দেশ হতে দেশান্তরে

ডেস্টাইন্ড টু দুবাই, স্টাক ইন রিয়াদ

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৫ অক্টোবর, ২০২৫ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

ভিসা বিষয়ক অনিশ্চয়তার কারণে তিন দিন আগেও জানতাম না, আসলেই যাচ্ছি কি না দুবাই মিটিংয়ে। অথচ দাঁড়িয়ে আছি এখন রিয়াদ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন লাইনে সে কারণেই। অবশ্য দুবাইয়ের ভিসা না পেলেও, এখানেই থাকতাম আজ এখন। কারণ আমার সৌদি ভিসার মেয়াদের আজই শেষদিন। সেক্ষেত্রে দুবাইয়ে তিন চার ঘণ্টার ট্রানজিট শেষে ধরতাম ঢাকার ফ্লাইট। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিউসি আমার দুবাইয়ের ভিসা যোগাড় করে ফেলতে পারায়, দুবাইয়ের ট্রানজিট আমার তিন দিনে ঠেকেছে আর কী।

বেজায় চাপ দেখছি ইমিগ্রেশনে এখন। প্রতিটি কাউণ্টারেই দীর্ঘ অপেক্ষমাণ লাইন, অবলীলায় যা উপেক্ষা করে, ইমিগ্রেশন কর্মীরা করছে কাজ, গা ছাড়া ভাবে, ঢিমে তালে। আমারও নাই তাড়া। হাতে সময় আছে যথেষ্ট। ভ্রমণসঙ্গী ভোমা দুই সুটকেসের ওজনের ঘাপলায় না পড়ে নির্ঝঞ্ঝাটে এয়রালাইন্সের হেফাজতে দিতে পারায় মেজাজ বেশ ফুরফুরে।

দেশে যাবার প্রস্তুতি হিসেবে গত সপ্তাহ তিনেক ধরে যখনই সুযোগ পেয়েছি ঢু মারতে শুরু করেছিলাম মার্কেটে মার্কেটে, বিশেষত অফিস থেকে ফেরার পথে খালেদ বিন ওয়ালিদ স্ট্রিটস্থ রিয়াদমলে, তার থেকে কিছুটা এগিয়ে হাইপারপাণ্ডা নামের যে অতিকায় স্টোর আছে সেটিতে, ও আমার কমপাউন্ডের অনতিদূরের গ্রানাডা শপিংমলে।

শপিংলিস্টি যা পেয়েছিলাম বউয়ের কাছ থেকে, সেটি আকীর্ণ পুত্রদের খাবার দাবারের আইটেমে মানে, গুঁড়া দুধ, নানান রকমের পনির, মাখন, মেয়নেজ এসবে। এসব বস্তু দেশে খুব একটা পাওয়া যায় না যেমন, তেমনি দামও আক্রা। তদুপরি ঐগুলি কি আসল না নকল তা নিয়ে আছে ঘোরতর সন্দেহ। তার বিপরীতে সৌদি আরব থেকে কেনা এসবের উপর আছে আমাদের দেশের সকলেরই প্রবল আস্থা।

প্রথম দুই একদিনের ঘুরয়াঘুরিতে একটা জিনিষ আবিষ্কার করেছিলাম যে, এই স্টোরগুলোর একেকটিতে একেকদিন একেক কোম্পানি তাদের নানান পণ্যের উপর বিরাট অংকের ডিস্ককাউন্ট বা সেল ঘোষণা করে। ফলে নিয়ম করে অবসরে তক্কে তক্কে ঘুরতে শুরু করেছিলাম স্টোরগুলোতে। তাতে যখনই যে স্টোরে যে পণ্যের ডিসকাউন্ট পেয়েছি, কিনে ফেলেছি সাথে সাথে। এতে অবশ্য কিছু কিছু জিনিষ অতিরিক্তও কেনা হয়েছে। এই যেমন দুই দিন আগে অতিকায় সেই হাইপার পাণ্ডায় যখন দেখলাম, দুই কেজি সাইজের ভোমা কন্টেইনারের মেয়নেজ দিচ্ছে বলা চলে পানির দামে, কিনে ফেলেছিলাম সাথে সাথেই। যদিও এর আগে স্ত্রীআজ্ঞা মেনে দু তিন বোতল সাধারণ সাইজের মানে ৪০০/৫০০ গ্রামের মেয়নেজ কেনা হয়েছিল, তারপরও কিনেছি। যেহেতু সেলের কারনে এই দুই কেজির দাম পড়েছে আগে কেনা তিন বোতল মেয়নেজের চেয়েও কম। যদিও ব্র্যান্ড ভিন্ন। তবে তাতে কী? মেয়নেজ তো মেয়নেজই!

হুম, আজকের তুমুল প্রতিযোগিতামূলক ভোগাবাদি সভ্যতায় নানান কোম্পানির মি টু প্রডাক্টের বিপণনে, মানে একই পণ্য শুধুমাত্র ভিন্ন প্যাকেজিং ও ব্রান্ডনামে ক্রেতা ধরার জন্য তাদের অন্যতম ফাঁদ হল ডিসকাউন্ট বা সেল । নিজে বিপণনবিদ হয়ে তাই উল্টা একয়দিন স্টোরে স্টোরে হানা দিয়ে নিজেই শুরু করেছিলাম ডিসকাউণ্ট ধরার ইঁদুর বিড়াল দৌড়।

তাতে আরো যা কেনা হয়েছে সেগুলো হলো, শ্যাম্পু, ক্রিম, সাবান, লোশন, টুথপেস্ট। এছাড়াও কিনেছি যে সব কে বলে হোমকেয়ার প্রডাক্ট এবং যে গুলো সাধারণত দেশে পাওয়া যায় না, ওসবও। সবই যে সেল বা ডিস্কাউন্ট পেলেই কিনেছি তা তো নয় । নিজেদের ব্যবহার্য কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্র্যান্ডনেমই ছিল নীতিনির্ধারক।

হ্যাঁ আর যে একটি জিনিষ কিনেছি ব্রান্ডিংয়ের কোন তোয়াক্কা না করে শুধু ডিসকাউন্ট দেখে, তা হল খেজুর। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের উপহার দেবার জন্য সৌদি খেজুর কিনেছি অনেক! শুনেছি সৌদিতে প্রায় ৪০০ প্রজাতির খেজুর পাওয়া যায়। তবে ঐসব প্রজাতির কোনটার যে কোন মাজেজা তা তো জানি না। তার দরকারটাই কী? আমাদের দেশের মানুষের কাছে সৌদির যেকোন খেজুরেরই অতি উচ্চ মরতবা। ফলে দেখতে হৃষ্টপুষ্ট আর ভাল ডিসকাউন্ট পেলেই কিনেছি ওসব দু হাতে। তাতে ভোমা সাইজের হলেও, দুটো সুটকেসেরই অবস্থা টইটম্বুর।

আর হ্যাঁ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ যা কিনেছি, তা হল পুত্রদের অতি প্রিয় “হটহুইল” ব্রান্ডের ডজন খানেক নানান ধরনের গাড়ীর মডেল; ট্র্যান্সফর্মার নামের খেলনা রোবট গোটা দুয়েক, সুইচ টিপে দিলে যেগুলো ক্ষণে ক্ষণে নেয় নানান রূপ, বলে কথাও। ঘটনা হচ্ছে আমার কমপাউন্ড থেকে গ্রানাডা মলে যাওয়ার জন্য যে ট্রাফিক সিগন্যালে এসে ডানে মোড় নিতে হয়, ঠিক ঐ জায়গাটাতে পুত্রদের অতি প্রিয় খেলনার স্টোর “টয়স আর আস” এর একটা বড় স্টোর থাকায়, ঐটিতে এতো বেশী গিয়েছি যে, ধারণা করি ওখানকার গার্ড, বিক্রয়কর্মী এরা তো অবশ্যই, এমনকি সেলফ গুলোও আমাকে চিনে ফেলেছে। তবে ওখানে ডিসকাউন্ট শিকার আমার যুৎ করতে পারেনি, বলে প্রথমে বিরক্ত হলেও ভেবেছি পড়ে, আরে আমিই যদি এদের বিপণনকর্তা হতাম, অবশ্যই দিতাম না কোন ডিস্কাউন্ট। বাচ্চা কাচ্চার জিনিষ তো কিনেন তাবৎ বাবা মা হয় আনন্দে নয়তো বাচ্চাদের জেদের কাছে পরাভূত হয়ে।

তবে সবচেয়ে দামি যে জিনিষটি কিনেছি তা হল ১০০ গ্রাম স্বর্ণের একটা বার। নিরাপত্তার খাতিরেওটাকে খেজুর, শ্যাম্পু, ক্লিঞ্জার, পনির, বাটার মেয়নেজের সঙ্গী করিনি। অবশ্য মর্যাদা বলেওতো একটা কথা আছে। মানব সমাজের এই মুল্যবান ধাতুকেতো আর যার তার সাথে রাখা যায় না। আছে সেটা তাই কোমরে বাঁধা ট্রাভেলব্যাগে।

নাহ, আমার বা বউয়ের এই বিশেষ ধাতুটির প্রতি কোন বিশেষ আকর্ষণ বা পক্ষপাতিত্ব নাই। কিনেছি ওটা সাবিনা ভাবীর জন্য। পেশায় চিকিৎসক সাবিনা ভাবী ও তাঁর স্বামী ডাঃ মোসলেউদ্দিন ওরফে সুপ্রিয় মিঠু ভাইয়ের সাথে পেশাগত কারণে পরিচয় হলেও, পরবর্তী হয়ে উঠেছেন তাঁরা আমার পরিবারের পরম সুহৃদ। দুই শিশুপুত্র ও ক্রমশ শিশুতে পরিণত হওয়া আমার বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ পিতাকে ঢাকায় স্ত্রী আর বোনের তত্ত্বাবধানে রেখে, এই যে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি মরুতে; পারছি তা ওনাদের ও বাঙ্গালদেশস্থ আমার সহকর্মীদের কারণেই। আমার অনুপস্থিততে পরিবারের যে কোন চিকিৎসাবিষয়ক সমস্যা সমাধানকল্পে সাবিনা ভাবি আর মিঠু ভাই তো আছেন সর্বক্ষণ একপায়ে খাড়া! তো সেই সাবিনা ভাবীকে কখনোই তেমন গহনাগাটি পড়তে না দেখলেও, আমার সৌদি আরবে আসার কথা শুনেই বলেছিলেন উনি “সেলিম ভাই স্বর্ণ আমার খুব পছন্দ। সৌদির স্বর্ণ তো খুব খাঁটি। তাই বলছি, যখনই দেশে আসবেন আমার জন্য একটা ১০০ গ্রামের বার নিয়ে আসবেন। এই পরিমাণ সোনার তো ট্যাক্স ফ্রি। আমি আপনাকে সাথে সাথেই দাম শোধ করে দেব।”

সপ্তাহ দুয়েক আগে, সাবিনাভাবীর সেই অনুরোধের কথা মনে পড়তেই, খেয়াল করেছিলাম আমি যে সব মার্কেট বা মল চিনি, ঐ সব জায়গায় তো সোনার দোকান দেখিনি। জুয়েলারি শপ যা চোখে পড়েছে ওগুলোর সবই হল ডিজাইনার জুয়েলারি। ঐগুলোতে আবার সোনা নয়, জয় জয়াকার হল, হীরা চুনি পান্না ইত্যাকার রং বেরঙয়ের নানান বহুমূল্য পাথরের। ঐগুলোতে সোনার বার পাওয়া যে যাবে না এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ায়, বাধ্য হয়ে ফোন করেছিলাম সৌদি আরবের নানান টুকটাক সমস্যার সমাধান দেবার কনসালটেন্ট, জিয়াকে। সে মোতাবেক সেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জিয়া নিয়ে গিয়েছিল রিয়াদের আল থুমাইরি স্ট্রিটের এক গোল্ড মার্কেটে। ঐখানে গিয়ে তো চক্ষু এক্কেবারে ছানাবড়া! গোটা মার্কেটের দোকানের শেলফে শেলেফ উপচে পড়া কাড়ি কাড়ি সোনার যেসব গহনা দেখলাম, ওসবই যে উপমহাদেশিয়দের টার্গেট করে বানানো, ওগুলোর ডিজাইন দেখেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। ওখানেই জিয়ার এক পরিচিত দোকান থেকে কিনেছিলাম ১০০ গ্রামের সোনার বারটি। ওসব কথা থাক, এ মুহূর্তে দাঁড়িয়েছি এসে যেহেতু ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাবতীয় মনোযোগ এদিকেই দেয়া যাক ভেবে বেশ তমিজের সাথে কাউন্টারের গোমড়ামুখো তরুণটির দিকে আমার বোর্ডিংকার্ড ও পাসপোর্ট এগিয়ে দিতেই ঐ দুই বস্তুর দিকে এক নজর দিয়ে যে দৃষ্টিতে তাকালো এদিকে, তার মানে যে “আরে বাংলা মিসকিন , তুই আবার বিজনেস ক্লাসে যাস কেমনে?” তা তো জেনে গেছি এর মধ্যে।

আবার এতদিনে চামড়াও যথেষ্ট পুরুত্ব লাভ করায়, মোটেও গায়ে মাখলাম না তার ঐ চাহনি। বরং চেহারায় বেশ গাম্ভীর্য এনে, “কোন কিছুই যায় আসে না আমার” এমন ভাবে থাকলাম দাঁড়িয়ে।

এরই মধ্যে সে পাসপোর্টে লাগানো আমার সৌদি ভিসাটি বার দুয়েক দেখার সাথে , সামনে থাকা কম্পিউটারের দুই বার কি বোর্ডে খটমট করে, পর্দায় কিছু একটা দেখে, বোর্ডিং কার্ডের উল্টা পৃষ্ঠে খস খস করে কিছু লিখে, পাসপোর্টে সিল মেরে বেশ কর্কশ ভঙ্গিতে কিছু একটা বলে দুটোই আমার হাতে দিতেই; তা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার উপক্রম করতে, ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে সে তার সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে আরবিতে ফের কিছু বলতে বলতে হাত দিয়ে আমাকে যে দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল, তা তে এখন যে আমি দুবাইয়ের ফ্লাইটে উঠতে পারবো না, বুঝলাম ওটাই! কপাল ভাল যে তার উচ্চারিত অবোধ্য আরবিগুলোর মধ্যে থেকে পরিষ্কার শুনেছি “এমিরেটস”।

ফলে বিনামেঘের বব্জ্রাঘাতে বব্জ্রাহত হয়ে হাতে পাওয়া বোর্ডিং কার্ডের উলটো দিকের আরবি হাতের লেখাগুলো দিকে তাকিয়ে এগুলাম এমিরটসের কাউন্টারের দিকে, যেখানে বেশ কিছু আগে চেক ইন করেছিলাম।

কাউন্টারের তরুণ আমার হাতের বোর্ডিং কাডের্র আরবি লেখা দেখেই “ওহ সিট,লেট মি অফলোড ইউর ব্যাগেজ কুইক। ইমিগ্রশেন ডিড নট ক্লিয়ার ইউর এক্সিট।” বলেই সামনের কমপিউটার খট মট করে, কিছু একটা লিখে জানাল যে, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমি যেন নীচ তলার এরাইভাল লাউঞ্জ থেকে আমার ব্যাগ কালেকশন করে ফিরে যাই রিয়াদে!

পেশাগত ও ব্যক্তিগত কারনে কমতো করিনি ভ্রমণ দেশে দেশে। এরকম পরিস্থিতিতে তো পড়িনি কখনো! তবে কী ভ্রমণবিষয়ক যাবতীয় আচানক সব সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার জন্যই জুটেছে কপালে আমার সৌদি এসাইনমেন্ট!

আচ্ছা প্রথম করণীয় কী এখন, আমার? হুম এক্ষুনি ফোন করা দরকার ফিলকে তারপর গিউসিকে। নিশ্চয় দুজনেই তারা পৌঁছে গেছে এর মধ্যে দুবাইয়ের হোটেলে, এই ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করতেই পাশ থেকে এলো মেয়েলি কণ্ঠ

সালামালাইকুম ড. সেলিম। ইউ সি, সাউদিয়া এয়ারলাইন্স নট এলাউয়িং আস টু চেক ইন ফর দুবাই।” ঘুরেই মুখোমুখি হই আপাদমস্তক দুই বোরকাবৃতার। জানি না তাদের কে, কোন জন? বা কার চেহারা কী রকম। একই রকম বোরকাবৃত আইডেন্টিকাল টুইনের মতো এই দুই বোন আমাদের সেলস টিমে কাজ করেন। বেশ ক’বারই অফিসের করিডোরে হয়েছে কথা তাদের সাথে। নামও জানি, আয়শা ও আমিরা। তবে এখন যে কে কথা বলল, নিশ্চিত নই। চেহারা চিনি আর না চিনি তাতে কিছু যায় আসে না। তিনজনই যে মোরা এই বিকেলে “যাত্রী একই তরণীর” বুঝতে পারছি! ওরে বাবা, না না। একই নৌকায় সহযাত্রী হলে খবর আছে। কারণ আমি তো তাদের মাহরাম না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধলর্ডস ও নানা জানা অজানা তথ্য