‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে? এখন আবার বেরুবে কেন? বস তুমি। বাইরে যাওয়ার দরকার নাই আর। ব্যাগপত্র গোছাতে হবে না আমাদের?’
স্ত্রীমুখনিঃসৃত উপর্যুপরি প্রশ্নসমূহের সাথে জারী হওয়া আদেশ কর্ণগোচর হতেই, সেই কবুল বলিবার ক্ষণ হইতেই যে নিজ অবচেতনে অধিকাংশ সময়েই বিনাবাক্যব্যয়ে স্ত্রীআজ্ঞা কবুল করার ব্যাপারটি কবুল করে নিয়েছিলাম, এক্ষণে সেই শুধুই স্বতঃপ্রণোদিতই নয় বরং অতি আনন্দে উচ্চারণ করা কবুলের ছায়াতলেই নিজেকে সমর্পণ করিলাম। তারপরও এই বেকুবের চরিত্রের বেয়াড়া অংশের গোঁয়ার্তুমিবশত ঠিক নিজের জন্য না হলেও এ জগতের সকল স্বামীর মানসম্মান রক্ষা কল্পে আমতা আমতা করতে করতে বললাম –না না, ভাবছিলাম কাল তো খুব ভোরেই বেরুবো, তাই কিছু যাতে মুখে দিয়ে বেরুতে পারি সবাই, সে ব্যবস্থা করার জন্যই বাইরে যেতে চাচ্ছিলাম। দেরী করে গেলে হয়তো দেখা যাবে ঐ দোকানটি বন্ধ হয়ে গেছে।
বলতে বলতে বলা চলে অনেকটা ধপ করেই বসে পড়লাম গিয়ে রুমের ওপাশে জানালার দিকে পিঠ দিয়ে বসে থাকা সোফার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে।
‘না, যাওয়ার দরকার নাই। এখনো যা আছে আমার কাছে বিস্কিট, কেক, আর ফলফলাদি তাতে হয়ে যাবে। আর এক গাদা পানি যে সেদিন কিনেছিলে সেগুলোর তো অর্ধেকও শেষ হয়নি। তবে তোমাকে এরকম লাগছে কেন তা তো বললে না। কী হয়েছিল?’
কপাল ভালো এই যে, কথাগুলো বলছে লাজু, শপিং ডে ঘোষিত আজকের দিনে কেনা নানান জিনিশপত্রের প্যাকেটগুলো গোছাতে গোছাতে, তাই আর চোখে চোখে চোখ রেখে মিথ্যা বলার কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে না এ মুহূর্তে। তাতেই রক্ষা!
বেশিরভাগ সময়েই মুক ও বধির হয়ে এই অধমের স্ত্রীআজ্ঞা মেনে চলার ব্যাপারটিকে আশেপাশের চেনা জানা হিংসুটে লোকজন যতোই আমার গদগদ স্ত্রীপ্রীতি বা অতিরিক্ত স্ত্রীভীতি নামে অবিহিত করে হাসি ঠাট্টা করুক না কেন আড়ালে আবডালে, তাদের থোতা মুখ ভোঁতা করার জন্য না, এমনিতেই স্ত্রী সম্মুখে সেই তথাকথিত স্ত্রীপ্রীতি ও স্ত্রীভীতি ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষে, নকল একটা বীরপুরুষ ভাব ধরে রাখার যে স্বভাবও যে একইসাথে আয়ত্ত্ব করেছিলাম নিজেরই সাথে তুমুল লড়াই করে, সেটির তাড়নায় একটু আগের আমতা আমতা ভাব দ্রুতই ধামাচাপা দিতে এবং তারচেয়ে বড় কথা এ অধম যে স্ত্রীর চেয়েও বেশি ভয় পেতে পারে কোনো সম্ভাব্য হিরোইঞ্চি ছিনতাকইাকারীকে! তা গোপন রাখার প্রবল তাগিদে কথা ঘুরিয়ে এরই মধ্যে কর্নেলের স্টোর থেকে আনা প্যাকেটগুলো খুলে সেগুলো জরীপ করায় ব্যস্ত অভ্রর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ঠিক আছে ঠিক আছে, জো হুকুম। যাচ্ছি না তো আর। ঐ যে দেখো অভ্রর মনে হয় খিদে পেয়েছে খুব। এখন চল শুরু করি ডিনার। যেই হিমের মধ্য দিয়ে এগুলকেই নিয়ে এসেছি, তাড়াতাড়ি এগুলো খাওয়া দরকার। অভ্র যাও তো তুমি, ঐ রুমে খবর দিয়ে আসো।
এ কথা শুনে অভ্র সাথে সাথে ঐ রুমের দিকে চলে যেতেই তখনও রুমের নানান জায়গায় গোছগাছ করে রাখা কাপড় চোপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকটাক নানান জিনিষ অচিরেই সুটকেটস্থ করার মানসে হাতের কাছে একাট্টা করায় ব্যস্ত লাজু প্রসঙ্গ পাল্টে বলতে লাগল
‘শোন, নিজের সুটকেস নিজে ঠিকমতো গোছাবে। নিজের কোন জিনিষ কোথায় রেখেছ রুমে তা তো আমি জানি না। সব খুঁজে ঢুকিয়ে নেবে। ঠিকঠাক মতো ভাঁজ টাজ করে সুন্দর করে গোছাবে সুটকেস। তাইলে জিনিশপত্রের ভালোমতো জায়গা হবে। তুমি তো সবসময় দলা মোচড়া করে জিনিশপত্র ঢোকাও। এই শো পিসগুলো যে কিনেছি এগুলো কিন্তু তোমার সুটকেসে নেবে। কোনোটাই যেন না ভাঙে এমন ভাবে নেবে।’
পারিবারিক শান্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে এই জাতের কথার উত্তর সাধারণত দেই না আমি, হোক তা সত্যি বা মিথ্যা। এ জাতের আলাপ এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। কিন্তু এই যে একটু আগে একটা বীরপুরুষ বীরপুরুষ ভাব এনেছিলাম মনে, এ মুহূর্তে সেটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই বলে বসলাম,
‘আচ্ছা,আমার সুটকেস আমিই তো গোছাই সবসময়। আর আমার সুটকেস তো আমি অন্য কারো মতো গোছাতে পারবো না। ওটা আমি আমার মতোই গোছাব। তবে ঠিক আছে, তোমার কেনা শো পিসগুলো যাতে না ভাঙে সেগুলো ওভাবেই রাখবো। তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না’।
এতোটুকু বলার পর অনিবার্য পাল্টা আক্রমণটি বিছানার ওপাশে গোছগাছে ব্যস্ত লাজুর অতি চেনা হিম শীতল চাহনিতে ভর করে এদিকটায় এলেও, কপাল ভালো তার সাথে গোলা বর্ষিত হবার আর সুযোগ না দিয়ে বেজে উঠলো ঘরের বেল।
দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে দীপ্র রুমে ঢুকে রাতের খাবারের সেই কর্নেল প্যাকেট খুলেই বলে উঠল ‘ওয়াও বাবা, তুমি তো বার্গারও নিয়ে এসছো। আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছিল বার্গার’। ঠিক আছে, কথাবার্তা বাদ দিয়ে চল সবাই আমরা ডিনার শুরু করি। তারপর তো আবার গোছাতে হবে সবার ব্যাগ স্যুটকেস।
অতপর সকলে মিলে খাওয়া দাওয়া শুরু হতেই, মুখ খুললো দীপ্র ফের, ‘বাবা আদিব ভাইয়ের জন্য যে খেলনাটা নিয়েছি ওটা কি হাতে করে নেয়া যাবে? ব্যাগে ঢোকালে যদি ভেঙে যায়?’
নাহ বাবা, হাতে করে নিয়ে যাবার রিস্ক নেওয়া যাবে না। হাতে করে প্লেনে কী কী নেয়া যাবে না, এই লিস্টির এখন আর কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। ওটা আমার কাছে দিয়ে যেও। সুটকেসেই নেব। চিন্তা করো না, এমনভাবে রাখবো যাতে না ভাঙে।
‘এই শোন তোমাদের সব জামাকাপড় যেগুলো ঐ রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছ, সেগুলো সব এখানে দিয়ে যাবে, সাথে তোমার সুটকেসটা। এতো বড় হয়েছে এখনোতো নিজের ব্যাগ সুটকেস নিজে গোছাতে শেখো নি!”
মায়ের অভিযোগের মুখে, বেশিরভাগ সময়ই মুখ বন্ধ রাখার ব্যাপারে আমারই মতো তুমুল অক্ষমতা নিয়ে জন্মানো ও কিছুকাল আগে টগবগে কৈশোরে পা দেয়া দীপ্র আবার কী না কী বলে বসে, এই আশঙ্কায়, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেবার জন্য পুত্রদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বাবারা বলো তো এই ট্রিপে তোমাদের সবচেয়ে বেশি কী ভালো লেগেছে ?
বেশ জটিল সমস্যায় পড়ে গেল মনে হচ্ছে ওরা, এই প্রশ্নে! কিছুক্ষণ চুপচাপ মনে মনে ভেবে মনে হল দুজনেই বুঝতে পারছে না কোন উত্তরটা দিলে যুতসই উত্তর হয়। ফলে কোনো ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে দুজনেই সমস্বরে বলে উঠলো
‘সবই ভালো ছিল।’
হুম বুঝলাম। তাহলে বলো তো দেখি কোন জিনিষটা বাদ পড়ে গেল এই ভ্রমণে যেটা তোমরা করতে চাইছিলে
‘স্নো দেখেছি, কিন্তু স্নো ফল দেখতে পাইনি। যদি স্নো ফল দেখতে পেতাম আর সেই স্নো দিয়ে স্নোম্যান বানাতে পারতাম তা হলে খুব ভালো হতো।’
বড় পুত্রের এই উত্তরে কানে যেতেই, মনে হল আচ্ছা ষড়ঋতুর দেশ বলে খ্যাত আমাদের বাংলাদেশে যেখানে ছোট বেলায় আমি আষাঢ় শ্রাবণের অবিরল ধারার মধ্যে, আব্বা আম্মার কড়া আদেশ নিষেধ অবলীলায় উপেক্ষা করে নেমে গিয়েছি মাঠে ফুটবল খেলতে, যেটির নাম ছিল পাইন্না ফুটবল, তা বাদ দিয়ে, সেই ইউরোপ আমেরিকার বাচ্চাদের মতো তুষার নিয়ে খেলার এই সাধ তাদের মনে আসে কেন?
নিজমনে জেগে উঠা এই প্রশ্নের জানা উত্তর, সাথে সাথেই মনে করিয়ে দিল মনের দ্বিতীয় জন। বলল শোন এই যুগে ডিজিটাল সড়কের পথ ধরে তুমুল গতিতে প্রতিনিয়ত যেমন বিশ্ব হয়ে উঠছে অর্থনৈতিকভাবে একীভূত, তেমনি একই সাথে মুছে যাচ্ছে ক্রমশ নানান দেশের সমাজের, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও। হা ডু ডু, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধার কথা দূর অস্ত, আজ কি আর বাংলাদেশের গ্রামের ছেলেরাও খেলে ঐ পাইন্না ফুটবল? মাঠে নেমে নিজেরা ফুটবল খেলার বদলে ঘরে বসে গ্রামের ছেলেরাও তুমুল উত্তেজিত হয় আজ বার্সেলোনা– রিয়াল মাদ্রিদ, ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা বা মেসি–নেইমার নিয়ে। তদুপরি আরকেটা কথা, ধর ওরা যদি খেলতেও চাইতও পাইন্না ফুটবল তুমি বা তোমরা কি তাদেরকে তা করতে দিতে?
‘বাবা, আই কুড নট বাই এনিথিং ফর প্লুটো!’
বড় পুত্রের কথার লেজ ধরে বরাবরের মতো মনের ভেতরে যে কথোপকথন শুরু হয়েছিল ক্যাপ্টেনের মুরগির হাড্ডি চিবুত চিবুতে, এইমাত্র বলা অভ্রর এই কথা কানে যেতেই বড়ই বিচলিত হলাম! কারণ দেশে ফেলে আসা তার প্রিয় কুকুরের বাচ্চার জন্য কিছু কিনতে না পারার তার এই ব্যর্থতার ঘোষণাটি করুন কান্নার মতোই বেজে উঠলো কানে।
হাত বাড়িয়ে তাই ওকে কাছে টেনে নিতে নিতে বললাম, বাবা ঠিক আছে দেশে ফেরার পরই তো অফিসের কাজে যেতে হবে আমাকে ওমানে। তুমি লিস্ট করে দিও কী কী আনতে হবে প্লুটোর জন্য নিয়ে আসবো নিশ্চয় ওসব ওখান থেকে।
কলজে মুচড়ে দেয়া পুত্রের কথায় তুমুল আবেগাক্রান্ত হয়ে বলে তো দিলাম যে এনে দিব তার কুকুরের জন্য প্রয়োজনীয় খেলনা বা খাদ্য ওমান থেকে, তবে সাথে সাথেই প্রশ্ন জাগল মনে, পবিত্র ঐ মরুতে নাপাক কুত্তার কি স্থান আছে আসলেই? পাওয়া যাবে কি ওসব ওখানে?
নাহ ওমানে তো যাইনি আগে। তাই ওখানকার কথা জানিও না। তবে মহাপবিত্র সৌদিতে কর্মপোলক্ষে আসা যাওয়া করে থেকেছি তো দুই বছর, অতএব সেটাই মনে করতে চেষ্টা করলাম। এটা সর্বজনবিদিত যে ইসলাম ধর্মমতে কুকুর একটি নাপাক প্রাণী। ব্যতিক্রম শুধু একটি কুকুর, তা হল আসহাফে কাহাফের গুহা পাহারা দেয়া কুকুর কিতমির!
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।