বিপন্ন বিস্ময়
সপুত্রক লিফটের দিকে পা বাড়ানোর আগে নিজের অজান্তেই বাঁয়ে ঘাড় ঘুরে যেতেই দেখলাম, দু হাত প্রবলভাবে নাড়িয়ে মিস ইনা কন্সিয়ার্জ ডেস্কের সামনে ঐ সময়ে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনকে কি যেন বলছে। বুঝলাম শরীরীভাষা ব্যবহার করা তার স্বভাবগত অভ্যাস। কারণ যে দুজনের সাথে কথা বলছে তারা দুজনেই চায়নিজ। যদিও নিশ্চিত নই এ ব্যাপারে, তারপরও কেন জানি আমার মনে হয় যে, লোকজন ভিন্ন ভাষার লোকের সাথে কথা বলতে গিয়েই শরীরী ভাষা ব্যাবহার করে বেশি। তবে হ্যাঁ কোথাও যেন পড়েছিলাম যে, মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যারা নাকি বহির্মুখী স্বভাবের মানুষ, ইংরেজিতে যাদের বলা হয়ে থাকে এঙট্রোভার্টেড, তারা যে কোন সময়ই যে কারো সাথেই, মুখের ভাষার সাথে শরীরী ভাষাও চালায় সমানতালে। মানে এ ব্যাপারে তাদের বলা চলে,এক্কেবারে সব্যসাচী। কন্সিয়ার্জ ডেস্কের মিস ইনাকে ঐরকম একজন সব্যসাচীই মনে হচ্ছে, ফলে ঐ ডেস্কের জন্য সে এক্কেবারে একজন উপযুক্ত মানুষই বলতে হয়!
হাঁটতে হাঁটতে ঠিক এ সময়ই মনে হল, আরে আমার ফেরারি গল্প শুনে, তুমুল বহির্মুখি স্বভাবের দীপ্র ‘ওয়াও’ বলে তার ভাব প্রকাশ করলেও আপাত অন্তর্মুখী স্বভাবের অভ্র বলেনি কিছুই! লিফটের সামনে এসে উপরে যাওয়ার জন্য বোতাম টিপে তাই জিজ্ঞেস করলাম, কি অভ্র আমার ফেরারি গল্পটি শুনে তুমি তো কিছু বললে না?
জবাবে নিশ্চুপ অভ্র দিল এক ভুবনমোহন হাসি শুধু!
ঐ হাসি যদিও নিশ্চিত করছে যে, ব্যাপারটা তাকে সে বেশ চমৎকৃত হয়েছে, তারপরও তার মুখ থেকেই শুনতে চাই, আসলেইও ভাবছে কি। কারণ আজকাল আশেপাশের মানুষের মুখে সারাক্ষণই তো শোনে নিজ দেশের বদনাম । পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া আর মূল স্রোতধারার মিডিয়া তো দেশ নিয়ে যত আজে বাজে কথার বাদ্য বাজিয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ, যার ফলে মনে হয় এ সময়ের বেশির ভাগ বাচ্চাদেরই দেশের ব্যাপারে চরম একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে আছে মনে। সাথে ডিজিটাল টেকনলজি হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়াতে তারা ইউরোপ আমেরিকার জৌলুস দেখে দেখে ভাবতে শুরু করেছে ওদের স্বপনের ঠিকানা। ফলে বড় হয়ে কখন, কতো দ্রুত চলে যেতে পারবে এ দেশটা ছেড়ে এরকম একটা ভাবনাতেই মশগুল সারাক্ষণ, যা নাকি মোটেও পছন্দ নয় আমার। হয়তো ছোটবেলার স্কুলের পরীক্ষায় রচনা, ভাবসমপ্রসারণে বেশি নম্বর তোলার জন্য নানান কোটেশন যোগাড় করতে গিয়ে, অসংস্কৃত আমি যে কি করে একটা সংস্কৃত শ্লোক শিখেছিলাম, বেকুব আমি সেটিকে আজো সত্য মানি। সেই শ্লোকটি হল ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’। আর সেটাই ভাবাতে চাই আত্মজদেরও।
এরই মধ্যে লিফট দরজা খুলে তার ভেতরে ঢোকার আহবান করায়, তাতে ঢুকে এ হোটেলে আমাদের উর্ধ ঠিকানার বোতাম চেপে, ফের জিজ্ঞেস করলাম অভ্রকে, আচ্ছা বলো না বাবা; ফেয়ারির লাল রংটির সাথে যে একজন বাঙালী নয় শুধু, এক্কেবারে বাংলাদেশী বাঙালির নাম জড়িয়ে আছে তা শুনে তোমার কেমন লাগছে?
‘ফিলিং প্রাউড ডেফিনিটলি’ একগাল হাসির ফাঁক গলে শব্দ ক’টি অভ্রর মুখ থেকে বেরুতেই মন ভরে গেল অপার আনন্দে। সাথে এও বুঝতে পারলাম যে ‘ফিলিং প্রাউড’ এই শব্দদ্বয়ের যে ব্যঞ্জনা, তা প্রকাশ করতে আমি যেমন বলি, খুশিতে ছত্রিশ ইঞ্চি বুক আমার ছাপ্পান্ন হয়ে গেছে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তে গিয়ে এরকম শব্দ বা বাক্যের খোঁজ না পাওয়তেই কি, অভ্র বললো তা ইংরেজিতে ঐভাবে? নাকি তার অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে ঘরের বাইরের কারো সাথে যেহেতু ও পারতপক্ষে কথা বার্তা এড়িয়ে চলে, ফলে উত্তেজনায়, রাগে বা আনন্দের সময় হঠাৎ মুখ খুলতে গিয়ে পায়না ও, সঠিক বাংলা শব্দের খোঁজ?
অবশ্য এ ব্যাপারটা এভাবে ভাবিনি তো আগে কখনও। বরং সবসময়ই ভেবেছি যে, কথা বলা শেখার সময় থেকেই যেহেতু ও সামান্য একটু তোতলায়, যেটিকে আবার আমরা ধরে নিয়েছি ওর প্রয়াত শামিম চাচ্চুর স্মৃতি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবার একটা প্রকৃতিপ্রদত্ত বিধান, সেটিকে তো অন্যরা সেরকম সহজভাবে না নিয়ে করে নানান মন্তব্য । ঐসব সে বিব্রতকর মন্তব্যের কারণেই ভেবেছিলাম অভ্র বন্ধ রাখে মুখ পারতপক্ষে। এখন মনে হচ্ছে সেটিই কি আসলে ওর কম কথা বলার একমাত্র কারণ? নাকি আসলেই ও অন্তর্মুখী স্বভাবের বা ইন্ট্রোভার্টেড?
এরই মধ্যে লিফট আমাদের ঠিকানায় এসে থেমে হাট করে দরজা খুলে দিতেই, বেরুতে বেরুতে দুজনকেই বললাম যে , একটু বিশ্রাম নিয়ে আমি অচিরেই বেরুবো ফের একাকী। কারণ প্রথমত আগামিকাল আমাদের বেইজিং ভ্রমণের ব্যাপারটি মিস ইনা সাথে চূড়ান্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ধারে কাছে কোন যুৎসই রেস্টুরেন্ট খুঁজতে হবে। আর দ্বিতীয় কাজটি করতে গিয়ে এই হাড়হিম করা ঠাণ্ডায়, অচেনা শহরে কতক্ষণ যে লাগবে সময় আমার তা তো জানি না ঐ ঝামেলায় না গিয়ে, এ ফাঁকে বরং গোসল টোসল করে, নেয়াই ভাল।
এসব বলতে বলতে আমাদের রুমের সামনে এসে দরজার তালায় চাবিকার্ড ছোঁয়াতেই, দীপ্র এগিয়ে গেল ওদের রুমটার দিকে। দরজা ঠেলে অভ্রর পিছু পিছু রুমে পা দিয়ে, স্নানঘরের ঝর্ণা থেকে আসা ঝম ঝম পানির শব্দ জানান দিল, স্নানকর্ম শেষ হয়নি তখনো লাজুর। ধীরেসুস্থে মূল রুমে ঢুকে, বিছানা পেরিয়ে ওপাশের জানালার কাছে পেতে রাখা সোফায় হাত পা ছড়িয়ে গা এলিয়ে বসতে না বসতেই, এসময় উপর্যুপরি বেশ ক’বার রুমের ঘণ্টা বেজে, গোটা রুমটাতে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিতেই বেশ বিরক্তি নিয়ে, ধড়মড় করে উঠে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই ‘দেখো বাবা, আমি সেই কতোক্ষণ ধরে বেল বাজালাম, কিন্তু এন দরজা খুলছে না কিছুতেই’ বলতে বলতে আমার চেয়েও ঢের বিরক্ত দীপ্র, হুড়মুড় করে ঢুকল রুমে
কেন, তুমি রুম কার্ড নিয়ে বের হও নি? হেলেন হয়তো গোসল করছে, যার কারণে শুনতে পায় নি। আর শুনতে পেলেও তো, সাথে সাথেই খুলতে পারবে না। আমারএ কথাগুলো দীপ্রর কানে গেল কী না, বুঝতে পারলাম না। কারণ ততোক্ষণে ও গিয়ে দেখছি অভ্রকে বলছে, অভ্র যেন ওর হাতযন্ত্রটা ওকে দেয় এক্ষুণি, জরুরী ভিত্তিতে! এদিকে ভাইয়া কি বলছে, তার দিকে মোটেও কর্ণপাত না করে অভ্রর যাবতীয় মনোযোগ তখন টেলিভিশনের রিমোটে।
বড় ভাইয়ের অত্যন্ত জরুরি এই আদেশের প্রতি অভ্রর নিদারুণ নিস্পৃহতায়, তুমুল বিরক্ত দীপ্র ততোক্ষণে ওকে একটা জোর ধাক্কা দিতেই, অভ্র পাল্টা ধাক্কা দেবার জন্য ফুঁসে উঠতেই দ্রুত দুজনের মাঝে গিয়ে, দীপ্র কে বললাম, কি ব্যাপার তুমি রুমে ঢুকেই ওর সাথে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে কেন?
‘আমার আইপ্যাডটা তো ঐ রুমে। তাই একটু ওর আইপড টা চাইলাম, কিন্তু এই বাজে ছেলেটা তাতে পাত্তাই দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে শুনতেই পায় নি আমার কথা।’ তীব্র কণ্ঠের জবাব দীপ্রর। কেন , আইপড লাগবে কেন এখন তোমার? দেখছ না ও এখন টিভি নিয়ে ব্যস্ত। একটু অপেক্ষা করলেই তো ও দিতো । আর তুমি যে গেইম খেলছিলে আইপ্যাডে সেটা কি ওর আইপডে আছে?
‘আমি তো গেইম খেলবো না এখন বাবা? একটু গুগল করে দেখতাম যে বেইজিং এ অ্যাপল স্টোরটা আছে কোথায়’ বলল দীপ্র -মনে পড়ল সকালে কুনমিং এয়ারপোর্টে ছোট ভাইকে দলে নিয়ে দীপ্রর হেডফোন খোঁজার ব্যাপারটা। ঐ সময়েই ও ঘোষণা করেছিল বেইজিংএ এসে ও অ্যাপল স্টোরে যাবে। যার কারণেই ও খুঁজে দেখতে চাইছে এখন আছে কী না সেটা আশেপাশে। আর আশেপাশে যদি সেটা থাকেই, তবে যতোই আমার অনীহা থাকুক না কেন, এ ঠাণ্ডায় ফের ওদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে, তারপরও ও এ ব্যাপারে গো ধরতে চাইছে মনে হয়। এমনও হতে পারে যে লিফটে উঠতে উঠতেই, ও হয়তো ঠিক করে রেখেছিল যে রুমে গিয়ে প্রথমেই সে আইপ্যাডকে রুমের ওয়াই ফাইয়ের সাথে কানেক্ট করে খুঁজবে ওটা। কিন্তু ঐ রুমে ঢুকতে না পেরে পরিকল্পনামাফিক তা করতে না পারায় সে অস্থির হয়ে পড়েছে।
সে যাই হোক, যদিও জানি না ইন্টারনেটের সুপার হাইওয়েতে চায়নার তুলে রাখা উঁচু কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে, দীপ্র গুগল করে আদৌ বের করতে পারবে কি না বেইজিং এর অ্যাপল স্টোরের ঠিকানা সাকিন এ মুহূর্তে, তারপরও পকেট থেকে হাতফোনটা বের করে ওর হাতে ধরিয়ে গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে বসলাম সোফায়।
ফোন হাতে পেতেই, হৃষ্টচিত্তে তা নিয়ে দীপ্র ব্যস্ত হয়ে পরাতে বোঝা গেল, হয় হোটেলে চেক ইন করার সময় আর সব কিছুর দিকে মনোযোগ না দিলেও, ওয়াই ফাই এর লগ ইন আর পাসওয়ার্ড বিষয়ক যে ব্রিফিং দেয়া হয়েছিল কাউন্টার থেকে, সেটাও মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। না হয় তার এযাবতকালে, এ ধরনের হোটেলবাসের অভিজ্ঞতার আলোকে ও ধরেই নিয়েছে যে, অগুলো হবে যথাক্রমে রিজার্ভেশনকারীর নামের শেষাংশ আর রুমের নম্বর। অতএব কাজ শুরু করেছে সে দ্বিধাহীন, সেই মোতাবেক। অন্যদিকে অভ্রর দুচোখ একমনে স্থির তখন টিভির পর্দায়। তাতে বোঝা গেল যে আপাতত টিভিতে পেয়েছে সেও, কাঙ্ক্ষিত কিছু একটা। কী যে দেখছে টি ভিতে ও, আলসেমির কারণে টিভির পর্দায় চোখ ফেলে তা আর দেখার ইচ্ছা হল না। তবে চুং চাং শব্দ যা আসছে কানে তাতে বুঝলাম , যাই দেখুক, ভাষা সেটার চায়নিজই।
আধশোয়া, আধবসা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে একটু বিশ্রাম নেবার মনস্থ করতেই ফের দুই পুত্রের স্বভাবের আপাত এই বহির্মুখীনতা আর অন্তর্মুখীনতা বিষয়ক ভাবনাটা ঘুরপাক খেতে লাগল। হ্যাঁ একদম ছোটবেলা থেকেই দীপ্রর চটপটে স্বভাব, আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস, বন্ধুর সংখ্যার বিপরীতে অভ্রর কথা কম বলে বা একদম না বলে একমনে ছবি আঁকা নিয়ে বা লেগো নিয়ে কোন কিছু বানানো নিয়ে ব্যস্ত থাকা, এসবকে সূত্র ধরে এগুলো দীপ্র নির্ঘাত বহির্মুখী স্বভাবের হলেও অভ্র তার বিপরীত। কিন্তু তারপরও কি তা নিশ্চিত ধরে নিতে পারি?
কারণ মানুষের মন তো বড়ই জটিল। মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা ছাড়া এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসা ঠিক না মোটেও। যখন আবার জানি যে এমন কি মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেও, অনেক আপাত বহির্মুখী বিবেচিত অনেকে আসলে যে চরম অন্তর্মুখী তাও বেরিয়েছে। ফলে মনোবিজ্ঞানীরা কাউকেই এক্কেবারে সব সময়ের জন্য, সকল কিছুর ব্যাপারেই বহির্মুখী বা অন্তর্মুখী বলে রায় দেন না। তুমুল বহির্মুখী হিসাবে পরিচিত ও খ্যাত অনেকেরই, যাদের কোন কিছুই গোপন নয় বলে মনে করে সবাই; তাদেরও ক্ষেত্রে দেখা গেছে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে তারা একদম মুখ আটকে রাখে ঝিনুকের মতো আঁটসাঁট করে। যেমন কিংবদন্তী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন নাকি একবার বলেছিলেন : I have many problems in my life. But my lips don’t know that. They always smile”
আবার মনোবিজ্ঞানী না হয়েও প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ একই বিষয়ে লিখেছেন ‘অর্থ নয় কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়,আরো এক বিপন্ন বিস্ময়, আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত ক্লান্ত করে।’ আসলেই মানুষের সেই বিপন্ন বিস্ময়ের খোঁজ অন্য কেউ জানবে কি করে, যখন সে নিজেই জানে না তার খবর?
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক