মরুজাহাজ উষ্ট্রের ঢিমে তালে গতিতে না, যাচ্ছে দিন মনে হচ্ছে ইদানিং অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রাপ্তির অশ্বশক্তিতে বলিয়ান হয়ে রেসের মাঠে ধবমান অশ্বগতিতে। হ্যাঁ ঐ যে দাম্মামে স্পেশাল মিটিং করে আসলাম যার ফলশ্রুতিতে এসেছিল ঘাড়ে অতিরিক্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ গোটা দুই তিন দায়িত্ব, তাতে দিনগুলোর অবস্থা হয়েছে এমনি ইদানীং!
এ একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে, না হয় এ মরুতে সময় কাটানোর জন্য আর কী ই বা করার আছে! আমাকে কেউ ওয়ার্কাহলিক ভাবে কী না? জানি না। ব্যাপার হচ্ছে অতিরিক্ত কাজ নিয়ে কখনোই কোন আপত্তি ছিল না আমার, নাই এখনো। দরকার যা আমার, তা হল নিজের মতো নিজে কাজ করার এবং প্রয়োজনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার স্বাধীনতা। একই কাজ একইভাবে করলে যে ভিন্ন ফলাফল আসে না, তা তো মহামতি আইনস্টাইন বলেই গেছেন বহু আগে। ফলে যে কোন কিছু নিয়েই নতুন কিছু করার চেষ্টায় থাকি। কপাল ভাল যে এ নিয়ে ফিলের মানে বসের সাথে মিলেছে বেশ। অথচ আবার এ নিয়েই এরই মধ্যে দেখছি লেগেছে বারকয়েক টুক টাক খটমট ইনডাইরেক্ট বস, রিজিওনাল কমার্শিয়াল হেড, এরিক ভ্যান ওপ্পেনের সাথে। কিন্তু তারই তুমুল আগ্রহেই তো আসা আমার, এই মরুতে। চেনা পরিচয় তার সাথে আমার অবশ্য খুব বেশিদিনের নয়। এছাড়া বাংলাদেশ যেহেতু ব্যবসার আকারের দিক থেকে খুবই নগণ্য সৌদি আরবের তুলনায়, তাই তখন তার সাথে তেমন যোগাযোগ না হলেও, এখানে আসার পর প্রায় সপ্তাহেই কথা হচ্ছে তার সাথে হরেক টেলি কনফারেন্সে। তাতে আগে যতোটা চিনেছিলাম, এখন বুঝতে পারছি তাকে তারচেয়ে ঢের ঢের বেশী। টের পাচ্ছি তাতে, আমাকে যে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছে ফিল, সেটি সে জানতে পারলে সহজভাবে নেবে না। দুই বসের মধ্যে শুরু হতে পারে ঠাণ্ডাযুদ্ধ এতে। মোটেও চাই না যা আমি ভুলেও। সে যাক, থাক তোলা তা আপাতত।
ব্যাপার হচ্ছে, মে মাস শেষ হয়েছে দিন দুয়েক হল। তিন মাসের যে হাজতি ভিসা আমার, সেটির মেয়াদ শেষ হবে এই মাসেই। মনে পড়েছিল এ কথা গতরাতে বিছানায় শুয়ে। তাতে শুরুতে ছেলেদের কাছে, বউ ও পরিবারের কাছে দ্রুতই ফিরে যাচ্ছি এ ভাবনায় মন, তা থৈ তা থৈ নেচে উঠার সাথে সাথেই, ভিসাবিষয়ক এক ভজঘটের কথা মনে পড়তেই, পড়েছিলাম হরিষে বিষাদে।
বিষয় হল, জুলাই মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত দুবাইতে যে মিড ইয়ার কনফারেন্স হবে তাতে আমার যোগ দেয়া অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমস্যা তো হল দুবাইয়ের ভিসাপ্রাপ্তি! এ বিষয়ে আমার যা জ্ঞান, বলছে তা আমায় যে ঐ ভিসা পেতে আমাকে ঢাকাস্থ আরব আমিরাতের দূতাবাসে ধন্না দিতে হবে। কয়দিন লাগবে যে সে ভিসা পেতে, তা ও তো জানি না? ধরে নিচ্ছি ঢাকা গিয়ে ভিসার জন্য দরখাস্ত করে, সেটা হাতে পাওয়ার পর তা নিয়ে দুবাইমুখি উড়াল দিতে লাগবে ৭ দিন। এই যদি হয় তবে জুনের একদম শেষে না, ঢাকায় যেতে হবে আমাকে এ মাসেরই তৃতীয় সপ্তাহের শেষে।
এদিকে ততোদিনে তো আমার নতুন করে সৌদি ভিসার জন্যও আবেদন করতে হবে। না হয়, দুবাই মিটিং শেষ করে ঢুকতে তো পারবো না সৌদিতে। তার মানে দুবাইয়ের মিটিং শেষ করে সৌদির দোরগোড়া থেকে ফের ঢাকায় ফিরে গিয়ে, সৌদি ভিসা নিয়ে অতঃপর দিতে হবে রিয়াদমুখী উড়াল । কিন্তু সেটি করতে গেলে একদিকে বাড়বে যেমন নিজের দৌড়াদৌড়ি হুড়াহুড়ির পরিমাণ, অন্যদিকে ফিল যে কষ্ট কন্ট্রোলের দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে, তার বদলে আমি নিজেই তো খরচ বাড়াচ্ছি। এ মনে হতেই ব্যাপারটার যে সমাধান এলো মাথায় তা হল–জুনের তৃতীয় সপ্তাহের শেষের বদলে, যেতে হবে ঢাকায় জুনের ১৪/১৫ তারিখে। ঢাকায় যাওয়ার পর প্রথম দিন সাতেকের মধ্যে আরব আমিরাত ভিসা পাওয়া গেলে দিতে হবে ধর্না সৌদি এম্বেসিতে অতপর । কিন্তু সৌদির ভিসা যে কতো দিনে পাওয়া যেতে পারে, তার তো ঠিক ঠিকানা নাই, জানি তা এ পর্যন্ত যা অভিজ্ঞতা, তা থেকে। এছাড়া জানিই না তো কোন ধরনের ভিসার জন্য গিউসি চেষ্টা করবে এবার। যদি ইকামা মানে এক্কেবারে ওয়ার্ক পারমিট করার মতো ভিসা হয়, তা হলে সময়তো বেশীও লাগতে পারে।
তদপুরি যদি জুনের মাঝামাঝি ঢাকায় গিয়ে ফিরে আসি এক্কেবারে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে, তাতে কাজ যতো জমবে হাতে, দিনরাত কাজ করেও তো কুলানো যাবে না। কেন না সে সময় একদিকে যেমন শুরু করতে হবে ২০১০ সালের কোম্পানির বাজেটের কাজ, অন্যদিকে ঠিক তখনি, করতে হবে টিমের মিড ইয়ার পারফর্মেন্স রিভিউ। মোটের উপর এই ভিসা ভজঘটে নিজের দৈনন্দিন কাজেরই যে মহাজট লাগবে, হয়ে যাবে তো অবস্থা তাতেই ত্রাহি মধুসূদন! আর অতিরিক্ত দায়িত্ব যা নিয়েছি, সেগুলোর কথা বাদই থাক। নাহ, এ তো করা যাবে না কোনমতেই!
ঘুমানোর জন্য গতরাতে বিছানায় গা এলিয়ে দেবার বেশ কিছুক্ষণ পর চোখে ঘুম আসছে আসছে করছিল যখন, তখনই এই ভিসা ভজঘটের চিন্তাটি মাথায় আসার পর, ঘুম যখন যাচ্ছিল হয়ে এক্কেবারে পগার পাড় ,তখনই এসছিল মাথায় এটির তৃতীয় সমাধানটি। তা হল দুবাই মিটিং এ, আমার একদম না যাওয়া। তার বদলে আমার টিমকে ঠিকঠাক মতো সেই মিটিংয়ের জন্য তৈরি করে দিয়ে, আমার প্রেজেন্টেশন মানে বক্তৃতা, আমার হয়ে ডেপুটি হিসেবে আহমেদ রাদিকে দিয়ে দিলেই হয় এই সমস্যার চমৎকার সামধান। তাতে এখানকার সবাই যখন দুবাই মীটিঙয়ে যাওয়ার জন্য প্লেন ধরবে, আমিও তাদের সহযাত্রী হয়ে দুবাই পর্যন্ত গিয়ে, ধরতে পারবো ওখান থেকে ঢাকাগামী প্লেন।
বিছানায় নির্ঘুম এপাশ ওপাশ করতে করতে গতরাতে এই যে তিনটা অপশন দাঁড় করালাম তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল মনে হচ্ছে এখনো এই শেষের অপশনটাই। তারপরের ভাল অপশন হচ্ছে ১৫ দিন আগেই চলে যাওয়া, যদিও তাতে বাজবে সব মিলিয়ে আমারই বারোটা। দুই ভিসার জন্য ১৫ /২০ দিনের মধ্যে দুইবার ঢাকা যাওয়া আসা করার পরিকল্পনাটা হল আমার কাছে, যাকে বলে এক্কেবারে নো গো অপশন।
কিন্তু তা তো আর নিজে নিজে ঠিক করলেই চলবে না । বসের মতামত তো হল যারে বলে “অলওয়েজ রাইট”, তা। হোক না ফিল যতোই দিলখোলা জাতের বস, ব্যাপারটা তাকে জানিয়ে তার মতামত ও তো শোনা দরকার। যদি মতামত সে নাও দিতে চায়, তারপরও ব্যাপারটা তার তো জানা থাকতে হবে আগেভাগেই। সেজন্যই সকাল থেকে অপেক্ষায় আছি। এরই মধ্যে দুইবার উঁকি মেরে এসেছি তার রুমে। কিন্তু ধোঁয়াহীন সে রুম করছে খাঁ খাঁ। অবশ্য ফিলের উপস্থিতি জানার জন্য তার রুম পর্যন্ত যেতে হয় না, রুমের দরজার ফাঁক দিয়ে যে ধোঁয়া আসে করিডোরে, সেটিই নিশ্চিত করে রুমে তার উপস্থিতি। এরই মধ্যে বসের ব্যাপারে আরকেটা জিনিষ যা লক্ষ করেছি, তা হল মাঝে মাঝেই সে হাওয়া হয়ে যায়, কাউকে কিছু না বলেই। বিশেষত তার সেক্রেটারি মানে সারাক্ষণ রামগুরুড়ের ছানার মতো মুখ করে বসে থাকা মহসিন, কখনই পারে না দিতে তার হদিস। তবে এরই মধ্যে এও জেনে গেছি যে, যার সাথে তার কাজ থাকে, ফিল তাকে ঠিকই জানিয়ে রাখে আগেভাগেই। যেহেতু আসেনি এখনো সে, কে জানে দাম্মাম বা জেদ্দার অফিসে গেছে কী না আজ?
এই ভেবে তৃতীয়বারের মতো নিজরুম বেরিয়ে ফের ফিলের রুমের দিকে এগুতেই, পৃথিবীর যাবতীয় বিতৃষ্ণাকে পোস্টার বানিয়ে মুখে তা লেপ্টে লাগিয়ে রাখা, মহসিনের সাথে চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞেস করলাম, বস এসেছে কী?
উত্তরে মুখে লেপ্টে থাকা যাবতীয় বিতৃষ্ণার ফাঁক গলে যখন “ইয়েস স্যার” এই শব্দদুটো বেরুলো ভাবলাম, আরে আমি যে দুই দুইবার খুঁজে গেলাম তা তো তুমি দেখেছোই। অতএব ফিল আসা মাত্রইতো জানাতে পারতে আগ বাড়িয়ে । কিম্বা এখনও আমি জিজ্ঞেস করার আগেই তো বলতে পারতে তা। নাহ বুঝতে পারছি, কেন ফিল তার সেক্রেটারি এই মহসিন হায়দারাবাদিকে কিছুই বলে না! এসব ভাবতে ভাবতে এসময় ফিলের রুমে নক করতেই কানে এল দরাজ কণ্ঠ-“গেট ইন প্লিজ” তাতে দরজা ঠেলে ভেতরে মাথা ঢোকাতেই দেখি গলদঘর্ম হয়ে সুটেডবুটেড ফিল গলায় ঝুলতে থাকা টাইটির নট না খুলে সেটিকে গলাতে রেখেই নটটিকে যথেষ্ট রকম ঢিলা করে মাথার উপর দিয়ে সেটিকে বের করে রুমের বা দিকের কোনায় থাকা স্ট্যান্ড, যেটিতে এতদিন ঐটিকে ঝুলে থাকতে দেখেছি সেখানে রাখতে রাখতে বলল– “আর বলো না। সুইস এম্বেসেডরের সাথে ব্রেকফাস্ট মিটিং ছিল। তাই এইসব ছাইপাশ চড়াতে হয়েছিল। বলতে বলতে গা থেকে স্যুটের জ্যাকেটটিও একরাশ বিরক্তি নিয়ে খুলে সেটিকেও দ্রুত সেই স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে দিতে পারার বিমলানন্দে, একমুখ হাসিতে তড়িঘড়ি পকেট থেকে তার ফিলিপ মরিস সিগারেটের প্যাকেট বের করে তা থেকে একটা সিগারেট মুখে নিয়ে সেটির মুখাগ্নি করে টেবিলের উপর দিয়ে সেটি এদিকে ঠেলে দিতে দিতে বলল– “ঘটনা কী? খুব গুরুতর নাকি? মোর সিরিয়াস দি প্রব্লেম মিন্স মোর ফান, ইজিন্ট ইট? বাট আই এম সিউর ইউ হ্যাভ অপশনস। ঝেড়ে দাও ঝটপট ঘটনা কী? আর সমাধানই তার কী কী ভেবেছো?”
তাতে চেয়ারে বসতে বসতে ফিলের ঠেলে দেয়া প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে, ধীরে সুস্থে তা টানতে টানতে দুবাই মিটিংয়ে যাওয়ার নিমিত্তে ভিসাবিষয়ক যে ভজঘট আছে আমার, তা বয়ান করে, সেই ভজঘটের যে তিনটা সমাধান দাঁড় করিয়েছিলাম একে একে সেগুলো বলার সময়, প্রতিটিরই সাথে যাকে আমাদের অফিসিয়াল ভাষায় বলি আমরা আপসাইড ডাউনসাইড বা সুবিধা অসুবিধা, তা বলে ঠোঁটের সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে ওপাশে ধোঁয়ার আড়ালে থাকা ফিলের দিকে তাকাতেই এলো উত্তর, “এন্ড আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ হেভ চুজেন দি লাস্ট অপশন! মানে তুমি দুবাই মিটিং স্কিপ করতে চাও, তাইতো? কিন্তু তা তো হবে না! ওটা তো হল আমার জন্য এক্কেবারে নো গো অপশন। শোন, তোমাকে আগেও বলেছি, এই পর্যন্ত যতোটা বুঝেছি এরাবিয়ানদের, তাতে জানি এরা প্রচণ্ড রকমের ভিস্যুয়াল জাতি। মানে চোখে তারা যা দেখতে পায়, সেটাই তাদের কাছে একমাত্র না হলেও, অতি বড় সত্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক