দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২৮ আগস্ট, ২০২২ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও টেলিপ্যাথি!

ফুপ্পির মন্তব্যের জবাবে দুপুত্রই বেশ জোর দিয়ে জানাল যে তারাও তেমন ঠাণ্ডা বোধ করছে না। এতোক্ষণে খেয়াল হল যে একই অবস্থা নিজেরও, মানে শীত লাগছে না তেমন। মানে কী এর? রাতেতো তাপমাত্রা আরো কমে যাবার কথা। তা না হয়ে এ সময় কি তা বেড়েছে নাকি? নাকি বাতাস না থাকায় কম লাগছে শীত। কিম্বা হতে পারে সারাদিনের হিমে নাকাল হলেও সে অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা শরীর ইতিমধ্যে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এখানাকার হিমের সাথে। এ কি তাহলে জীববিজ্ঞানের অভিযোজনের খেলা নাকি? তা যে কারণেই ঠাণ্ডা কম লাগুক না কেন, এ অতি সুসংবাদই আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানুষদের জন্য। থাকতে হবে আর দু’দিন কমপক্ষে এই হিমসাম্রাজ্যে!
ইতিমধ্যে রিজেন্ট বেইজিঙয়ের সামনেকার সেই বাগান পেরিয়ে মূল রাস্তার পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়েছি প্রায় শ দেড়শ মিটার। কিন্তু এখনো না পেয়েছি দেখা কোনো জেব্রা ক্রসিংয়ের, না দেখতে পেয়েছি রাস্তার ওপাশটা পরিষ্কারভাবে, কারণ আগেই বলেছি রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডে তো গায়ে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা ছাড়িয়ে যাওয়া নানান গাছ, যার মধ্যে মিট মিট করে জ্বলছে লাল নীল সবুজ হলুদ ছোট ছোট বাতি। আচ্ছা এরকম আলোকমালায় সবসময়ই এ এলাকার গাছগুলো সাজানো থাকে নাকি? নাকি এইসময়ে চায়নার এই বান্দর বছরের বিশেষ কোনো পালাপার্বণ উপস্থিত হয়েছে, যার জন্যই সাজানো হয়েছে গোটা এলাকাটা এরকম আলোকমালায়?
আচ্ছা দীপ্র, কোথায় দেখেছিলে তোমার সেই নুডুলস রেস্টুরেন্ট? ঐ পাশের ঠিক কোন জায়গাটাতে ওটা? জিজ্ঞেস করলাম দুই পুত্রকে দুপাশে নিয়ে ওদের কাঁধে হাত রেখে এগুত এগুতে ‘ঐ রেস্টুরেন্ট দেখার পর, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়িটা ইউটার্ন নিয়ে এদিক দিয়ে গিয়েই আমাদের হোটেলে ঢুকেছিল মনে হচ্ছে। তখন তাই মনে হয়েছিল ওটা আমাদের হোটেলের কাছেই রাস্তার ওপাশে হবে’ -পুত্রের কাছ থেকে এ জবাব আসতেই ধোঁয়াশা ঢাকা আবছা আলোতে রাস্তার এদিকটা দিয়ে থেকে থেকে হুসহাস করে নানান আকারের যে গাড়িগুলো যাচ্ছে, সেগুলোর ফাঁক গলে আরো একটু সামনেই রাস্তার মাঝখানে থাকা আইল্যান্ডটার বেশ কিছুটা ফাঁকা দেখতে পেলাম। মানে কোনো গাছ নেই ওইখানটাতে। যার মানে হলো ওখানে হয়তো একটা জেব্রা ক্রসিং আছে। এখানকার মানুষেরা হয়তো আমাদের মতো যত্রতত্র রাস্তা পার হবার নিয়তে থাকে না। ফলে আইল্যান্ডের গাছপালার ফাঁক দিয়ে ওপাশে যাওয়ার কসরত আয়ত্ত করতে পারেনি ওরা নিশ্চিত। অবশ্য ঐ রকম করলে পুলিশ যে তাদের ধরে ঠেঙাবেই তাও সুনিশ্চিত। যার কারণে যে জায়গায় জেব্রাক্রসিং আছে সেখানটায় আইল্যান্ড থাকলেও ওটা ওখানে নিচু হয়ে গেছে, আর গাছও নেই সেখানে। সাধে কি আর বলে ‘মাইরের উপর ঔষধ নাই’। ঐ কথাটি আমাদের দেশে প্রচলিত থাকলেও, আর সমাজে নানান ধরনের সব মারপিট বজায় থাকলেও, আমাদের দেশের ঐ রকম আইন মানানো মারপিঠ নেই।
সামনে এগুতে এগুতে এসময় একটু দূরের গাঢ় ধোঁয়াশা ভেদ করা আবছা আলোয় ঠিকই চোখে পড়লো বাঁয়ের চওড়া কালো রাস্তার উপরের হলুদ ডোরা কাঁটা দাগ গুলো। ওটা দেখার সাথে সাথেই নিজের অজান্তেই বেড়ে গেল পায়ের গতি, তাতে পাশাপাশি হাঁটা পুত্ররা কিছুটা হকচকিয়ে যেতেই, বললাম বাবা পাওয়া গেছে জেব্রা ক্রসিং। চালাও জোরে পা।
এতে সাথে সাথেই সবার গতি বেড়ে যেতেই চলে এলাম দ্রুতই জেব্রা ক্রসিঙের লেজের দিকে, যদিও অতো তড়িঘড়ি করার কিছু ছিল না, কারণ এটা তো জ্যান্ত কোনো জেব্রা না যে উঠে দৌড়ে পালিয়ে যাবে কোথাও। এখানে পৌঁছে জেব্রাক্রসিঙের লেজে দাঁড়িয়ে, ডানে চোখ ফেললাম ট্রাফিক লাইটের মতিগতি বোজার জন্য।
‘ঐ তো বাবা, ঐখানেই তো আমাদের গাড়িটা ইউটার্ন নিয়েছিল আজ বিকেলে যখন হোটেলে ফিরছিলাম আমরা ‘ট্রাফিক লাইটগুলোর দিকেই আঙুল তাক করে হৈ চৈ করে উঠল দীপ্র।
দেখছি ঝুলছে ট্রাফিক লাইটগুলো রাস্তার উপরে রাস্তার এ মাথা ও মাথা জুড়ে লাগানো তারের উপরে। আছে ওগুলো রাস্তার দু ধারেই। জেব্রা ক্রসিং থেকে ঐ লাইট গুলোর দূরত্ব হবে সাত আট কিম্বা দশ মিটার। আর ওখানেই আছে রাস্তার ঐ পাশ থেকে এ পাশে আসার ইউটার্ন নেবার জায়গা। বোঝাই যাচ্ছে নুডুলস রেস্টুরেন্টের অবস্থানের ব্যাপারে পুত্রের আন্দাজ ঠিকই আছে। অপেক্ষা করছি ঠাঁই দাঁড়িয়ে জেব্রা ক্রসিঙের লেজে আপাতত ট্রাফিক লাইটের মর্জিতে। রাতের এ সময়টায় কতক্ষণ পর পর যে ট্রাফিক লাইট তার রং বদলায়, তা তো জানি না। তবে মানুষ যেহেতু রাস্তায় কম, সে তুলনায় চলতি গাড়ির সংখ্যা ঢের বেশি এ সময়ে, সে হিসাবে পদব্রজে হাঁটা পথিকদের এই হিমরাতে রাস্তা পারাপার করানোর ব্যাপারে ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের মাথা ব্যথা নেই তেমন সম্ভবত, যার কারণে সেই তখন থেকেই দেখছি ঝুলছে রাস্তার উপরে সবুজ বাতি। আচ্ছা আজকের বহুল প্রচারিত তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরী বেইজিং এর ট্রাফিক ব্যবস্থা কি এখনো মনুষ্যনির্ভর আছে, নাকি হয়ে গেছে ওটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর? ডিজিটাল টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ সব বিষয়ে আমেরিকা ইউরোপের তুলনায় চায়না অনেক পরে মনোযোগী হয়ে উঠলেও এখন যে সে পাল্লা দিচ্ছে তাদের সাথে সমানে সমান হয়ে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে গত অন্তত দু’দশক ধরে তাদের অর্থনীতির শনৈঃ শনৈঃ উর্ধ যাত্রার গতিতে। এক সময় যে কোনো মানব সমাজের অর্থনীতির সমৃদ্ধি, দৈহিক শক্তি ও অস্ত্র নির্ভর হলেও হালে তো হয়ে গেছে তা মেধানির্ভর। তবে শত শত বছর ধরে রাজ করা শক্তি আর অস্ত্র, এখনো তার অবস্থান একদম ছেড়ে দেয়নি মেধার কাছে। বরং বলা যায় এখন অর্থনীতির উন্নতির রাস্তায় পথ চলতে মেধা ও শক্তি চলে হাত ধরাধরি করেই।
মেধা বলি আর শক্তি বলি, দুটোতেই তো চায়না প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই জগতখ্যাত। হালে মনে হচ্ছে সেই মেধার জোরকে শানাচ্ছে চায়না তুমুল মনোযোগে। এই যেমন মহাকাশ বিষয়ক গবেষণায় আমেরিকা রাশিয়ার অনেক পরে চায়না মনোযোগী হলেও, এখন সেখানেও সে তার আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টায় আছে, শক্তির বিচারে নব্বই দশকের পর থেকে একমেরুসম্পন্ন হয়ে উঠা এই গ্রহের একমাত্র মোড়ল আমেকিার চোখে চোখ রেখে। সাথে বাড়িয়েছে তার সামরিক সক্ষমতাও। সে যুক্তিতে এখানকার ট্রাফিক ব্যবস্থার দায়িত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে ন্যস্ত হয়েই যেতে পারে এতদিনে। সেটা হলে এ মুহূর্তে আমরা যে এই জেব্রা ক্রসিঙের লেজে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছি, তাও তো সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গোচরে আসার কথা এতক্ষণে। কারণ কোথাও না কোথাও তো রাস্তার আশেপাশের নানান ডাটা আর এলগরিদম সংগ্রহের জন্য নিশ্চয় বসানো আছে ক্যামেরা। যার ভিত্তিতেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেয় তার সিদ্ধান্ত।
অবাক ব্যাপার ঠিক এসময়েই এই বাঙাল মনের সাথে মনে হল বেইজিঙের ট্রাফিক সিস্টেমের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটা টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ হয়ে গেল; আর তাতেই পেলাম রাস্তা পার হবার সুযোগ! দ্রুত সবাইকে নিয়ে রাস্তা পার হতে হতে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ধন্যবাদ দিতে দিতে মনে পড়ল, নাহ আর যাই হোক মানব মন সিদ্ধান্ত নেবার সময় মাঝে মধ্যে হলেও যে সহানুভূতিশীলতার বা এম্প্যাথির চর্চা করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তা করার কথা না। সে তো সম্ভবত সব সিদ্ধান্তই নেয় শুধু ডাটা, তথ্য এলগরিদমের উপর ভিত্তি করেই। তার কাছে এম্প্যাথি বিষয়টার কোনো মূল্য আছে বলে তো মনে হয় না। এই এম্প্যাথিই তো মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত মানব মনের সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরাট ব্যবধান তৈরি করে রেখেছে।
‘বাবা, বাবা আমরা কি এখন প্রথমে সেই রেস্টুরেন্টটাই খুঁজবো, নাকি আশেপাশে একটু ঘুরে দেখবো আছে কি না এদিকে অ্যাপল স্টোর?’ সহি সালামতে সকলে রাস্তা পার হবার পর প্রথম জিজ্ঞাসা দীপ্রর।
ইউটার্ন নেয়া গাড়ির মতোই রাস্তার পেরিয়ে সামনের দিকে মানে উল্টো দিকে হাঁটতে হাঁটতে, একটু চিন্তা করে পুত্রের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, বাবা বলা তো যায় না এই শীতের রাতে যখন মানুষের খুবই কম আনাগোনা দেখছি রাস্তাঘাটে, তাতে কতক্ষণ খোলা থাকবে ঐ রেস্টুরেন্ট। চল আগে ওখানেই যাই। তোমাদের খাওয়া দাওয়া শেষেই না হয় দেব গোটা এলাকাটায় একটা চক্কর। ‘ওয়াও! হোয়াট এ বিউটিফুল বিল্ডিং ইট ইজ।‘ তুমুল উত্তেজনায় থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বরাবরের মতো উত্তেজিত অভ্র এই ইংলিশ বাত ঝাড়তেই, দেখি ডান পাশে দাঁড়িয়ে আছে গহনার মতো সারা গা ভর্তি নানান রঙের লাইটসমৃদ্ধ ঝলমলে সেই ষাট গম্বুজ বিল্ডিংটি, দেখেছিলাম যা, আগের রাতে রিজেন্ট হোটেলের রুমের জানালা দিয়ে।
‘বাবা, এটাও কি হোটেল?’
অভ্রর এবারকার এই প্রশ্নের জবাবে বললাম, তা তো জানি না। বিল্ডিংটার এ পাশটায় কোথাও তো কিছু লেখাও দেখছি না। ওটা কি বুঝতে হলে ডানের ঐ রাস্তাটি দিয়ে গিয়ে ওটার সামনে যেতে হবে। আপাতত থাক তা, ওটা পরেই দেখবো। চল এখন এগুনো যাক সামনে।
পর পর জারী হওয়া এরকম দুই নিষেধাজ্ঞায় কিছুটা দমে গেল মনে হল পুত্ররা। চুপচাপ হাঁটতে থাকল ওরা দ্রুত পায়ে হাঁটা আমার সাথে তাল মিলিয়ে। যদিও মাঝে মধ্যে আমি নিজের গতি কমাচ্ছি, যাতে পেছন পেছন হেঁটে আসা হেলেন খুব বেশি পেইছিয়ে না পরে। অবচেতন সচেতনাতেই ঘটছে ব্যাপারটা। ঢাকার বেশির ভাগ রাস্তাতেই রাতের বেলায় এরকম জনবিরল অবস্থায়, কোনো নারীর পক্ষে তো একাকি হাঁটা চরম অনিরাপদ। শুধু জনবিরল কেন জনবহুল রাস্তাতেই কি নিরাপদ নাকি কোনো নারী রাতের ঢাকায়। চেতন অবচেতন আমার তো সেই নিরাপত্তা বিষয়ক সাবধানতা দিয়েই মোড়া।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোলাগা আর ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রগতিশীল ও মুক্তমনের কবি শামসুন নাহার