বেইজিঙয়ের তিলের খাজা
‘ওহ তাহলে, যাই ঐ শপিং মলটাতেই আবার। এই মনু, পিকাসো তোমরা থাকো বাবার সাথে।’ বলে হেলেন রওয়ানা করতেই দুপুত্রই সমস্বরে জানাল যে, যেতে চায় এখন ওরা ফুপ্পির সাথে। ‘আমার সাথে গেলে কিন্তু যা বলি কথা শুনতে হবে। এই দাদা, ওদেরকে বলে দে তো ওরা যেন দৌড়াদৌড়ি না করে একদম। আর আমার কথা যেন শোনে।’
শোন বাবারা তোমরা যদি এনের সাথে যেতে চাও, তবে তার কথা মতো চলতে হবে বুঝলে? বোনের আবেদনের জবাবে পুত্রদের এ কথা বলতেই, পাওয়া গেল দুজনেরই তাৎক্ষণিক জোর সম্মতি। অতএব আর তো কথা থাকে না !
ওরা তিনজন চলে যেতেই, গোটা চত্বরটা ফের একবার চোখ জরীপ করে বুঝতে চেষ্টা করছি কোন শপিং মলে ঢুকলে পাওয়া যেতে পারে কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, যেখান থেকে কেনা যাবে বিশেষত চকলেট, ক্যান্ডি এসব। জরিপে কাজ হল। আগে ওটার সামনে দিয়ে বেশ ক’বার যাওয়া আসা করেছি যখন তখন ওটা নজরে পড়লেও, দেখতে পেলাম এখন ওটা। ঐ ম্যাকস্টোর লাইনের সিল্কের দোকানটির পাশেই আছে এইমাত্র চোখে পড়া একতলা ভবনটি। আগে সেটির সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করলেও ওটার দিকে মনোযোগ না থাকায়, সেটির ভেতরে যে কী আছে, তা তো দেখতে পাওয়ার কথাই না। এখন যখন দাঁড়িয়ে আছি বেশ কিছুটা দূরে, তাতেই বরং নজরে পড়ল সেটির বেশ বড়সড় দুপাল্লার কাচের দরজাটি। আরো দেখতে পেলাম সেই দরজা ঠেলে এক চায়নিজকে পলিথিন ব্যাগ ভর্তি কিছু নিয়ে বের হতে এইমাত্র। তাতে দূর থেকেই ভেতরের দিকের কিছুটা নজরে আসতে কেন জানি মনে হল, আচ্ছা ঐখানে একটা চক্কর দেব নাকি? আচ্ছা চক্কর দিয়েই দেখি না গিয়ে, কি আছে দরজার ওপাশে, ভাবতে ভাবতে বাড়ালাম পা।
এইমাত্র দরজা ঠেলে ঐ দালানের ভেতরে পা রেখে, প্রথমেই ডানে বাঁয়ে দুই পাশে যা চোখে পড়ল, তাতে চোখে যেমন লেগে গেল ধন্দ, তেমনি মনে তৈরি হল বিভ্রম! ভাবছি চলে এলাম তাহলে এ কোন রাজ্যে? এ তো মনে হচ্ছে ছোট বেলায় রূপকথায় পড়া কোনও এক তেপান্তরের মাঠে হঠাৎ দেখতে পাওয়া দেয়ালের গায়ে লাগানো দরজা ঠেলে ভেতরে পা ফেলতেই যে চলে যাওয়া যেতো কোনও অচিন রাজ্যে, ঘটনা তো মনে হচ্ছে ঘটলো তেমনি! চলে তো এলাম বুঝি প্রাচীন বাংলার পুন্ড্ররাজ্যে মানে এখনকার রাজশাহী এলাকায়!
সিসেম সিড নামে সারাবিশ্বে কি কারণে যে আমাদের তিল নামের এই শস্যদানাটি অত্যন্ত সমাদৃত তা জানি না। তবে দেখা মেলে তার বিশ্বের প্রায় সব জায়গাতেই, বিশেষত রুটিসহ নানান ধরনের বেকারি পণ্যে। ছোটবেলায় চাঁদপুরে নানাবাড়ি দাদাবাড়ির এলাকার মাঠে অনেক দেখেছি তিলক্ষেত। এখন সেই ক্ষেত আর দেখতে না পেলেও, চোখ বন্ধ করলেই ছোটবেলায় দেখা ক্ষেতের পর ক্ষেত জুড়ে থাকা তিল গাছে ফুটে থাকা সাদা, হলুদ, নীল কিম্বা বেগুনি রঙের অসংখ্য ফুল দেখতে পাই এখনো। দেখতে পাই সেই ফুলের চারদিকে বোঁ বোঁ করে আওয়াজ তুলে উড়ে বেড়ানো কালো ভোমরাদের কিম্বা নিঃশব্দে মধু সংগ্রহ করা মৌমাছিদেরও। আরও দেখতে পাই বাতাসে দুলতে থাকা লিকলিকে তিল গাছের মাথা ভর্তি ছোট ছোট কামরাঙা আকৃতির তিল ফল, যেটি পাকার পর সেটিকে ভাঙলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কালো, সাদা, বাদামি রঙের ছোট ছোট তিলদানা কদর যার বিশ্বজোড়া!
অন্যান্য দেশে এই তিলকে নানান বেকারির পণ্যে দেখতে পেলেও, শৈশবে দাদাবাড়ি নানাবাড়িতে, দাদি ও নানির হাতের তৈরি দারুণ সব তিলের নাড়ু, মোয়া, বা গুড় আর তিলের পুর ঢুকিয়ে বানানো পুলি পিঠা খেয়েছি। এছাড়া নানু দিদি তিলের তেল দিয়ে যে পাটশাক ভেজে রান্না করতেন তাও খেয়েছি। আবার ঐ তেল, দাদি নানি সহ নানান বয়স্কজনদের হাতে পায়ের গিঁঠে মালিশ করতেও দেখেছি। তবে তিলের তৈরি যে সুখাদ্যটি প্রথম দেখেছি অনেক পরে, বড় হয়ে রাজশাহী, নওগাঁ নাটোর এসব এলাকায়; তা হল, ছোট বেলায় যে কটকটি মিঠাই বা চিটমিঠাইকে মনে হতো অমৃতসম স্বর্গের খাবার, সেই কটকটি মিঠাইয়ের সাথে তিল মিশিয়ে বানানো তারই খালাতো ভাই, তিলের খাজা। এই মুহূর্তে বেইজিঙয়ের এই হিমসন্ধ্যায় এই দালানটির ভেতরে পা রাখতেই মিলল দেখা, দু’পাশে স্তূপাকৃতভাবে সাজিয়ে রাখা মন কে মন সেই তিলের খাজাই, যার হাত ধরে কিনা মন আমার সুড়ুৎ করে চলে গেল রাজশাহি নাটোর অঞ্চলে।
চিরকালের মিষ্টিভক্ত আমার চোখের সামনে লালা ঝরানো ও অতীব মনোহর এত্তো এত্তো মচমচে মিষ্টি তিলের খাজার হঠাৎ আবির্ভাব হতেই ভির্মি খেয়ে গিয়েছিলাম! আর না হয় বেইজিং ছেড়ে মন কেন চলে যাবে তিলের খাজায় ভর করে সোজা রাজশাহি, নাটোর, নওগাঁয়? না ঠিক রাজশাহি, নওগাঁ বা নাটোরেও না, বলা চলে চট করে মনে হয়েছিল বসে আছি বুঝি বগুড়া থেকে রাজশাহিগামী কোনও বাসে, যে বাস এইমাত্র এসে পৌঁছেছে নওগাঁর মোড়ে। সাথে সাথে বাসের জানালার পাশে ঝাকা ভর্তি তিলের খাজা নিয়ে হাজির হয়েছে হকারেরা। যদিও তিলের খাজা প্রথম দেখেছিলাম দিনাজপুরে চাকরি করতে গিয়ে, কিন্তু যাকে বলে বহুল পরিমাণে দেখা, সেরকম দেখেছিলাম ঐ নওগাঁতেই। ফলে বেইজিংয়ের তিলের খাজা চোখে পড়তেই তাতে সওয়ার করে মন চলে গিয়েছিল সোজা রাজশাহীতেই। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক মহাচীনের সব কিছুই যেমন বড় বড়, তেমনি এখানে যে পরিমাণ তিলের খাজা দেখছি, সে পরিমাণ তিলের খাজা একসাথে এর আগে দেখিনি। দেশে এতো পরিমাণ তিলের খাজার দেখা পেলে পাওয়া যেতে পারে রাজশাহি এলাকায় কোনও তিলের খাজার আড়ত যদি থেকে থাকে, সেখানেই।
সে যাক সম্বিৎ ফিরে ডানের বাঁয়ের স্টলগুলোর সামনের উপচে পড়া তিলের খাজা দেখতে দেখতে ভাবছি, আচ্ছা নিয়ে নেব নাকি দুয়েক কেজি? দেশে গিয়ে অনেককেই চমকে দেয়া যাবে বেইজিঙয়ের তিলের খাঁজা দিয়ে! বেশ মজা হবে ব্যাপারটায়।
আরে দূর মিয়া, কী যে কও না! কেউ আসলে বিশ্বাসই করবো না যে এই তিলের খাজা তুমি বেইজিং থেইকা নিয়া গেছ তাদের জন্য। সবাই ভাববো রাজশাহী, নাটোর বা নওগাঁর তিলের খাজা দিছো বেইজিঙয়ের নামে। হুদাই এই জিনিষ এইখান থেইক্কা যে কিনবা ভাবতেছ, আগে দামটা চেক করো। তদুপরি চিন্তা কইরা দেখো তোমার বউ কী কইবো, তোমার এই পাগলামি ছাগ্লামির ব্যাপারে! তদুপরি জোরজার কইরা যদি এগুলো ব্যাগ সুটকেস ঢুকানোও হয়, ঢাকায় গিয়া হয়তো দেখবা হাতে পাইছো তিলের খাজা না, তিল আর গুড়ের দলা!
হঠাৎ করেই মুখ খোলা, মনের দ্বিতীয় জনের এইসব যৌক্তিক কথায়, ভির্মি আমার কেটে গেল নিমিষে। বিশেষত যখন সে বউয়ের কাছে ঝাড়ি খাওয়ার অবশ্যসম্ভাবি সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দিল, তাতে যেনবা বেহুঁশ হয়ে পড়া আমার চোখে মুখে পড়ল ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা। অতএব সেই খাজাপ্রাঙ্গণে চোখ আর বন্দি না থেকে, ঘুরতে লাগল তা এই দালানের ভেতরের বাকি সারি সারি স্টলগুলোর দিকে। স্টলগুলোর প্রতিটিতে আছে মনে হচ্ছে নানান জাতের চায়নিজ ট্র্যাডিশনাল ক্যান্ডি, আচার, মোরব্বা ইত্যাদি জাতীয় খাবার। যে যে স্টলে যা ই আছে, সবই তুমুল পরিমাণে, স্তুপাকারে। দেখেছিলাম যেমন দরজা ঠেলেই এখানে ঢুকেই দুপাশের প্রথম চার পাঁচটা স্টলে তিলের খাজা!
প্রায় দেড় তলা বা দুতলা উঁচুতে থাকা ছাদের নিচে চারদিকে দেয়ালঘেরা এই ঘরটিকে বলা চলে আমাদের ঢাকার চীন বাংলাদেশ মৈত্রী হলের মতোই বিশাল এক হলঘরই। পার্থক্য হল ঢাকার চায়না বাংলাদেশ মৈত্রী হলের মতো এই হল ঘরটি অতো ঝকঝকে নয়, বরং অনেকটাই মলিন এর চেহারা। নানান মেলা উপলক্ষে চায়না বাংলা হলে সারি সারি অস্থায়ী যে স্টল বসে, এখানেও আছে তেমনি অনেক স্টল। এখানে নানান স্টলে নানান ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ খাবারের মেলা বসেছে। তবে এ কোনও অস্থায়ী মেলা নয়। মনে হচ্ছে স্থায়ী বাজার।
বড় কথা হল, একদম আচানকভাবে এইরকম চায়নিজ ট্র্যাডিশনাল শুকনো খাবারের খনির সন্ধান পেয়ে বড়ই প্রীত বোধ করছি। কারণ এতে পরিচিতজনদের জন্য একদম চায়নায় তৈরি কিন্তু বঙ্গ রসনায় অতি সহজে মানিয়ে যাওয়া খাবার নিয়ে যাবার সুযোগ হল।
লেখক: কলামিস্ট, ভ্রমণ সাহিত্যিক।