দেশ হতে দেশান্তরে

পুংভোগ্যা বসুন্ধরা

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৫ জুন, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

দাম্মাম থেকে রিয়াদগামী ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্সের আজকের এই শেষ ফ্লাইটে যাচ্ছি শুধু আমি ও ফিল। তবে আমরা দুজন একই সাথে একই সময়ে কাটা টিকিটে, প্রায় একই সময়ে চেক ইন করলেও, হয়েছে অবস্থান দুজনের এই ফ্লাইটের দুই প্রান্তে! অথচ আসার সময় ছিলাম দু জনে পাশাপাশি সিটে !

ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলেও, সেই তখন থেকেই মনের ভেতর খোঁচাখুঁচি করছিল ওটা দুই কারণে, যার মধ্যে একটি হল ফিলের মন্তব্য। রিয়াদ থেকে আসার সময় ফিল তার নিজের ও আমার চেক ইন করেছিল চেক ইন কাউণ্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে। আজ ফেরার সময় রিয়াদ এয়ারপোর্টে থেকে ঢের ঢের আধুনিক ও উন্নত দাম্মাম এয়ারপোর্টের নানান জায়গায় যাত্রীদের জন্য সেলফ চেক ইন কিয়স্ক বসানো দেখতে পেয়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে চেক ইন করার ঝামেলায় না গিয়ে ফিল ঐ কিয়স্ক মারফত নিজ নিজ চেক ইন করার প্রস্তাব দিতেই লুফে নিয়েছিলাম তা। ভেবেছিলাম এই সুযোগে একটা নতুন জিনিষ শেখাও হবে। সে মোতাবেক ফিল সেই মেশিনে চেক ইন করে তার বোর্ডিং কার্ড হাতে পেতেই, নিজে চেক ইন করতে গিয়ে মেশিনের হুকুম মোতাবেক টিকিটের পি এন আর নম্বর দেয়ার পর, তাতে আমার নাম ভেসে উঠতে দেখে মনে মনে শিশুসুলভ আনন্দে মন তাইরে নাইরে না করে উঠার সাথে ধাক্কাও খেয়েছিলাম একটা।

কারণ, আমার নামের ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর, মেশিন জানতে চেয়েছিল অধমের জাতীয়তা! সিট বরাদ্দের সময় জাতের প্রশ্ন কেন তুললো মেশিন, বুঝতে পারছিলাম না? এছাড়া এ ভ্রম তো আমার কোন আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নয় যে, দেখাতে হবে পাসপোর্ট যা দেখে বোঝা যায় কে কোন জাত বা বেজাতের। আন্তর্জাতিক ভ্রমণে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ নানান গুরুতর কারণে জাতবেজাতের খবর নিলেও, এ তো হলো অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ। কিন্তু কী আর করা? মেশিনকে তো এখনো অতোসব প্রশ্ন করা যায় না, তাই প্রশ্ন মোতাবেক তাকে আমার জাতীয়তা জানানোর পর, যে বোর্ডিং কার্ড সে হস্তান্তর করলো, তা হাতে নিতেই বস সিট নম্বর জানতে চাইলে তা তাকে জানাতেই তুমুল বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে বলে উঠেছিল ফিল– “সিট! এগেইন দ্যাট ব্লাডি রেইসিজম!” ফিলের এই মন্তব্যের জেরে বুঝে গিয়েছিলাম সাথে সাথেই, আমাদের বেরাদরণে ইসলাম সৌদিরা বাংলাদেশীদের যে বিশেষ ঘৃণার চোখে দেখে, সেই ঘৃণাটি তারা এই মেশিনের ভেতরেও গেঁথে দিয়েছে সযত্নে। ফলে ব্রিটিশ ফিলের পাশে আমি বাংলাদেশির জন্য সিট নির্ধারণ করেনি মেশিন! হুম! মাস দুয়েক আগে হলেও এরকম পরিস্থিতিতে চামড়া ফুটতো অসংখ্য ভিমরুলের হুল। সাথে মেজাজও চড়ে যেত তুমুল। তবে এ ঘটনায় সামান্য হুলের খোঁচা লাগলেও মেজাজের উত্তাপের পারদ ওঠেনি উপরে তেমন। এমন কি বিমান আকাশমুখী উড়াল দেবার আগেও যখন আর কেউ এসে পাশে বসলো না, তাতে এরা যে বাংলাদেশীদের অস্পৃশ্য নমশূদ্র মনে করে সে কথা ফের মনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে, নিজেকে বরং এই বলে সান্তনা দিয়েছিলাম যে, যাহ টিকিট আমি একটা কাটলেও, সিট পেয়েছি বসার তিন তিনটা! মানে হচ্ছে এর যে অতপ্র চামড়া আমরা মোটা হতে শুরু করেছে।

সে যাক, তোলা থাক আপাতত ঐসব আলাপ। বড় ব্যাপার হলো গত দুই রাত দুই দিন, হাফ মুন বের ঐ রিসোর্টে সৌদিদের কথিত এই মিসকিন, একদিকে শেখজীবনের আঁচ যেমন পেয়েছি, তেমনি নিজেদের মধ্যকার অনেকটাই খোলামেলা আলোচনা থেকে কোম্পানির যে সমস্ত বিষয় নিয়ে খটকা ছিল এতদিন, পেয়েছি সে সব ব্যাপারে পুরো না হলেও অনেকটাই স্বচ্ছ ধারণা। তদুপরি উপরি হিসেবে সামান্য হলেও পেয়েছি আঁচ সৌদি জীবনযাত্রার একদম অন্দর মহলের না হলেও তারই কাছাকাছি কিছুটা। কারণ রিসোর্টে বেশ অনেকগুলো সৌদি পরিবারের পেয়েছিলাম দেখা। তাতে তাদের চলাফেরা, আচার আচরণ দেখে যতোটাই পেরেছিলাম তা অনুভব করতে, পেরেছিলাম তা প্রথমবারের মত। অবশ্য সবচেয়ে বেশী যা চাক্ষুষ করেছিলাম, ছিল তা তাদের সৈকতবিষয়ক আচার আচরণ।

এই যেমন মনে পড়লো এখন, গত দুপুরে আমাদের মিটিংয়ের যে বীচ ব্রেক হয়েছিল, মানে সবাইকে সৈকতস্নানের সুযোগ করে দেবার যে বিরতি দেয়া হয়েছিল, সে সময় মিটিংরুম থেকে বেরুতে বেরুতে পাশে হাঁটা ফিল ফিস ফিস করে হাসতে হাসতে বলেছিল, “ ইউ নো, জাম্পিং মেন এন্ড কিডস ওয়াচট বাই পেঙ্‌গুইনস মেকস এ সৌদি বীচ!”

ইতোমধ্যেই ফিলের নানান কোডওয়ার্ড আর সূক্ষ্ম ব্রিটিশ রসিকতার সাথে মোটামুটি পরিচয় হয়ে যাওয়াতে ঐ কথাটির মর্মার্থ অনেকটাই ধরতে পারলেও এ বিষয়ে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হতেই কিছুটা তব্দাই খেয়েছিলাম। হ্যাঁ বীচে গিয়ে যখন দেখেছিলাম রিসোর্টের এই প্রাইভেট সৈকতের স্থানে স্থানে আপাদমস্তক কালো আবায়ায় ঢেকে নানান বয়সী নারীরা স্থানুর মতো বসে থেকে তাকিয়ে আছেন তীর্থের কাকের মতন হাফ মুন বে এর টল টলে জলে, যেখানে নানান ধরনের জলক্রীড়ায় তুমুল মত্ত তাদের পরিবারের নানান বয়সী পুরুষ সদস্যরা, তাতে আবায়ামোড়া ঐ নারীকূলের নিয়ে ভেবেছিলাম আচ্ছা শুধু বালিতেই বসে থাকাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাদের , তবে তাগো বাড়ির ধারের মরুভূমিই তো ছিল!

নাহ, খুব দেরী হয়নি আবায়াআবৃতাদের ঐ সৈকতাসীন হয়ে থাকার মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গমে। সৈকতে পা দিয়ে নজরে এসেছিল নাক বরাবর গলা পানিতে নেমে গোটা হাফ মুন মে উথাল পাতাল করে একজনের সাঁতরানোর তুমুল কোশেশ করার ব্যাপারটা। অতপর সহসাই সে তাতে ইস্তফা দিয়ে জল ঠেলে ঠেলে সৈকতমুখী হাঁটা ধরতেই, ক্রমশই আধপাকা চুল দাড়ি সম্বলিত সৌদির লোমশ থলথলে বিশাল বপু নজরে আসলেও, যেই না বিশালাকায় তার নধর উদরটি নজরে এলো, তাতে ঢাকাই সিনেমার পরান বাবুর কথা মনে পড়েছিল চকিতে। অতপর তীরে এসে উনি, সেই পরানিয় ভঙ্গিতেই হাঁসফাঁস করতে করতে ধপাস করে ভূমিস্মাৎ হতেই, দূরে বসে থাকা তিন আবায়ার একজন টাওয়েল, আরেকজন পানির ও তৃতীয়জন কোমল পানিয়ের বোতল নিয়ে তীরবেগে তার দিকে দৌড় শুরু করতেই মনে হয়েছিল, নিশ্চয় ঐ তিনের একজন তার স্ত্রী আর বাকী দুজন কন্যা? সাথে সাথে মনের বিটকেলে দ্বিতীয়জন বলে উঠেছিল, কেন তিনজনই তার স্ত্রী হলে তোমার আপত্তি আছে নাকি?

মনের দ্বিতীয়জনের এই বিটকেলেপনা উপেক্ষা করে চোখ ঠেকেছিল ততোক্ষণে বিশালবপুধারির স্নানের পোশাকে! ভাবছিলাম, এ লোক কি ৪ এক্সেল সাইজ না পেয়ে ডাবল এঙেল আণ্ডারওয়ার পরে নেমেছিল নাকি? রিয়াদে তো পুরুষদেরও হাফপ্যান্ট না, থ্রি কোয়ার্টার বারমুডা পরারও নিয়ম নাই ।

তখনি মনে পড়েছিল, দাহরানে তৈলক্ষেত্র আবিস্কার হবার পর থেকেই এ এলাকার শহর না শুধু এখানকার নিয়ম কানুনও সব গড়ে উঠেছিল আমেরিকান তেল কোম্পানির হাত ধরে, আছে যা বলবৎ আরামকোর ধরে, এখনো।

আচ্ছা সেটিই যদি হবে, তবে এখানে নারীদের সমুদ্রস্নানে কোন বিধিনিষেধ থাকার তো কথা নয়? নারীরা কেন তাহলে ফিলের ভাষায় আবায়ামুড়িয়ে ওয়াচিং পেঙ্গুইন হয়ে বসে আছে?

এ প্রশ্নের পিঠাপিঠিই উত্তর এসেছিল মনে, আরে! জানো না? এ তো হলো পুংভোগ্যা বসুন্ধরা। অর্থাৎ এখানে বীর হবার জন্য কষ্টের ঘাম ঝরানো বা সাহসের ঝুঁকি নেবার প্রয়োজন নাই। এখানে কর্তৃপক্ষপ্রদত্ত আইনের পুরো সুবিধা পুরুষেরা নিলেও, নারীর ব্যাপারে পুরুষদের সিদ্ধান্ত নৈব নৈব চ!

এ মুহূর্তে সেই সৈকতকাহিনীর সাথে আরামকো আইনের কথা মনে হতেই তারই লেজে লেজে মনে পড়লো গতকাল গিউসির মুখে শোনা এখানকার গরম বিষয় সাউদিয়াইজেশনের ব্যাপারে আরামকোর ভূমিকার কথাও।

সৌদিতে পা দিয়ে প্রথম ঐ সাউদিয়াইজেশন শব্দটি শুনেছিলাম যখন, ভেবেছিলাম এ আবার কী বস্তু? সৌদির কি পুরোপুরি সৌদি হওয়া এখনো বাকী আছে নাকি? আর কী কী করলে সৌদি, সৌদি হবে তবে?

তারপর নানান সময়ে নানান জনের কথাবার্তায় বুঝেছিলাম যা, একদম ফকফকা হয়েছিল তা গতকালকের গিউসির বিশদ আলোচনায়। তা হলো, সৌদিরাজ বেশ কিছুকাল ধরেই একদিকে যেমন তার নাগরিকদের কাজ করার ব্যাপারে জোর তাগিদ দিচ্ছে, তেমনি তার চেয়ে কঠিন চাপ দিচ্ছে সে নানান কোম্পানিকে যাতে তারা সৌদিদের নিয়োগ দেয়। কাজ তারা পারুক না পারুক বা করুক না করুক, বহুকাল ধরে এ দেশের নানান কোম্পানি চলছিল যেসব বিপুলসংখক অসৌদিদের শ্রমে ঘামে, সে সব কোম্পানির জনবল অবশ্যই ৮০ ভাগ সৌদি হতে হবে অচিরেই! এটাই হলো এখানকার রাজএলান!

তো এ নিয়ে কিছুকাল আগে সৌদির উজিরে আদম মানে ম্যানপাওয়ার মিনিস্টার, বড় বড় বিদেশী কোম্পানির মানবসম্পদ প্রধানদের নিয়ে এক সভা ডেকে তাদের মতামত জানতে চাইলে, নানান কোম্পানির বাঘা বাঘা বিদেশী মানবসম্পদ প্রধানেরা,“মহামহিম মহাত্মন এ আপনার অত্যন্ত ভাল সিদ্ধান্ত”, “যুগোপোযোগী সিদ্ধান্ত”, “যুগান্তকারী আইডিয়া” উজিরে আদমকে তুমুল তৈলমর্দন করলেও, সর্বশেষ বক্তা আরামকোর আম্রিকান মানবসম্পদ প্রধান বলেছিলেন-“তার মানে আপনি বলছেন যে, আমার কোম্পানিতে যদি একশ বানরের পদ খালি হয়, আর সেই বানর যেহেতু এখানে নাই, তবে এখানে যে উট পাওয়া যায় তারই একশ আমাকে নিয়োগ দিতে হবে?

আচ্ছা তা না হয় দিলাম। উটকে বানরের কাজ শিখাতেও আপ্রান চেষ্টা করলাম । তারপরও কিন্তু উট বানরের কাজ যেহেতু করতে পারবে না, তখন আমি যখন উটকে উটের বেতন দিতে যাবো, সে সময় তারা ও আপনারা বলবেন পদটা তো বানরদের, অতএব সেই বেতনই দিতে হবে উটকে। মহামান্য উজির মহোদয় সাউদিয়াজেশন বলতে আপনারা যা বলছেন, তা থেকে আমি এটাই বুঝেছি।”

ঐ সভায় উপস্থিত গিউসি নিজে কী বলেছিল, বা আদৌ কিছু বলার সুযোগ পেয়েছিল কী না সে, তা না বললেও তার মুখে আরামকোর এইচ আর হেডের সেই চমৎকার চিত্রকল্পময় বক্তৃতার গল্পে প্রাণখুলে হেসে উঠার উপক্রম হয়েছিল আমার, সামলেছিলাম যা বহুকষ্টে। কারণ মিটিংএ তো এরইমধ্যে আমার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা সৌদি সহকর্মী, খলিলও উপস্থিত।

মনে হয় যদিও গিউসি সেই ঘটনা বর্ণনা করেছিল আরামকোর এইচ আর হেডের বরাতে, তারপরও খলিলের উপস্থিতিতে পড়েছিল সেও অস্বস্তিতে। ফলে বক্তব্যের উপসংহারে জোর দিয়ে বলেছিল আরামকোর আপত্তির কারণে আপাতত ৮০ ভাগ সৌদিআইজেশনের কঠিন টার্গেট ঘাড়ে না চাপলেও, আমরা সৌদি ট্যালেন্ট রিক্রুটমেন্ট ও ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতবদ্ধ হতে চাই।

এ বলে সে প্রথমে ফিল ও একে একে আমাদের সবার দিকে তাকালে, যদিও জনিনা আমাদের সকলের ভাষাতেই মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ কি না, তবে সকলেই যে মৌন ছিলাম গতকাল এ বিষয়ে, নিশ্চিত করতে পারি তা অবশ্যই।

লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি কবে বাবার স্বপ্নের মতোন বড়ো হবো
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর