দেশ হতে দেশান্তরে

পর্দাজুড়ে আমরা আমরাই

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:৫১ পূর্বাহ্ণ

যদিও আজকের হিম সেদিনের চেয়ে কমই মনে হচ্ছিল এতক্ষণ, তবে এখানে এখন যে রকম বাতাসের তোড়ের মুখোমুখি হলাম, তাতে যে বেড়েছে হিমের কামড় টের পাচ্ছি তা হাড়ে হাড়ে। এছাড়া বাতাসের এই জোর ও তোড় ফিরিয়ে দিল মনে সেদিনকার তিয়েন আন মেন স্কয়ারের অভিজ্ঞতাও । যার ফলে জোর ধারণা জন্মেছে যে, আছি এক্কেবারে তিয়েন আন মেন স্কয়ারের দোরগোড়াতেই। এমনকি হতে পারে এই দালান দাঁড়িয়ে আছে তিয়েন আন মেনের দিকে মুখ করেই । এখান যে আমরা ছবি তুলছি এর ফুল ভরা উঠানে, এটা আসলে এর পেছন দিক।

অবশ্য যতোই থাকি না কেন তিয়েন আন মেনের দোরগোড়ায়, আর মনে থাকুক যতোই আমার ফের তিয়েন আন মেনে যাওয়ার সখ , এমুহূর্তে সে আশা পূরণ করার আশা আসলে দুরাশাই । সেদিন পথ যদি নাও হারাতাম তিয়েন আন মেনে, তাও কি পুরোটা দেখতে পারতাম ঐ জায়গাটার? নাহ আবার যদি ফিরে আসি কোনদিন বেইজিংয়ে, নিশ্চয় থাকার চেষ্টা করবো ফের ঐ রিজেন্টে কিম্বা তার উল্টা দিকের লিজেন্ডাইল হোটেলে । তাতে নিশ্চিত পায়ে হেঁটেই চলে আসতে পারবো তিয়েন আন মেনে। আজ তো চেনা হল পথটা। ভাবতে ভাবতে এরই মধ্যে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছি উপরে প্রায় তিন চতুর্থাংশ। ভেবেছিলাম এই সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই বুঝি দেখতে পাবো এই স্থাপনাটিতে ঢোকার কোন দরোজা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না, এর প্রবেশদ্বার এদিকটায় নয়। অতএব উপরে উঠে আর লাভ নেই।

বাবা, বাবা, চল। মা বলছে উপরে উঠবে না। এখানে থাকবেও না। ঠাণ্ডা লাগছে খুব।’ নীচ থেকে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে বলা দীপ্রর এ কথাগুলো কানে যেতেই , দ্রুত স্থাপনাটির কয়েকটা ছবি তুলে নামতে শুরু করলাম দ্রুত। নামতে নামতে ভাবছি, আরে এরকম একটা চমৎকার স্থাপনার নাম তো জানা হল না! যতোটা চোখে পড়েছে দালানটির এদিকটা তাতে কোথাও এর নাম লেখা দেখলাম না। চায়নিজে হলেও তো থাকবে তো নাম এর। নাকি ছিল কোথাও না কোথাও, কিন্তু চোখে পড়েনি তা আমার?

আচ্ছা দেখি তো, এই যে ছবি তুললাম একটু আগে ওইটির কোথাও পাই কি না এর নাম খুঁজে ? সপুত্রক নীচে নিম্নগমন করতে করতে, হাতফোনের মগজ থেকে ছবিটি বের করে, সেটিকে বড় করে দেখার জন্য চাপ দিলাম। ছবিটি বড় হতেই রুপালি কাঁচঘেরা অর্ধবৃত্তাকার সেই স্থাপনাটির যতোটা ধরতে পেরেছিলাম লেন্সে তার আগা পাশ তলা পুরোটাতে নজর বুলিয়েও কিছুই পড়লো না চোখে যখন, ঠিক তখনই ফোনের পর্দার উপরের দিকের সাদা অংশে দেখতে পেলাম ইংরেজিতে লেখা “দি মল এট ওরিয়েন্টাল প্লাজা !”

নাহ শুধু ঐ নামটাই না, লেখা আছে তাতে সন তারিখ আর ছবি তোলার সময়টিও! বাহ আইফোনের এই তেলেসমাতিটি তো আগে খেয়াল করিনি! যতোই চায়না ইন্টারনেটের সুপার হাইওয়েতে ব্যারিকেড তূলে রাখুক না কেন, আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির কোনটা যে কোনভাবে এদের পর্দা ফাঁস করে দেবে তার তো দেখছি নাই কোন ঠিকঠিকানা!

এই শোন ট্যাক্সি ডাকো। এই ঠাণ্ডায় হেঁটে যেতে পারবো না। খুব টায়ার্ড লাগছে।’ সিঁড়ি বেয়ে নেমে নীচে ফুটপাতে অপেক্ষারত দলের বাকীদের কাছে পৌঁছুতেই জারী হল হুকুম।

এমনিতেই পারতপক্ষে স্ত্রী আজ্ঞা অমান্য করি না। তদুপরি এরই মধ্যে বেশ অনেকটাই হেঁটেছে সবাই । যতোই কম থাকুক না কেন আজকের হিম , কিম্বা হয়ে উঠুক না তা কিছুটা হলেও গা সওয়া, তারপরও নাতিশীতোষ্ণ বাংলার মানুষের পক্ষে এতোটা সময় এই হিমে খোলা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা, যা তা কথা তো নয়। তদুপরি এখন হিমের সাথে বেড়েছে বাতাসের তোড়, যাতে ধরেছে এরই মধ্যে নিজের হাড়ে কাঁপন। এমতাবস্থায় ট্যাক্সিতে উঠে পড়াটাই ভাল। ভাবতে ভাবতে রানওয়ের মতো বিশাল ফুটপাতের ডানে বাঁয়ে চোখজরীপ করতে লাগলাম, ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের সাইনের খোঁজে! অবশ্য ফুটপাতের এরকম একটা জায়গায় ট্যাক্সি স্ট্যান্ড না থাকাটাই স্বাভাবিক। এটা তো এমন কোন জায়গা নয়, যেখানে অহরহ যাত্রীরা অপেক্ষা করে ট্যাক্সি ধরার জন্য। তবে এটা নিশ্চিত যে ঐ ওরিয়েন্টাল প্লাজায় ঢোকার মুখে আছে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। আরও সামনে এগিয়ে গেলে নিশ্চয় পাওয়া যাবে ঐখানে যাওয়ার রাস্তা। কিন্তু এমুহূর্তে আরো সামনে এগিয়ে যাবার প্রস্তাব দেয়া তো ঠিক হবে না। তখনি খেয়াল হল দুটো বিষয়। প্রথমত সামনের এই বিশাল রাস্তাটি আসলে একমুখী। এ রাস্তার এদিক থেকে ট্যাক্সিক্যাব ধরলে কতোদূর ঘুরে যে নিয়ে যাবে আমাদের হোটেলে তা কে জানে? দ্বিতীয়ত এবং অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে , একসাথে আমার পাঁচজন তো উঠতে পারবো না ট্যাক্সিতে!এ জ্ঞান তো পেয়ে গিয়েছিলাম সেই প্রথম দিন বেইজিং এয়ারপোর্টেই। খুব জোর তিনজন উঠতে পারবো চলমান খাঁচার মতো এখনাকার ট্যাক্সি গুলোতে। যার মানে হবে নিতে হবে দুটো ট্যাক্সি। কিন্তু এ রকম ঘুরপথে হোটেলে ফিরতে গিয়ে যদি দুই ট্যাক্সি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে একটি আরেকটির কাছ থেকে, তবে এই চায়নিজ মুল্লুকে তো তীরে এসে তরি ডুববে। আগামীকালই তো ফিরবো দেশে। এতোদিনই যেহেতু পরিবারের সবাই ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাক্সিতে উঠার ঝুঁকি নেইনি, এখন তা নেবার কোন মানেই নেই।

অতএব এ ব্যাপারটার উপর বেশ গুরুত্ব দিয়ে স্ত্রী সমীপে তা পেশ করতেই, এলো উত্তর “তা হলে উপায় কি সেটা বল?’

মানে বলছিলাম কী, চল এখান থেকে ঘুরে হাঁটা দিয়ে পেছনে ফেলে আসা কোন মার্কেটে ঢুকি। তাতে ওখানে যেমন তোমাদের কেনাকাটাও শুরু করতে পারবে, এই ঠাণ্ডা থেকেও পাওয়া যাবে রক্ষা। এমন কি কফি টফি খেয়েও চাঙ্গা হওয়া যাবে। এছাড়া ঐ মার্কেটের ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে দেখবো পাঁচ জন যাওয়া যায় এমন কোন ভ্যান পাই কি না। ওহ ভাল কথা, তুমি না ঐ যে পঙ্‌গু লোকটাকে সাহায্য করতে চাইছিলে, তার কী হবে?

আচ্ছা ঠিক আছে চল। ঐ দিকেই যাই”

ইংরেজির দুই সি এর কোন সি, মানে কনভিন্স কিম্বা কনফিউজ এর মধ্যে কোনটা যে কাজ করল বুঝলাম না । তবে রাজি যখন হয়েছে কথা আর না বাড়িয়ে বরং বাড়ানো উচিৎ পা। করলামও তাই। কেন জানি মনে হচ্ছে আমার শেষ কথাটাতেই গলেছে মন ওর।

সবাইকে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে এগুতে ভাবছি, আম্রিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রু ম্যানের বিখ্যাত এই দুই সি কৌশল রাজনীতিবিদরা যেমন কাজে লাগিয়ে থাকে জেনে বা না জেনে অহরহই, তেমনি করে থাকে বিপণনবিদরা এবং বিক্রয় কর্মীরা। রাজনীতিবিদ তো আমি অবশ্যই নই। তবে পেশআগত জীবন আমরা শুরু হয়েছিল বিক্রয় কর্মী হিসেবেই, অতপর বহুকাল ছিলাম বিপণনে। জেনেশুনে পারতপক্ষে আমি ঐ দ্বিতীয় সি মানে কনফিউজ করার চেষ্টা করিনি কাউকে। কারণ জানতাম যখন ঐ কনফিউশনের ধাঁ ধাঁ কেটে যাবে কারো, তখন ফলাফল যা হবে, তা মোটেও সুখকর হবে না। বিপণনবিদ ও বিক্রয়কর্মীদের যেমন ভড়ং ধরে হলেও ক্রেতাকে রাজা বা রানী মানতে হয়, সে জায়গায় স্বামীদের তো এক্কেবারে কায়মনেই স্ত্রীদের সম্রাজ্ঞী হিসেবে মানতে হয়। এমতাবস্থায় স্ত্রী’র সাথে ঐরকম চালিয়াতি করার পর যেদিন পড়বো ধরা, তারপর থেকে তো আজীবনের জন্য বাকিজীবন হয়ে যাবে ফানা ফানা !

দাদা, শোন ঐ যে সামনের বিল্ডিংটা দেখছি, ওটা কি মার্কেট? মার্কেট হলে চল ওটাতেই ঢুকে পড়ি।” শীতকাতুরে হেলেনের এ কথা কানে ঢুকতেই সায় দিলাম বিনাদ্বিধায় মাথা নেড়ে। খুব জোর আর মিটার বিশ কি পচিশ দূরে আছে দালানটা। ঐ দালানটার পর বেশ কিছুটা ফাঁকা রেখে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি দালান। তারপর আছে সেই আওডি সিটি বেইজিং নামের সম্ভাব্য অফিস বিল্ডিংটি। আওডি বিল্ডিংয়ের সামনে ছবি তোলা শেষ করে বেশ দ্রুত মাঝের এ দালানগুলো পেরিয়ে তখন ঐ ওরিয়েন্টাল প্লাজার দিকে এগুনোর সময় মনোযোগ সামনের দিকেই থাকায় লক্ষ করিনি সেসময় এই দালান দুটোতে কি আছে? এখন দুটোর সামনেই চায়নিজ নববর্ষের আগমন উপলক্ষে করা সাজসজ্জার বহর দেখে, মোটামুটি নিশ্চিত ধরে নেয়া যায় যে ওগুলো কোন না কোন পণ্যের মার্কেটই হবে ।

চল মনু, পিকাসো, যাই তাড়াতাড়ি ঐ মার্কেটে। খুব শীত লাগছে।” একটু আগে আমার সম্মতি পাওয়াতে আর এরই মধ্যে ঐ সম্ভাব্য মার্কেটের কাছাকাছি হতেই হেলেন দুই ভাতুষ্পুত্রকে এই প্রস্তাব দিতেই , দিল দুজনেই ভোঁ দৌড় । সাথে সাথে হেলেনও জগিং করে এগুতে লাগলো।

আচ্ছা এইভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে ওরা যদি পড়ে ব্যাথা পায়, কি হবে বলতো? কি দরকার ছিল ওদেরকে এভাবে উস্কে দেওয়ার? তুমিতো দেখি কিছু বললা না!’ উদ্বিগ্ন ও বিরক্ত লাজুর এ কথার জবাবে মুখ ফুটে পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলা বড়ই বিপজ্জনক। আবার একদম চুপ থাকবো সেরকম দুটো মাথাও তো ঘাড়ের উপর বসানো নাই। অতএব হু হাঁ করতে করতে দ্রুত এগুতে এগুতে বললাম ওকে, চল, ওখানে গিয়ে দেখি কোন কফিশপ আছে কি না? যদি থাকে তবে আমি খাব এস্প্রেসো কফির ডাবল শট। তুমি কী খাবে? কাপুচিনো নাকি লাতে?

কি যে খাই আমি সেটা তো মনে নাই। অতো নাম টাম তো আমার মনে থাকে না। কফি আমি খুব বেশী খেয়েছি নাকি । দেশে তো সবসময় চা ই খাই। দেশের বাইরে গিয়েই না কফি খেয়েছি। আচ্ছা এখানে কি স্টারবাক্স আছে ? যদি থাকে তবে সবসময়ই যেটা খাই ওটাই অর্ডার করো। তবে এখন আমার দরকার একটু বসে রেস্ট নেওয়া”

কথা বলতে বলতে এরই মধ্যে নিজের হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়াতে বেড়ে গিয়েছিল লাজুরো হাঁটার গতি। দেখছি ওর হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে ফিরে এসেছে ফের সেই সামান্য খোঁড়ানোর ভঙ্গিটি। তাতে এটা পরিষ্কার যে, আসলেই বেচারির পায়ের বিশ্রাম দরকার।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমন পোড়ে বাবা
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ