দেশ হতে দেশান্তরে

ইমিগ্রেশনে দুর্ভোগের রাত

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৪ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

যে কোনো মহাদুর্যোগের দুর্ভোগময় রাতেরও একসময় শেষ হবার নিয়ম আছে প্রকৃতিকভাবেই। গত রাতটি আমার ও আমারই মতো শুধু ঢাকা নয়, মুম্বাই এবং করাচী থেকে উড়ে এসে রিয়াদে নামা সাউদিয়া বিমানের যাত্রীদের জন্য ছিল দুর্ভোগের এক দীর্ঘ রাত। সম্ভবত প্রাকৃতিক ঐ নিয়মের কারণেই বাধ্য হয়েই সে রাতটিও যে শেষ হলো অবশেষে।

মোবাইলের পর্দা বলছে এই মরুতে এখন সকাল নেমেছে। বাজছে সকাল ৬টা ৪০। সারারাত লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থেকে, ক্ষণকাল আগে ইমিগ্রেশন নামের পুলসিরাত পার হতে পেরেছিলাম আমি অবশেষে।

যদিও বেশ আগেই, মানে ভোর প্রায় ৪টা সাড়ে চারটার দিকে প্রথম চাপ অনুভব করেছিলাম প্রাকৃতিক ঘরে হাজিরা দেবার, তারপর থেকে সেটাকে যে এতোক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম, তার জন্য কি নিজের মনোবল? নাকি দেহযন্ত্রকে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। সৌদি ইমিরগ্রেশনের ঐ ছোকরা বেশ কিছুক্ষণ ধরে তুমুল মনোযোগে আমার পাসপোর্ট আর ভিসা খুঁটিয়ে দেখে, যে মুহূর্তে প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও পাসপোর্টে দড়াম করে সিল মেরে, তুমুল অবজ্ঞা ভরে সেটি আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়ার সাথে মুখে ‘খালাস’ বলে হাতের ইশারায় এই পুণ্যভুমিতে পা রাখার আদেশ জারী করেছিল, ঠিক তখনই কী না প্রবল চাপে তলপেটের এক্কেবারে বাঁধ ভেঙে যাবার যোগাড় হয়েছিল!

অত্যন্ত অভব্যভাবে ছুঁড়ে দেয়া পাসপোর্টটি দ্রুত হাতে নিয়ে দ্রুত ইমিগ্রেশন কাউন্টার পেরিয়ে এপারে আসতে আসতেই চকিত চোখে দু দিক জরীপ করে টয়লেট সাইন দেখতে না পেয়ে মনে মনে দমে গেলেও, সাথে সাথেই মনে হয়েছিল নিশ্চয় তা পাওয়া যাবে ব্যাগেজ আনার ঘরে। সে ভাবনার হাত ধরেই এক্ষুণি নজরে এলো সেই ব্যাগেজ ঘরের সাইনও। অতএব দৌড়ে না হলেও বলা চলে ঐরকম গতিতেই জোর কদমে এগুতে লাগলাম সেইদিকে।

দুর্ভোগের দীর্ঘ দীর্ঘ রাতের যবনিকা টেনে আকাশে হাজিরা দেয়া মরুসূর্য রিয়াদ বিমানবন্দরের বাইরে এখন কি হাসছে নাকি চোখ পাকাতে শুরু করেছে তা জানি না। তবে এমনিতে অতিদুর্লভ যে ভাগ্য আমার, সেটি দেখছি হঠাৎ ফিক করে হাসল মুখ তুলে। ধড়ে প্রাণ এল তাতে! কারণ ব্যাগেজ ঘরে যাওয়ার সাইনটি চোখে পড়ার সাথে সাথে ঐদিকে পা বাড়াতেই পেলাম দরজাটি পায়ের নাগালেই।

রাজকীয় রিয়াদ এয়ারপোর্টে গতরাতে নেমে, এর আকার ও সাজসজ্জা নিয়ে বেশ হতাশ হলেও, এ মুহূর্তে এটির সেই আকার নিয়ে বড়ই প্রীত হলাম। ভাবছি আকার ছোট হবার কারণেইতো এতো দ্রুত আসতে পারলাম এই ঘরে। আর ঐ তো দেখা যাচ্ছে, এ মুহূর্তে তুমুল প্রার্থিত আমার সেই প্রাকৃতিক ঘর! তদুপরি এ মুহূর্তে এই ব্যাগেজ ঘরটি যেহেতু বলা চলে মোটামুটি জনশুন্যই, অতএব কোনো লাইনের খপ্পরে পড়তে হবে না ঐ ঘরে গিয়ে।

গতকাল রাতে মোটামুটি শেষ যাত্রীদের একজন হিসেবে বিমান থেকে নেমে ধীরে সুস্থে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে এগুবার সময় পথিমধ্যে টয়লেটের দেখা পেয়ে, খুব জরুরি চাপ না থাকারও পর যে হাজিরা দিয়েছিলাম ওখানে সেটি, যে অত্যন্ত একটি ভালো কাজ হয়েছিল, টের পেয়েছিলাম তা রাতভর ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে।

ঠিক ক’টায় দাঁড়িয়েছিলাম ইমিগ্রেশনের লাইনে, সঠিক বলতে পারবো না তা। আগেই বলেছি ইমিগ্রেশন হলে ঢোকার মুখেই পড়েছিলাম প্রথমে এক পুলিশের হাউ হাউ করে দেয়া আরবী ধমকের পাল্লায়। সেই ধমকের শব্দটি যে কী ছিল? তা অনুধাবন করার আগেই মুখোমুখি হতে হয়েছিল হলে মজুদ থাকা দ্বিতীয় পুলিশের ধমকের।

কপাল ভালো, তার দেহভাষা বেশ আক্রমণাত্মক থাকলেও তার উচ্চারিত তিনটি শব্দ, ঢাকা, মুম্বাই, কারাচি এই তিনটি নামবাচক শব্দ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম। একই সাথে তার দেহভঙিটি দেখে ঠিকই ঠাহর করতে পেরেছিলাম দাঁড়াতে হবে কোথায়।

ধারণা করি স্থানীয় সময় রাত এগারটার আশেপাশের কোনো একটা সময়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ঢাকা থেকে আগত যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত অচল এক ইমিগ্রেশন লাইনের একদম শেষ দিকে।

হ্যাঁ শুধু ঢাকা থেকে আগত আমি ও আমরাই না; আমাদের পর পর আসা মুম্বাই আর করাচি থেকে আসা যাত্রীদেরও যথাক্রমে দাঁড়াতে হয়েছিল আমাদের অচল লাইনের বাঁয়ে পাশাপাশি আর দুটো অচল ইমগ্রেশেনের লাইনে।

হ্যাঁ আমাদের তিনটা লাইনকে অচল বলতে হচ্ছে, কারণ যখন দাঁড়িয়েছিলাম লাইনে সেই থেকে আরো প্রায় আড়াই ঘণ্টা কি তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ঐ লাইনের কাউন্টারগুলো তে ছিল খাঁ খাঁ শূন্যতা। মানে ঐখানে আগত যাত্রীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার জন্য কোনো লোক ছিল না।

ঐ হলে ঐ তিনটি অচল লাইন ছাড়াও, আমাদের বাঁয়ে ছিল আর দুটো অত্যন্ত সচল ইমিগ্রেশন লাইন। কারণ ও দুটোতে আগত যাত্রীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার জন্য লোক ছিল মজুদ। ঐ লাইন দুটোতে দাঁড়ানো লোকজনদের পোশাক, আশাক, চেহারা আর তাদের মুখ নিসৃত ভাষায় বুঝতে পারছিলাম, যে তারা হলেন হয় আরবীয় নয়তো ইউরোপ আমেরিকার লোকজন, এসেছেন যারা ভিন্ন কোনো জায়গা থেকে সাউদিয়ারই অন্য কোনো ফ্লাইটে। তদুপরি, সেই কাউন্টার দুটোর উপরে যথাক্রমে একটাতে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘সৌদি অনলি’, অন্যটিতে লেখা ছিল ‘জি সি সি কান্ট্রিজ এন্ড ফ্লাইনাস’।

বিশ্বের নানান দেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনেই, সেই দেশের নিজ নাগরিকদের জন্য আলাদা লাইন থাকে। এমনকি কোনো দেশের সাথে অন্যান্য দেশের বিশেষ কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিশেষ কোনো চুক্তিফুক্তি থাকলে, চুক্তিভুক্ত ঐসব দেশের ভ্রমণকারীদের জন্য আলাদা লাইন থাকে নানান দেশের বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে। বুঝলাম আছে তেমনি এইখানেও। সমস্যা নাই কোনো তাতে। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে আজ পর্যন্ত কোনো বিমানবন্দরেই আমি দেখিনি যে, যাত্রীদের দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছে অচল কোনো লাইনে, হয়েছিল যা এই রিয়াদে। বড়ই চমকিত হয়েছিলাম এতে, শুরুতেই। তবে শুরুর সেই চমক যে গোটা রাতজুড়েই দীর্ঘায়িত হবে এবং এর মধ্যে নানান আরো আচানক ঘটনায় চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হবে আমার, ভাবিনি তখনও তা ভুলেও।

আমাদের বিমানের তাবৎ যাত্রীদের মধ্যে একদম শেষ যাত্রী হয়ে ধীরে সুস্থে ইমিগ্রেশন হলে এসে পৌঁছনোয় আমাদের তিন মূর্তির মানে হামিদ মিয়া, কবির উদ্দিন ও আমার জায়গা হয়েছিল ঢাকা লাইনের একদম লেজে। আমি অবশ্য তাদের দুজনকে আমার সামনে দাঁড়াতে দিয়ে নিজে দাঁড়িয়েছিলাম একদম লাইনের শেষ ব্যক্তি হিসেবে।

লাইনের লেজের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেক কিম্বা হতে পারে তারচেয়ে বেশি কিছু সময় তীর্থের কাকের মতো শূন্য ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অপেক্ষা করছিলাম যখন, আকাশ পাতাল নানান চিন্তা, সম্বিৎ ফিরেছিল তখনি হঠাৎ, আমাদের লাইনটিকে সরল সোজা রাখার গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত ইমিগ্রেশন পুলিশের চিৎকারে, যার অবোধ্য ধমকের মুখোমুখি হয়েছিলাম এখানে পা রেখেই।

অবোধ্য সেই চিৎকারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই দেখতে পেলাম, যাচ্ছে তেড়ে সে আমাদেরই লাইনটির মাঝামাঝি জায়গার দিকে !

ঘটনা কী বোঝার জন্য ডান দিকে হেলে সামনে তাকাতেই নজরে এলো লাইনের মাঝামাঝি কেউ একজন বসে আছে মেঝেতে। ততোক্ষণে সেই ইমিগ্রেশন পুলিশ পাগলা উটের মতো চিৎকার করতে করতে এগিয়ে গিয়ে, বসে থাকা সেই লোকটির কোমরের নিচ বরাবর লাগিয়েছে বুটের এক মাঝারি আকারের খোঁচা।

আচমকা এরকম একটা লাথি খেতেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো লোকটি। তা দেখে গায়ে আগুন ধরে গেল আমার। একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ কোন অসভ্য আচরণ! অথচ আমাদের লাইনটিই নয় শুধু, আরো যারা দাঁড়িয়ে আছে নানান লাইনে, তাদের মধ্যে যাঁদের চোখে পড়েছে ঘটনাটি, কারো মধ্যেই কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মনে হল, এরকম জান্তব ঘটনা বুঝি এখানকার অতি স্বাভাবিক নিয়ম!

ততোক্ষণে সেই ইমিগ্রেশন পুলিশ, ঐ লোকটিকে লাইন থেকে টেনে বের করে, অনেকটা ভেড়া তাড়ানোর মতো করে মুখে বেশ জোরে জোরে যা উচ্চারণ করছিল তা বোজার জন্য কান খাড়া করতেই শুনতে পেলাম পরিষ্কার পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত একটাই শব্দ, ‘আখের’, ‘আখের’।

এতে পশুর মতো তাড়া খাওয়া লোকটিকে দেখলাম আসছে, সে আমার দিকেই! এইমাত্র অপমানিত নির্যাতিত হওয়া লোকটির সাথে পাছে চোখাচোখি হয়ে যায় আমার, সেই ভয়ে আর সবার মতোই মেরুদণ্ডহীন কেঁচো হয়ে গুটিয়ে গিয়ে চোখ নিচে নামিয়ে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেসময়।

অচিরেই সৌদি ইমিগ্রেশনের ঐ ষণ্ডটি আমার দেশী ভাইটিকে, আমারই ঠিক পেছনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজের মাতৃভাষায় ধমকে আরো কিছু নির্দেশ দিয়ে ফিরে চলে যেতেই ‘বুঝলেন এইটা একটা হাইওয়ানের দেশ। এরা আমাগরে মানুষই মনে করে না। ‘বুড়া মানুষ এতক্ষণ খাড়াইয়া থাইক্কা কোমরটা ধইরা গেছিল, হের লাইজ্ঞা একটু বইছিলাম মাডিত, তাতে তার কী ক্ষতি হইছিল কন তো ছার’?

ভাঙা গলায় পেছন থেকে এই কথাগুলো ভেসে আসতেই যাবতীয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ঘাড় ফেরাতেই নজরে পড়লো একমুখ খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি সম্বলিত মুরুব্বির মুখ! যে মুখ এ মুহূর্তে একই সাথে তীব্র ঘৃণা, তুমুল লজ্জা আর প্রবল অক্ষম রাগে বিকৃত! এই রকম মুখের মুখোমুখি জীবনে আমি আর কখনো হয়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। রা সরলো না মুখে এ অধমের! ভাবছি শুধু, হায়রে আমার বাংলার কোন গ্রাম থেকে যে এই মুরুব্বী এসেছেন এই মরুতে এইভাবে এরকম মানবেতর হেনস্থার মুখোমুখি হতে?

একইসাথে মনে মনে ঠিক করেছিলাম সে সময় যে, প্রথমত নট নড়ন চড়ন হয়ে থাকবো আমি ঠায় দাঁড়িয়ে হোক তা যতোক্ষণই। বলা তো যায় না, কোন ধরনের নড়াচড়া করে আবার মুখোমুখি হই কোন অপমানের। এই ঘরের আর সব মানুষের মতো অন্যের উপর ঘটে যাওয়া অবিচার নিয়ে, নিজে যদিও বাচিয়েছিলাম গা চুপচাপ; কিন্তু নিজের উপর সামান্যতম অপমানের কোনো আঁচড়ও যদি পড়ে, করবো উসুল তা সুদে আসলে, সুযোগ পেলে।

যদিও জানি, ঐরকম কিছুর ফলাফল হতে পারে দুটো। প্রথমত আমার স্থান হতে পারে সোজা সৌদি জেলে। দ্বিতীয়ত নেহাতই যদি কপাল ভালো হয় আমার, তবে করে দিতে পারে আমাকে সোজা ঢাকার ডিপোর্ট।

ঘটনা এই দুটোর মধ্যে যেটাই ঘটুক, তাতে বাজবে আমার ক্যারিয়ারের বারোটা। যে এসাইনমেন্টের জন্য আমার নিয়োগকর্তা আমাকে পাঠিয়েছে এই মরুতে প্রথমে তা তো বাতিল হবেই, এমন কি চলে যেতে পারে চাকরিটাও।

গেলে যাবে চাকরি! কুছ পরোয়া নেই! মনে মনে এরকম একটা কঠিন পণ করে ঐ লোকটি থেকে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে মুখ শক্ত তারপর থেকে লাইনে ছিলাম দাঁড়িয়ে এটেনশন হয়ে, অতপর রাতভর।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক আনন্দের উৎসবের জন্য অপেক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ