‘উধূলিতে’ পথ হারিয়ে!
ভাংগা পা যেমন নাকি খাদে পড়ে বারবার, তেমনি গতরাতের পর এইমাত্র মানে, আজকের এই উধূলির কালে দিককানা আমি মনে হচ্ছে রিয়াদ নগরের এই প্রান্তের পথে ফের পথ হারাইলাম। আমাদের দেশে গ্রামের পথে পথে ঠিক এ সময়টায় পায়ের খুড়ের ঘায়ে ধুলো উড়িয়ে উড়িয়ে গরুরা বাড়ি ফেরে বলে যেহেতু এ সময়টার আরেক নাম গোধূলি, সে নিয়ম মেনে এই মরুতে মরুর জাহাজনামখ্যাত উটের সম্মানে এটিকে “উধূলি” তো বলাই যায়।
নাহ, ছাল বাকল উঠা হালকা বিটুমিন মাখা নির্জন এই রাস্তাটা আমার আবাসস্থল গ্রানাডা কমপাউন্ডে যাওয়ার পথ বলে তো মনে হচ্ছে না মোটেও। রাস্তার পাশের কাঁটা গাছের ঝোপ, ইতি উতি দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছ, আর এখানে সেখানে আয়েশি ভঙ্গিতে পড়ে থাকা শহুরে আবর্জনা, মানে প্লাস্টিক, পলিথিন, কার্ডবোর্ডের তৈরি প্যাকেজ সামগ্রী থেকে শুরু করে, বাড়ি ভাঙ্গা বা মেরামতজনিত কারণে উৎপন্ন ভাঙা ইট সিমেন্ট বালু সুরকি পড়ে থাকতে দেখে, এটিকে ভাগাড়ই মনে হচ্ছে। এরকম কিছু তো ছিল না গ্রানাডা কমপাউন্ডের অভিজাত এলাকায়! অতএব গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে যাকে বলে গজেন্দ্র গমনে এগুতে এগুতে ভাবছি, দেবো নাকি ফোন এই মরুতে এখন পর্যন্ত যে আমার মুশকিল আসান, সেই সাইফকে, দিয়েছিলাম যেমন গত রাতে? সমস্যা হচ্ছে তাকে ফোন যে করবো, ঠিকানা বলবো কী যে আছি কোথায়?
ফুললি লোডেড টয়োটা এভালন জাতের এই রাজকীয় সিডানে আমার মতো দিককানার জন্য যা থাকা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, সেই জীপিআরএসই নাই এতে। নাহ, অচিরেই লাগিয়ে নিতে হবে ওটা। না হয় বিশাল এই রিয়াদ নগরীতে অহরহই পথ হারিয়ে যে নাকাল অবস্থা হবে আমার, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই কোনো।
আচ্ছা যাচ্ছি যদিও গজেন্দ্রগমনে, তারপরও যাচ্ছি তো সামনেই। তা কি ঠিক হচ্ছে? কোন আশার ছলনে যাচ্ছি এই ভর সন্ধ্যায় কোন কুহুকের দিকে? এমন নির্জন রাস্তায় কোন মরুদস্যুর পাল্লায় যদি পড়ি? তবে কি গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো চলে পেছনের দিকেই, যেখান থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম এই রাস্তায়?
বাহ, কপাল তো ভাল মনে হচ্ছে। ঐ তো সামনের দিক থেকে দেখছি ধুলো উড়িয়ে আসছে একটা লক্কড় ঝক্কর মার্কা সাদা পিকআপ। দেখি ঐ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে পথের দিশা নেয়া যায় কি না।
অতপর গাড়ি থামিয়ে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘন ঘন হাত নেড়ে সেই গাড়ির চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই অচিরেই থামলো সে আমারই গাড়ির পাশে।
পিকআপের ড্রাইভিংসিটে বসে থাকা সাদা তোব পরা, আমারই গাত্রবর্ণের গাব্দা গোব্দা লোকটি জানালার কাচ নামিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতেই, এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে গ্রানাডা কমপাউন্ডের আমার বাংলোর চাবির সাথে লাগানো কমপাউন্ডের ঠিকানাসম্বলিত স্টিলের পাতটি দেখিয়ে হাত পা নেড়ে বোঝাতে চেষ্টা করলাম গন্তব্য আমার।
আমার এ প্রাণপণ মূকাভিনয়ের উত্তরে মোটেও আশা করিনি যা, ঘটলো তাই এই উধূলিতে! আরবি টোনের ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলেও পরিষ্কার ইংরেজিতে জানালেন উনি যে ভুল পথে এসেছি! বোধগম্য এই ইংরেজি কানে আসতেই বড়ই সৌভাগ্যবান মনে হল নিজেকে। হাসিমুখে বললাম ধীরে সুস্থে যে, কোনই সন্দেহ নাই তাতে। এজন্যইতো নিয়েছি তার শরণ।
হাতের ইশারায় এসময় গাড়ি ঘুরিয়ে তার পিছু পিছু এগুবার ইঙ্গিতের সাথে বলল মুখে “কাম, কাম।” তাতে অনভস্থ্য ও অপটু হাতে তাড়াহুড়ো করে নিজ গাড়িটি সামনের দিকে এগিয়ে কোনমতে সেটিকে ঘুরিয়ে পিকআপের ঠিক পেছনে আনতে পারায়, বড়ই সন্তুষ্ট মনে নিজেকে নিজেই চাপড়ে দিলাম পিঠ মনে মনে।
অতঃপর পিকাপভ্যানের এই মুশকিল আসানকারী যে কি সৌদি, নাকি সাইফের মতোই সুদানি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে না পারায়, দুরু দুরু বক্ষে তার পিছু পিছু মিনিট দুয়েক গাড়ি চালাতেই, মিলল দেখা হাইওয়ের, যা থেকে কিছুক্ষণ আগে দিকভ্রান্ত এই অধম বা দিকে মোড় নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম ঐ নির্জন রাস্তায়।
এখানেএসে পৌছে সামনের পিকআপ থেমে যেতেই, থামতে হল আমাকেও।ততোক্ষণে পিকআপের ড্রাইভিং সিট পার্শ্ববর্তি জানালা গলে ড্রাইভারের হৃষ্ট পুষ্ট হাত বেরিয়ে দেখছি কি যেন নির্দেশনা দিচ্ছে!
ফেইলিউর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস, কথাটি তুমুল প্রচলিত থাকলেও, মানে তা ক’জন? তবে হ্যাঁ একই ভুল বারবার করলে সাকসেসের আশা যে সুদুর পরাহত মানি তা, এ অধম বিলক্ষন। ফলে এই সন্ধ্যায় দ্বিতীয়বার ভুল করা যাবে না মেনে, দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে পিক আপের জানালার পাশে গিয়ে হাজির হতেই, বোধগম্য ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে যা শুনলাম ফের, তাতে বুঝলাম একটু আগে এখানে এসে এই বা দিকে মোড় নিয়ে পাশ রাস্তায় ঢুকে পড়েই ভুল করেছিলাম। অথচ উচিৎ ছিল হাইওয়ে ধরেই এগিয়ে যাওয়া যেটি সামনে ডানে মোড় নিয়েছে নিজেই। আর এইক্ষণে পিকআপের লক্ষ রিয়াদ শহর, মানে যেদিক থেকে এসেছিলাম আমি অফিস শেষে সেদিকে। ফলে এই মোড় থেকেই ইউ টার্ন করে চলে যাবে সে গন্তব্যে। তার কথা শুনে, এরই মধ্যে যে কটা প্রচলিত আরবি শব্দ রপ্ত করেছি তার একটি “শোকারন” বলে জানালা গলে বেরিয়া থাকা হৃষ্ট পুষ্ট হাতটির সাথে হাত মিলিয়ে এলাম ফিরে নিজের ড্রাইভিং সিটে। অতপর নির্দেশ মোতাবেক হাইওয়ে ধরে মিনিট পাঁচেক এগুতেই পাওয়া গেল বা দিকের সেই পাশ রাস্তাটি যেটি কিনা শেষ হয়েছে গিয়ে গ্রানাডা কমপাউন্ডের তুমুল নিরাপত্তার ঘোরটোপে। যার মানে হচ্ছে মোটামুটি তীরে এসেই তরি ডোবাতে বসেছিলাম। তবে ২৪ ঘণ্টা আগে মানে, গত সন্ধ্যায় এই রিয়াদ নগরের কোন পথে যে এ পথিক পথ হারাইয়া হাবুডুবু খাইয়াছিল মরুর মরীচিকায়, তা এখনো ঠাহর করিয়া উঠিতে পারি নাই।
ব্যাপার হচ্ছে গতকাল, জর্ডান সুন্দরী আত্মবিশ্বাসী নাদিয়ার কথায় না মজলেও অনেকটা নিরুপায় হয়ে আগুনে ঝাপ দিয়ে কোন সমস্যায় না পড়লেও, সন্ধ্যায় ঠিকই জলন্ত আগুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে পড়েছিলাম।
মোতাওয়া, মানে শরিয়াহ পুলিশের শেন্য দৃষ্টি এড়িয়ে এ শহরে মাহরাম ছাড়া, শুধু গাড়ির ড্রাইভার নিয়ে নারীরা হয়তো ঘোরাফেরা করতে পারে। আর না হয় নাদিয়া প্রতিদিন কিভাবে বের হয় কাজে? কিন্তু ড্রাইভার ছাড়া গাড়িতে যদি তৃতীয় কোন বেগানা পুরুষ থাকে, তাকে নিশ্চয় মোতাওয়া ছাড় দেবে না। এ আশংকায় রাস্তা ঘাট চেনা নয় বলে, নিজে গাড়ি চালিয়ে ফিল্ডওয়ার্কে নাদিয়ার অনুগমন করার ঝুঁকি না নিয়ে যখন ট্যাক্সিক্যাবে যাবো ঠিক করেছিলাম, তাতে ঘোরতর আপত্তি করেছিল নাদিয়া ।
বক্তব্য ছিল এ দেহে তার থাকিতে প্রাণ, রিয়াদ শহরের কোন মোতওয়ার সাধ্য নাই তারই বিগ বসের কোন ক্ষতি করার। তদুপরি যে রাস্তায় গন্তব্য আমাদের, সে এলাকার তাবৎ পুলিশ আর মোতাওয়া নাকি নাদিয়া, না বলা উচিৎ তার গাড়িটিকে খুব ভাল চেনে ।
নাদিয়ার এহেন জেদের মুখে নাচার এ অধম দুরু দুরু বক্ষে ইয়া নফসি ইয়া নফসি জপতে জপতে উঠে পড়েছিল গতকাল সকালে, তারই গাড়িতে অবশেষে।
কথা ঠিকই ছিল নাদিয়ার। কোনই সমস্যায় পড়িনি অফিস থেকে মিনিট ২০/২৫ দূরত্বে নাদিয়া নির্ধারিত সেই হাসপাতালে ফিল্ডওয়ার্ক করার নিমিত্তে তার গাড়িতে আসা যাওয়া করতে গিয়ে। আর সৌদি আরবে আসার পর আমার এই প্রথম ফিল্ডওয়াকের্র অভিজ্ঞতাও ছিল ভাল। একদিন ফিল্ডওয়ার্ক করেই সবকিছু বুঝে যাবার মতো মুরোদ না থাকলেও, সুনির্দিষ্ট একটা বিষয় নিয়ে যে অচিরেই কাজ করতে হবে, বুঝে গিয়েছিলাম তা।
দেখতে পেয়েছিলাম নাদিয়ার ঘাড়ে একই সাথে রোলেক্স আর ক্যাসিও ঘড়ি বিক্রি করার দায়িত্ব চেপেছে, যা নাকি বিপণনবেদের একদম নীতিবিরুদ্ধ। ফলে স্বভাবতই নাদিয়া ক্যাসিও বিক্রি করার ব্যাপারে তুমুল সফল হলেও, রোলেক্স ঘড়িতে পুরোপুরি ব্যর্থ। তবে এ ব্যর্থতার দায় অবশ্যই নাদিয়ার নয়, বরং এ হলো মূলত আমারই ডিপার্টমেন্টের ভুল নীতি নির্ধারনের ফল; যেটি অচিরেই শোধারানো দরকার ।
এছাড়া নাদিয়ার সাথে গাড়িতে আসা যাওয়ার সময় পেশাগত কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে যে সব টুকটাক কথা হয়েছে তা থেকে, এই শহরে বসবাস করা বিদেশীদের জীবনযাত্রা বিষয়ে এমন একটা ব্যাপার জেনেছি, ছিল যা আমার ধারনারও অতীত।
বিষয়টি হচ্ছে, যদিও কোম্পানিতে নাদিয়া পদটির পোশাকি নাম হল “মেডিক্যাল এডুকেটর” কাজ হল তার আসলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের। এই পদে কাজের যা ধরণ, তাতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ করে, দুপুর থেকে বিকেল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরে থাকার সুবিধা আছে, অথচ সে সেই সুবিধাটুকু ভোগ করতে পারছে না নাদিয়া। প্রতিদিন সকাল নটার দিকে সে কাজে বেরিয়ে, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত নটা দশটা বেজে যায় তার। একই পদে কাজ করা তার পুরুষ সহকর্মীরা দুপুরে বাড়ি ফিরে গেলেও, দুপুরটা সে কাটায় অফিস বসে থেকেই ।
এর কারণ জানতে চাইতেই, জানায় সে যা তার দন্ত চিকিৎসক স্বামীর হল ৯টা পাঁচটা ডিউটি। স্বামীর অবর্তমানে দুপুর বেলা একাকী বাসায় থাকে না, কারণ ঐ সময়টা বিদেশী অধ্যুষিত তার এলাকা মোটামুটি পুরুষশূন্য থাকায়, স্থানীয় সৌদি তরুণেরা বোরকা আচ্ছাদিত হয়ে নানান জনের ঘরের দরজায় টোকা দেয়ার পর, ভুল করে যারাই দরজা খুলে দিয়েছে, তাতে নানান অঘটন ঘটেছে!
এ কথা শোনার পর আপাত নিরাপদ এই রিয়াদ, বিদেশীদের জন্য আসলেই যে কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ সে ব্যাপারে একটা নতুন বোধি লাভ করলেও, তাকে কোন সমাধান দিতে পারিনি বলে মনোবেদনায় ভুগেছি যেমন, তেমনি ভেবেছি আপাত সাহসী আরব নারী নাদিয়ারই যদি এই অবস্থা হয় এই শহরে, তবে আমাদের মতো দেশের যে নারীরা আছেন এই শহরে নানান ভূমিকায়, অবস্থাটা তাদের কী হতে পারে?
সে যাক বেগানা পুরুষ আমি তুমুল ঝুঁকি নিয়ে নাদিয়ার সঙ্গী হয়ে তার গাড়িতে আসা যাওয়া করতে গিয়ে গত সকালে বা দুপুরে কোন ঝামেলায় না পড়লেও পড়েছিলাম ঠিকই সন্ধ্যায় অঘাধ সলিলে, সিএফও আমিন ইব্রাহিমের ড্রাইভারের কেরামতিতে।
ঘটনা হছে গতকালই যেহেতু আচানক প্রথমবারের মতো এ শহরে একাকী গাড়ি চালিয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার চক্করে পড়েছিলাম, তাই পথ হারানোর ঝুঁকি এড়ানোর জন্য একই কমপাউন্ডবাসি আমিন কে বলেছিলাম যে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় তার ড্রাইভার যেন ধীরে সুস্থে গাড়ি চালায়, যাতে তার পিছু পিছু চালিয়ে গাড়ি, পৌঁছুতে পারি আমিও বাড়ি।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক