের কেবল ‘জেলাটিনাস জুপ্ল্যাঙ্কটন’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। জেলিফিশের মাছের মতো আঁশ, ফুলকা বা পাখনা থাকে না। এর পরিবর্তে তারা তাদের গোলাকৃতি ‘বেল’ খোলা এবং বন্ধ করার মাধ্যমে সাঁতার কাটে। তাদের শরীর ৯৮ ভাগ পানি দিয়ে গঠিত। যখন তারা উপকূলে ভেসে চলে আসে, তারা মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। কারণ তাদের দেহ দ্রুত বাতাসে বাষ্প হয়ে যায়। তাদের কোনো মস্তিষ্ক নেই, কেবল একটি প্রাথমিক স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে।
জেলিফিশ সমুদ্রের নীচের খাদ্য শৃক্সখলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যদিও এরা অপেক্ষাকৃত ছোট ও সহজ প্রাণী। এরা সমুদ্রের সূক্ষ্ন বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এরা এক ধরনের প্লাংকটন বলে গভীর সমুদ্রের কচ্ছপ, সানফিশ, স্পেডফিশ, টুনা, হাঙর, কাঁকড়া এবং বিভিন্ন ক্রাস্টাশিয়ানের প্রিয় খাদ্য। অন্যদিকে সামুদ্রিক শৈবাল, জুয়োপ্লাংকটন এবং ছোট ছোট চিংড়ি জেলিফিশের প্রিয় খাদ্য। আর এভাবে এসব সামুদ্রিক প্রাণীর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জেলিফিশ একটি স্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।