ডিজিটাল ভুতুড়েপনা
ঘটনাটি যদিও তুমুল আশ্বস্ত হওয়ার মতোই তবে তা একই সঙ্গে চরম অবাক হওয়ারই মতোও। ভেবেছিলাম চোখে ধাঁ ধাঁ বা ভুল দেখেছিলাম নাকি, একটু আগে ছবি তোলার সময়? ফলে ছবি তুলে, জিন্সের প্যান্টের পকেটে চালান করে দেয়া ছোঁয়াফোনটি ফের বের করে ওইটির পর্দায় চোখ রাখতেই, দেখলাম যে, নাহ ভুল দেখিনি। চোখের সামনে ঝকমক করছে পুরোপুরি জীবিত নানান ডিজিটাল অলংকার মানে অ্যাপখচিত ছোঁয়াফোনের পর্দা! এতে সবার অলক্ষে, মাথায় যে দুশ্চিন্তার হিমালয় কালাপাহাড় বহন করে বেড়াচ্ছিলাম এতক্ষণ, নেমে গেল তা মাথা থেকে চট করে। মনে হল এইমাত্র ফোনের পর্দায় বুঝি, এ যাবৎকালে চর্মচক্ষে অবলোকন করা সুন্দরতম দৃশ্যসমূহের একটিকে বুঝি দেখলাম!
ফলে নিজেরই অজান্তে, আরে এটা তো দেখছি ঠিক হয়ে গেছে ? আনন্দ উত্তেজনায় মুখ ফুটে বের হওয়া এ বাক্যটি দীপ্রর কানে যেতেই ওর উৎসুক প্রশ্ন : “কি বাবা , কি ঠিক হয়েছে ?”
আরে বলো না, ঐ যে লি খাঁ মানে আমাদের সোফার, তোমরা গাড়ি থেকে নেমে যাবার পর পার্কিং লটের দিকে চলে যাওয়ার পর, অভ্রর হাতমোজা গাড়িতে পড়ে আছে কি না তা জানার জন্য ফোন করার জন্য পকেট থেকে বের করার পর দেখেছিলাম, ফোনের পর্দাটি পুরো মুখ কালো করে আছে। নানাভাবে বোতাম টিপেটুপেও যখন ওইটিকে চালু করতে পারছিলাম না, তখন ভেবেছিলাম সারারাত ঐটিকে চার্জ করার জন্য বিছানার পাশের প্লাগ পয়েন্টে লাগিয়ে রাখার পরও মনে হয় ওইটিতে চার্জ হয়নি মোটেও, লুজ কানেকশনের ফলে। এছাড়া ঐটির এভাবে হঠাত নিশ্চল হয়ে যাবার আর কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম তাতে! কারণ আমার ফোন ছাড়া তো, আর কারোই ফোনের মগজে নাই লি খাঁর নম্বর। অতএব ওকে কিভাবে যে ডেকে আনব তা ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। ঐ ফোনটাই তো ছিল এই হিমসাগর পাড়ি দেবার কালের একমাত্র লাইফলাইন আমাদের।
এসব বলতে বলতে ফের ফোনের চার্জ আসলেই কতোটা আছে, তা পরখ করার মানসে ফের ফোনের পর্দায় চোখ রাখতেই, ফোনের পর্দার ডানপাশের একদম উপরের দিকের কোনায় থাকা, ছোট্ট ব্যাটারি চিহ্নটির দিকে তাকিয়ে ওটাকে পুরো সবুজ দেখতে পেয়ে , নিশ্চিত হওয়া গেল যে, নাহ চার্জ তার ঠিকই হয়েছিল রাতে। আর সেই চার্জের ২/৩ পার্সেন্ট ও খরচ হয়নি এখনও!
“ভাইয়া, বাবা তোমরা কি করছ? কী বলছ?” আমাদের পিছু ফেলে লাফাতে লাফাতে এরই মধ্যে কিছুটা সামনে এগিয়ে যাওয়া অভ্র, তুমুল কৌতূহলে দৌড়ে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করতেই, ওকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাওয়া লাজু আর হেলেনও ফিরে এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়ালো-অতএব ফের সকলকে আদ্যোপান্ত দিতে হল বিবরণ হাতফোনের ডিজিটাল ভুতুড়েপনার। একই সঙ্গে বললাম সেই আচানক ঘটনায় এক্কেবারে হকচকিয়ে ভ্যাবলা বনে গিয়ে, কেমন দুশ্চিন্তার চাপ মাথায় মনে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম এতক্ষণ ওদের সাথে, কিছুই হয়নি এরকম একটা ভান করে।
“তুমি হয়তো ঠিকমতো দেখোনি ফোনটা। কিম্বা হতে পারে পকেটে রেখেছিলে যখন ফোন, তখন পকেটের ভেতর কোন চাপ লেগে তার সুইচ অফ হয়ে গিয়েছিল, তাই অমন হয়েছিল।“ লাজুর এই ব্যাখ্যায় আবারো ঘোষিত হল পৃথিবীর তাবৎ বিবাহিত পুরুষদের জগতের সেই চরম সত্য, যা হল যত দোষ স্বামীঘোষ।
“তা বলো নাই কেন এতোক্ষণ কিছু?” স্ত্রী দেবীর এবারের এ প্রশ্নের জবাবে ভুল করে মুখ ফস্কে বলতে যাচ্ছিলাম যে, কেন বললে কি হতো? তুমি কি ঠিক করে দিতে না কি ফোন? আমি কি ফোনের বোতাম চাপাচাপি করে কম সাধ্য সাধনা করিনি এর ভুতুড়েপণা তাড়াতে ? তোমারই বা কেন মনে হল যে আমি ভুল দেখেছি?
কপাল ভাল অবচেতনের দেয়ালে লটকে থাকা শাহী ফরমানের মতো স্থায়ী মোহরমারা নির্দেশনা “কখনও স্ত্রীর সাথে মুখে মুখে মুখ নাড়াবে না “নজরে পড়ায় সে ভুল না করে বরং সাবধানের মার নেই, এ কথা ভাবতে ভাবতে , দ্রুত ফোনের পর্দায় হাত বুলিয়ে নিয়ে আসলাম আমাদের লাইফলাইন লি খাঁর নম্বর। অতঃপর সবাইকে যার যার হাতফোন আর হাতযন্ত্রের মগজে তা জমা রেখে দেবার জন্য বললাম, বাড়তি সতর্কতা হিসাবে। যাতে আর কিছু না হোক, কোন দৈব দুর্বিপাকেও কেউ আমরা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, কোন সহৃদয় চায়নিজকে ধরে পেতে হলেও তার ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতে পারবে সে লি খাঁর সাথে।
আচ্ছা তোমরা সবাই একটু চেক করে দেখো তো যার যার কাছে থাকা হোটেলের ঠিকানাা লেখা কার্ডটি আছে কি না ঠিকঠাক? মানে প্রথম স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি আসলেই যথাস্থানে আছে কি না, তা ফের নিশ্চিত হতে চাইলাম আর কী, এবার। ফের কোন রকম দ্বিরুক্তি না করে, দ্রুত সবাই এ বিষয়ে ইতিবাচক ফলাফল জানাতে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, প্রথমত এই ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত সকলের জন্য দ্বিস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেল। দ্বিতীয় হাঁফ ছাড়ার কারন হল, এই অল্প সময়ের ব্যবধানে পর পর দু’বার করা হুকুমটি বিনাবাক্যব্যয়ে সকলেই পালন করাতে নিশ্চিত হওয়া গেল যে নেতৃত্ব আমার হুমকির মুখে পড়েনি অবশেষে। যদিও স্বামীরা নিরন্তর আকাট অকর্মা হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার কারণে, অহরহই তাদের নেতৃত্ব পড়ে হুমকির মুখে, এবার তা হয়নি অন্তত এক্ষেত্রে! অতএব হৃষ্টচিত্তে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে বাঁয়ে আরেকটা চওড়া করিডোর দেখে, রওয়ানা দিলাম সেদিকে, যদিও জানি না আছে কি তার ভেতর। এদিকে মনে বেশ স্বস্তির ভাব থাকলেও মাথার ভেতরে বন বন করে ঘুরছে, হাতফোনের ঐ ডিজিটাল ভুতুড়েপনার প্রশ্নটি। কেন হল এরকম? এটির কার্যকারণ নির্ণয়ে প্রথমেই একান্ত বাধ্যগত স্বামীর মতোই মনে হল, লাজুবর্ণিত প্রথম কারণটি এক্কেবারেই অমূলক হলেও, দ্বিতীয় কারণটি সত্য হবার সম্ভাবনা প্রচুর।
গাড়ি থেকে নেমে হাড়হিম করা ঠাণ্ডার প্রবল থাক্কায় ভির্মি খেলেও চোখে আমি সর্ষে ফুল যে দেখিনি তা নিশ্চিত। অতএব চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ায়, ভুল কিছু দেখেছিলাম হাতফোনের পর্দায় এটা কারণ হিসাবে, খোঁড়া না শুধু এক্কেবাবেরি লেংড়া আতুর যুক্তি। তবে হ্যাঁ এটা নিশ্চয় হতে পারে যে, টাইট জিন্স প্যান্টের পকেটে ফোনের বোতামে চাপ লেগে, কোন না কোন সময় হয়তো ফোনটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যে জিন্স পড়ে আছি তা তো বেশ টাইট ফ্যাশনেরই। আর এমনিতেও জিন্সের পকেটগুলো যেরকম সামনের দিকে থাকে প্যান্টের শরীরের সাথে গা লাগিয়ে, তাতে কোন কিছু ঐ পকেটে ঢোকাতে বের করতেই সবারই ঝক্কি হয়, সবসময়। আর এখন তো সেই প্যান্টের নীচে পড়েছি আবার দ্বিস্তরের গরম কাপড় , ফলে ঐ পকেটে থাকা যে কোন জিনিষই এক্কেবারে চিড়ে চ্যাপ্টা না হলেও , তার উপর যে প্রচুর চাপ পড়বে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। অতএব এটিই হতে পারে সম্ভাব্য কারন, ফোনের ঐরকম হঠাত ভির্মি খেয়ে নিশ্চল হয়ে যাবার। আর এখন এই ওম ওম গরম ঘরের ভেতরে ফের যখন নিজের অজান্তেই মরা ফোনটিকে টেনে বের করছিলাম পকেট থেকে , ওইসময় ফের বোতামে চাপ পড়ায় সেটি হয়তো হয়ে উঠেছিল সচল।
কিন্তু না, তাই যদি হবে, তবে ফোনের ঐ মৃতপ্রায় অবস্থা দেখে সে সময় যে অনেক সাধ্যসাধনা করেছিলাম সেটির দুইমাত্র বোতামে নানান মাপের চাপ দিয়ে, তাতে তো তার সম্বিৎ ফেরার কথা। তা তো হয়নি তখন! সে তো নাড়েনি কানের মাছিও মোটেও তখন। অতএব যে স্ত্রী আজ্ঞাটিকে একান্ত বাধ্যগত স্বামী হিসাবে মেনে নিতে চাচ্ছি, তা তো মানা যাচ্ছে না দেখছি।
এসব ভাবনার ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ততক্ষণে করিডোর পেরিয়ে আরেকটি হল ঘরে এসে পৌঁছুতেই, দেয়ালে লাগানো এক বিশাল তৈলচিত্র নাকি জলচিত্র, মানে জল রঙয়ে আঁকা ক্যানভাসের দিকে নজর পড়তেই হুড়মুড়িয়ে দেখছি সবাই ঐদিকে এগিয়ে তুলছে ছবি ঐটিকে ব্যাকগ্রাউন্ড বানিয়ে। ফলে পকেট থেকে ফের ফোন বের করে, সেটির লেন্স বাগিয়ে একটা মোক্ষম ছবি তোলায় মন দিলাম।
ফোনের পর্দায় চোখ যেতেই, দেয়ালের অনেকটা জুড়ে থাকা সেই চিত্রের পটভূমিতে চোখ পড়তেই মন যেন কেমন কেমন করে উঠলো। অতএব ছবি তোলাতুলি বাদ দিয়ে সেই ছবির দিকে নজর রেখে এগুতে লাগলাম সামনের দিকে, কাছ থেকে দেখার জন্য তা। যদিও মনে হচ্ছে দূর থেকেই ওটা দেখা ভাল, তারপরও কাছে যেতে ইচ্ছে হলো।
খুবই সহজ সরল বিষয় ছবির। একদল সাদা সারস উড়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে, নীল আকাশে। তাদের অনেক নীচে দিগন্ত জুড়ে শুয়ে আছে উঁচু নিচু এক বিশাল লাল প্রান্তর! বিশালাকার এই ছবিটির নীচের প্রান্তরের লাল রং, উপরে আকাশের হালকা আকাশী রংয়ের ফাঁকে ফাঁকে সাদা পেজা পেজা মেঘের, ভেতর দিয়ে দুরন্ত গতিতে উড়ে যাওয়া সাদা সারসগুলো শিল্পী এমনভাবে এঁকেছেন যে, তা দেখলে মন ও উড়ে যেতে চায় ঐ সারসগুলোর সাথে দূর অজানায়।
আচ্ছা এই প্রান্তরকে এরকম লাল করে এঁকেছিলের কেন শিল্পী? তিনিও কি তবে মাও এর লাল পতাকার জয়গান গাইতে চেয়েছিলেন নাকি তার শিপ্লকর্মে? নাকি ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের যেমন পাক্ষপাতিত্ব ছিল হলুদ রঙয়ের প্রতি, তেমনি এই শিল্পী পছন্দের রং ছিল লাল? যার কারণেই তিনি অনন্ত আকাশের নীচে উঁচু নিচু ভূমি জুড়ে শুয়ে থাকা বিশাল প্রান্তরে তৈরি করেছেন লালরঙয়ের এক পরাবাস্তব নাকি অতিজাগতিক আবহ?
তখনি মনে হল, আরে নাহ শিল্পী হয়তো পরাবাস্তব বা অতিজাগতিক কিছু আঁকেননি, বরং এঁকেছেন তিনি একটি বাস্তব চিত্রকর্মই। এ ভ্রমণে আসার আগে খুব বেশী পরিকল্পনা করার সুযোগ পাইনি বলে একদমই যে কোন কিছুই ভাবিনি বা দেখিনি, তা তো নয়। ফলে নানাসময়ে গুগুল করে দেখতে পাওয়া কুনমিং এর তামার খনি সমৃদ্ধ এলাকা, ডংচুয়ান ডিসট্রিক্টের রক্ত লাল মাটির রঙয়ের পাহাড় পর্বত সমৃদ্ধ এলাকার ছবিগুলো ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
নাহ, কুনমিংয়ে তিন দিন থাকলেও, ঐ শহর থেকে মাত্র পঞ্চাশ ষাট মাইল দূরে থেকে সেই বিস্তীর্ণ লালমাটির এলাকায় যাওয়া হয়নি আমাদের। যদিও ইন্টারনেটে দেখা ঐসব ছবির সাথে দেয়া বর্ণনা পড়ে জেনেছিলাম, ফটোগ্রাফার টুরিস্টদের কাছে সেটি নাকি অত্যন্ত জনপ্রিয় জায়গা। আমরা কেউ তো আর পেশাদার ল্যান্ডস্ক্যাপ ফটোগ্রাফার নই, তাই সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনাও করিনি। কিন্তু এ মুহূর্তে এই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, নাহ কুনমিংয়ে আরেকদিন বেশী থেকে হলেও যাওয়া উচিৎ ছিল সেখানে। ভুল হয়ে গেল এবার!
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক