গোল নাকি ঘোল ?
এইরকম যাদের জীবন উঠে আছে সর্বক্ষণ টাকার নিক্তিতে, তাদের তো কোন সময়ই নেই একমনে কিছুক্ষণ অজানা কোন পাখির গান শোনার! নেই কোন সৈকতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের বালির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া দেখার, অবসর। নেই তার সময় উঁচু পাহাড়ে উঠে দিগন্তের দিকে অকারণ তাকিয়ে থাকার! জীবন এদের তো তাহলে সেই যে মাঝি বলেছিল ষোল আনাই মিছে, ওরকম না হলে কমপক্ষে চার ছ আনা তো মিছে অবশ্যই। আর এই চার ছ আনাই তো ষোল আনা জীবনকে করে তোলে রঙ্গিন।
জানি আমার মনের এসব কথা দশজনে শুনলে, হা হা করে এক বাক্যে বলে উঠবে সবে; “বুঝেছি বাপু তোমার অবস্থা হল “আঙুর ফল টক”! এরকম ভাবনার তাল কেটে এসময় লিফটের দরজা খুলতেই, লিফটের প্যানেলের যে জায়গাটায় কোথায় সে থামল, লাল অক্ষরে ঘোষণা হয় সেই খবর, সেদিকে চোখ যেতেই বুঝলাম নেমে গেছি নীচতলায়। লিফট থেকে বেরিয়ে তাই ডান দিকে হাঁটা দিলাম । কারন কন্সিয়ার্জ ডেস্কে যাই, আর হোটেলের বাইরেই যেতে চাই, যেতে হবে ঐ ডান দিকেই ।
দ্রুত পায়ে ডানে এগিয়ে, এ মুহূর্তে ফাঁকা পড়ে থাকা কন্সিয়ার্জ ডেস্কের সামনে দাঁড়ালাম গিয়ে। ডেস্কের ওপাশে মিস ইনা বসে বসে কি যেন করছিলেন। আমার ছায়া তার মুখে পড়তেই এক গাল হাসিতে মুখ তোলার সাথে সাথে, উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, অবশেষে কি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আগামি কালকের বেইজিং ট্যুরের ।
চমৎকৃত হলাম ফের! ভাবলাম এই ক’দিনেও আমি যখন এক চায়নিজের চেহারা থেকে আরেক চায়নিজকে আলাদা করতে পারিনি; ফলে একই উচ্চতার যে কোন দুজন চায়নিজকে দেখলে, লিঙ্গভেদে ওদেরকে আইডেণ্টিকাল যমজ ভাই বা বোন ঠাউরাই, সে জায়গায় এ সন্ধ্যায় একবার মাত্র দেখে কি করে সে মনে রাখলো আমাকে? তাহলে কি বাংলা পাঁচ চেহারা আমার এতোটাই কিম্ভূত যে একবার দেখেও, তা মনে গেঁথে গেছে তার ? এ মনে হতেই দমে গেল মনটা আমার! কিন্তু সাথে সাথেই তাতে মলম লাগাল মনের দ্বিতীয়জন। সে মন বলল, হোটেলে ঢোকার পর থেকেই এ পর্যন্ত লবিতে যতজনকে দেখেছি, তার মধ্যে একমাত্র আমরাই তো হলাম ভিন্ন বর্ণ আর চেহারার। আর একই বর্ণের কাছাকাছি চেহারার উপমহাদেশীয় কেউ যদি থেকেও থাকে হোটেলে, তাদের কেউ নির্ঘাত এ সন্ধ্যায় তার কাছে বেইজিং ট্যুরের সুলুক সন্ধান করতে আসে নি, যার কারণেই হয়তো মনে আছে আমাকে তার।
মিস ইনার হাসি মুখের প্রশ্নের জবাবে একগাল হাসিতে, তাই ঘোষণা করলাম যে অতপর আমরা ঠিক করেছি যে আমাদের একটি ভ্যানই লাগবে। বলেই মনে হল, চায়নিজরা নাকি আর কিছু না হলেও দামাদামি করাতে বাঙালির সাথে পাল্লা দিতে পারে সমানে সমান। বাঙালির দামাদামি করার প্রতিভার স্বাক্ষর হিসাবে যখন শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষদেরই কেউ কেউ নাকি, এমন কি রেলেরটিকিট, ডাকটিকিট কিনতে গিয়েও দামাদামি করেছিল! নিজের ঐতিহ্যের ঝোলায় এইরকম একটি জ্বলজ্বলে উদাহরণ থাকতে, এর বলা দামে, এককথায় ঐ ভ্যান ভাড়া করা ফেললে তো ইজ্জত থাকে না ।
বললাম তাই , ভ্যানই লাগবে আমাদের , তবে সে যে দাম বলেছে তা বেশি মনে হচ্ছে। ভাড়াটা এতো বেশি হওয়া উচিৎ না। এতোটুকু বলেই আমতা আমতা করতে থাকলাম। কারণ এ ব্যাপারে জাতীয় ঐতিহ্যের ঝোলা আমাদের যতই সমৃদ্ধ হউক না কেন , জীবনের অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ বৈষয়িক বিষয়ের মতো এ ব্যাপারেও হলাম যে আমি এক্কেবারে যাকে বলে আকাট মূর্খ বা নিতান্তই নবিস, তা তো আমি প্রতিনিয়তই শুনি লাজুর কাছে; বাজার থেকে কলাটা মূলাটা, মাছটা কিনে আনার পর। দেশেই যখন পারি না বিক্রেতাদের সাথে কোমর বেঁধে দরদাম যুদ্ধে নামতে, সেখানে এই অজানা শহর বেইজিং আমি যাই সেই যুদ্ধে আর কোন সাহসে? অতএব ভ্যানের ভাড়াটি সে অতিরিক্ত চেয়েছে এটুকু বলেই, তড়িঘড়ি ডিসকাউন্ট দাবি করলাম।
তবে এই যে কথাগুলো বলেই বুঝলাম, তা বলতে বলতে চেহারায় আমার যে অসহায় নবিস ভাবটি ফুটে উঠেছিল, হোটেল লবির আলো আধারির মধ্যেও খুব সহজেই সম্ভবত মিস ইনা তা পড়ে ফেলতে পেরেছে । মুচকি হাসিতে সে শুধু সে ‘নো নো ইতস ফিক্সত।’
এবার আর নিজের না , জাতীর ইজ্জত বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় কিছুটা জোর দিয়েই বললাম ,নো নো আই নিড সাম ডিসকাউণ্ট। মানে আবারো ব্যর্থ হলাম নির্দিষ্ট করে কোন একটা পাল্টা দাম বলার ব্যাপারে, যা নাকি এই দর কষাকষি, ইংরেজিতে যাকে বলে হ্যাক্লিং তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ! অতএব ফুটবল ভাষ্যকারেরা যে অবস্থাটাকে বলে রক্ষণভাগের ভুলে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ড অরক্ষিত গোলপোস্ট পেয়ে সহজেই গোল করে দিল , ঠিক একই কাজ করল মিস ইনা
বলল ‘ওকে ইউ পে পাইভ হান্দ্রেদ। নো মোর বারগেইন”। এ বলেই সেলসের ভাষায় যাকে বলে সেলস কল ক্লোজ করা , সেটি করে পাল্টা জিজ্ঞেস করল “এত হোয়াত তাইম ইউ ওয়ান্ত তু স্তার্ত?”
মিস ইনার তড়িৎ সেলসমেনশিপের ঝলকে দরদাম করার ব্যাপারে নিতান্তই নবিস আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গোল খেলাম না ঘোল খেলাম বুজতে না পারলেও, নিজের বহুদিনের পেশাগতকারণে বরং চমৎকৃত হয়ে বললাম যে, ঠিক ন’টায় হোটেল থেকে বেরুতে চাই, অতএব ড্রাইভার যে যেন সে মোতাবেক হাজির থাকে ।
উত্তরে “দোন্ত অরি, হোয়াত ইজ ইউর লুম নাম্বার” জিজ্ঞেস করল মিস ইনা। আমি রুম নাম্বার বলতেই সাহাস্যে তা টুকে নিয়ে বলল ‘হয়াত এলস ক্যান আই দু , ফল ইউ’
ভাবলাম, পেশাদারিত্বের যে ঝলক দেখাইলা কইন্যা এই সন্ধ্যায়, তাতে ভির্মি খাইয়া গেছি। তোমারে দিয়া আবারো বুজলাম ফের, বহুদিন সমাজতন্ত্রনির্মাণ নিয়া ব্যস্ত থাকার পর, খুব বেশি দিন হয় নাই যে, পুঁজিবাদের পথে হাটা শুরু করছো তোমরা ; আর তাতেই প্রমাণ করছো পূঁজির রাজ্যের এতদিনকার রাজা মহারাজাদের তোমরা কেন পরাজিত করবা! অতপর তাক ধন্যবাদ দিয়ে, বা দিকে ঘুরে ধরলাম হাঁটা গেইটের দিকে।
গেইট পেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই যথারীতি জাপটে ধরল বেইজিং হিম। তবে এবারে আর সেই হিমকে তেমন পাত্তা না দিয়ে, দ্রুত ফের বা দিকেই ধরলাম হাঁটা,যেদিক দিয়ে একটু আগেগিয়েছিলাম পুত্রদের নিয়ে মাজারাতি, এস্টনমার্টিনআলয়ের দিকে। হোটেলের গা ঘেঁষে যাওয়া ঐদিকটার পাশরাস্তাটির জেব্রা ক্রসিং কোথায় আছে তা জানিই , অতএব সেটি পেরিয়ে ফের বাঁয়ের ঐ সৈয়দ বংশীয় গাড়িগুলোর বাড়ির দিকে না গিয়ে, ধরলাম হাঁটা ডানে দিকে । ওখান থেকে মিটার তিরিশ চল্লিশ, হাঁটতেই আবারো বাঁয়েই পেয়ে গেলাম রাস্তাটা, যেটি এগিয়ে গেছে, এয়ারপোর্ট থেকে আসা মূল রাস্তাটির সমান্তরাল এগিয়ে যাওয়া হাঁটা রাস্তাটি। মূল আর এই হাঁটা রাস্তাকে আলাদা করে রেখেছে মাজখানে থাকা বড়, ছোট আর ঝোপ জাতীয় নানান গাছগাছড়া, যেগুলোর উপরে আবার জ্বলছে নানান রঙ্গিন বাতি। সেই হাঁটা পথের বাঁয়েই দাঁড়িয়ে আছে নানান আকারের দোকানপাট, যার মধ্যে সামনে কোথাও আছে আমার দেখা সেই সম্ভাব্য ভারতীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট। হৃষ্টচিত্তে হাঁটতে থাকলাম তাই সামনের দিকে ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক