সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা ও রংপুরে সংঘর্ষে ৩ জনের প্রাণ গেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকারসমর্থক সংগঠনের কর্মীদের সংঘর্ষের এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কয়েকশ মানুষ। এর মধ্যে ঢাকায় দুজন এবং রংপুরে একজন মারা গেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও রাজশাহীতে বিজিবি নামানো হয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল বিকালে দেশের সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল আন্দোলনকারীরা। তবে সকাল ১১টা থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর আসতে থাকে। ঢাকার বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে নগরের বড় অংশজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে ভোগান্তিতে পড়েন চলতি পথের যাত্রীরা। শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। খবর বিডিনিউজের।
ঢাকা : আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে রাজধানীর মিরপুর রোডে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের সামনে দুজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে পুলিশ। গতকাল বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল দুপুর ১২টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের অদূরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। এতে মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। বিকাল ৪টার দিকে সংঘর্ষ ঢাকা কলেজ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তায় হেলমেট পরা এক ব্যক্তিকে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশেই লাঠি হাতে ছিলেন আরেক ব্যক্তি। আহত ওই ব্যক্তিই পরে হাসপাতালে মারা যান।
নিহত অন্যজনের বয়সও আনুমানিক ২৫ বছর। তার নাম–পরিচয়ও পুলিশ জানতে পারেনি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথায় গুরুতর জখমের চিহ্ন রয়েছে বলে পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান।
অ্যাম্বুলেন্স চালক আলী মিয়া জানান, সন্ধ্যার দিকে এই যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় সিটি কলেজের সামনে পড়ে ছিল। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে পাশের পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়। এছাড়া ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আহত ৬০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
রংপুর : কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে এক যুবকের প্রাণ গেছে। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্কের মোড় এলাকায় সংঘর্ষের এ ঘটনায় পুলিশসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
নিহত আবু সাঈদ (২৫) বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি পীরগঞ্জ উপজেলার বাবুনপুর গ্রামে। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনকারীদের একজন সমন্বয় ছিলেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. ইউনুস আলী বলেন, বিকাল ৪টার কিছু পর গুলিবিদ্ধ ওই শিক্ষার্থীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। তার আগেই মৃত্যু হয়েছিল। আমাদের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার জানিয়েছেন, তার বুলেট ইনজুরি ছিল। আমাদের এখান থেকে মরদেহ দিতে চায়নি। কিছু প্রসিডিউর আছে। কিন্তু সেখানে অনেক শিক্ষার্থী ছিল, তারা মরদেহ নিয়ে যায়। শুনেছি পুলিশ নাকি মরদেহ ফেরত আনার চেষ্টা করছে।
সংঘাত–মৃত্যুর পর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা
এদিকে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর অনির্দিষ্টকালের জন্য রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া আজ বুধবার দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত রাতে জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বেরোবির ভিসির বাসভবনে আগুন : কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা। তারা বেরোবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদের বাসভবনে আগুন দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কাণ্ড ঘটানোর আগে উপাচার্যের বাসভবনে পাহারারত পুলিশের গাড়িতেও আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আন্দোলনরতদের বিরুদ্ধে। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটান বলে জানা গেছে। আগুনের কারণে বেরোবি ভিসি অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ তার বাসভবনে আটকা পড়েছেন।
ঢাকার পথে পথে বিক্ষোভ, যাত্রী না পৌঁছায় ফ্লাইট ছাড়তে দেরি : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কোটা আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে আকাশপথের ভ্রমণেও। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধের কারণে অনেক যাত্রী নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পারেননি। যাত্রীরা সময়মত না পৌঁছায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের কয়েকটি ফ্লাইট ছেড়েছে দেরিতে।
রাবির হলে ছাত্রলীগের কক্ষে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর থমথমে ক্যাম্পাস : সারা দেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার ও কোটা প্রথার সংস্কারের দাবিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কক্ষ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান হল, মাদার বখস্ হল, জিয়া হল, মতিহার হল ও শাহ মখদুম হলের অন্তত ২০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে কক্ষগুলোতে থাকা জিনিসপত্র বাইরে বের করে এনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলেন, বিকাল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে মাঝে মধ্যে রুমাল কিংবা মাস্ক পরে ভাঙচুরসহ, অগ্নিকাণ্ড করতে দেখা যায়।
রাবি ছাত্রলীগকে অবাঞ্চিত ঘোষণার দাবি : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে অবাঞ্চিত ঘোষণা, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করেছেন কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকাল থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেইট সংলগ্ন রাজশাহী–ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে এসব দাবি জানান তারা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের মূল দাবি কোটা সংস্কার থেকে তারা সরে আসেননি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের পাশাপাশি কেবল নতুন কিছু দাবি যুক্ত হয়েছে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে আছে, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করতে হবে, কোনো হলেই ছাত্রলীগ অবস্থান করতে পারবে না। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
বগুড়ার সাতমাথা রণক্ষেত্র : বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জিরো পয়েন্ট সাতমাথা এলাকা। এ সময় আন্দোলনকারীরা শহরের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালায় এবং পাশে থাকা পুলিশ বঙের সামনে আগুন দেয়। গতকাল সন্ধ্যায় সাতমাথা জিরো পয়েন্ট ও নবাববাড়ী সড়ক আন্দোলনকারীদের দখলে ছিল। অপরদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
ট্রেন আটকে বাকৃবির শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ : শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের–বাকৃবি শিক্ষার্থীরা পঞ্চম দিনের মতো ঢাকা–ময়মনসিংহ রেল যোগাযোগ বন্ধ করে আন্দোলন করে। গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার ট্রেন আটকে দেন তারা। দুপুর ৩টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে মুক্তমঞ্চে এসে সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। এরপর মুক্তমঞ্চ থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিল কামাল–রনজিৎ (কেআর) মার্কেট হয়ে আব্দুল জব্বার মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে রেলপথ অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
রেলপথ অবরোধ, দূরযাত্রার ট্রেনযাত্রীদের দুর্ভোগ : কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন অবরোধ করায় রাজধানীর সঙ্গে সব রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল দুপুরের পর থেকে। এতে দুর্ভোগে পড়েন দূরযাত্রার যাত্রীরা। গতকাল ঢাকার বাইরে গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, ময়মনসিংহ ও রংপুরে রেলপথ অবরোধ করার খবর এসেছে। এদিন দুপুরের পর ঢাকা থেকে যেমন কোনো ট্রেন বের হতে পারেনি, তেমনি ঢাকায়ও প্রবেশ করতে পারেনি। অবরুদ্ধ থাকার সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর রাত ৮টায় মহাখালী থেকে কমলাপুর ও বিমানবন্দরের উদ্দেশে দুটি ট্রেন ছেড়ে যেতে দেখা যায়।
ঢাকায় দুটি বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণ : বাংলানিউজ জানায়, রাজধানীতে শিকড় ও ট্রান্স সিলভা পরিবহনের দুটি বাসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রাত সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ ঘটনা ঘটে। একই সময়ে সচিবালয় সংলগ্ন মেট্রো রেলস্টেশনের নিচে সাতটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।