ছোটপুত্রের অতি প্রয়োজনীয় পেটশপ খোঁজায় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে, মার্কেটের ভেতরকার ওম ওম গরমের আরাম ছেড়ে বেইজিং হিমে ঝাপ দিয়ে, সামনের রানওয়েমার্কা ফুটপাতের অংশবিশেষ জুড়ে ঐ মার্কেটেরই বর্ধিতাংশ হিসাবে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত সেই লাল ফুটপাত বাজারের, এদিকটার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী ও বোনের কাছাকাছি হতেই এই অধম স্বামী নামের অবোধ প্রাণীটির শীর্ণ বুক বরাবর ছুটে এলো অনিবার্য স্ত্রীশেল !
‘এতো দেরী করলে কেন? আমাদেরকে এই ঠাণ্ডায়, কী একটা ফালতু মার্কেটে ছেড়ে দিয়ে খুব তো নিজেরা গেলে ঐ মার্কেটের ভেতরের গরম আরামের ভেতর! কোন কাণ্ডজ্ঞান আছে কি তোমার?’
স্ত্রীমুখ নিক্ষিপ্ত এই গোলার বিপরীতে মুখে প্রায় এসেই গিয়েছিল কথা, আমার যে বাহ্যজ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান সহ কোন জ্ঞানই নেই সেটা তো তুমি জানোই বহু বছর থেকেই। এ আর নতুন কী?
কিন্তু না, সেই যে বিবাহের পর থেকে খুব দ্রুতই আমরা নিরাপত্তার খাতিরে জাগ্রত হয়ে গিয়েছিল অবেচেতনের নিরপত্তাবর্ম, সেটি সেই থেকে সদাজাগ্রত থাকায় বক্ষ আমার এ যাত্রা বেঁচে গেল পরবর্তী শেলের আক্রমণ থেকে। এমনিতে কোনও বীরপুরুষের বুক যতো চওড়া আর বলিষ্ঠই হোক না কেন, বিবাহিত হবার পর অচিরেই স্ত্রী শেলের আক্রমণে তা অতিদুর্বল ও অকিঞ্চিৎকর প্রমাণিত হতে বাধ্য। সে হিসাবে দুর্বল দেহকাঠামোর বুক আমার তো নিতান্তই কইতর মার্কা। ফলে আমার পক্ষে এ বিষয়ে অতি সাবধানতা অবলম্বন করা সকল সময়েই যে বাঞ্ছনীয়, অবচেতন মন আমার তা অতি সচেতনতার সাথে মনে রাখে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পরিষ্কার বুঝতে পারছি না, একটু আগে স্ত্রীমুখ নিসৃত অভিযোগ সমূহের কোনটির দায় আমার! বেইজিংয়ের এই গণ্ডারমারা হিমের জন্যই কি আমি দায়ী? নাকি নিজের অজান্তেই ষড়যন্ত্র করে আমি যে ঢুকে গেলাম মার্কেটের গরম আরামের ভিতর সেটাই আমার দোষ? নাকি এ লালবাজারের পণ্যসম্ভারে কাঙ্ক্ষিত পণ্য না থাকাটাই দোষ আমার? তবে এ সম্ভাবনা সুপ্রচুর যে তিনটাই আমার দোষ!
তাই নিজ মনে উপরের তিনটি সম্ভাবনার শেষটিকে, মানে যাবতীয় দোষের জন্যই আমিই দায়ী তা ঘাড় পেতে মেনে নিয়ে মিন মিন করে বললাম– ওহ সরি সরি, চল চল আর দাঁড়াবোই না এখানে। আসলে ফুটপাতের বাজারে তোমাদের কেনাকাটা করতে বলাটাই বিরাট ভুল হয়েছে। এ বাজারটাতে যে তোমাদের প্রয়োজনীয় বা পছন্দের জিনিসষ নেই, তা বোঝা উচিৎ ছিল আগেই !
‘সামনে আবার কোথায় যাবো? সামনে কি আরও মার্কেট আছে নাকি? মার্কেট থাকলেই কী, একা একা কেনাকাটা করতে পারবো না। এরা কিসের উন্নত দেশ? আমরা তো তাও কোনওমতে ইংরেজি বলতে পারি এরা কিছুই পারে না। আরে আমাদের ফুটপাতের মানে বঙ্গবাজারের দোকানদারেরাও তো দেখছি বিদেশীদের সাথে টুকটাক ইংরেজি বলে বেচাকেনা করে।’ সামনে আর না যাওয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি তোলার পরও পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগুতে এগুতে গজ গজ করে লাজুর এ কথাগুলো শুনে হৃদয়ঙ্গম করলাম যে, ওহ আমার ভুল হল তাহলে এখানকার সেলসগার্লদের ইংরেজিতে ক অক্ষর গোমাংস সক্ষমতাটাই।
‘আরে ইংরেজি বলতে না পারুক, ঐটা ব্যাপার না। এরা আসলে আমাদের পাত্তাই দিচ্ছিল না। যেই স্টলেই গেছি আমাকে দেখেই সেলসগার্ল সরে গেছে ভিতরে।’ ফোঁড়ন কাটল ভ্রাতুষ্পুত্রদের নিয়ে একটু এগিয়ে হাঁটা থেকে হেলেন, মুখ ঘুরিয়ে।
ঘটনা পরিষ্কার হল আরো এতে। ঐ যে বলেছিলাম আগে, এখানে আসার পর থেকেই নানান জায়গায় চায়নিজদের মাঝে আমাদের উপস্থিতিকে যে রকম অবলীলায় উপেক্ষা করতে দেখেছি, ঐ ব্যাপারটা সম্ভবত ওরা দুজন এই প্রথম লক্ষ করেছে। ফলে ঐ নীরব উপেক্ষার অপমানে সূচ ফুটেছে এই হিমে দুজনেরই গায়ে। যার কারণেই লাজু নয় শুধু, হেলেনের মধ্যেও দেখেছি চরম বিরক্তির ভাব। আসলে জিনিসপত্র বিক্রি করতে দাঁড়ানো সেলসগার্লদের ঐ রকম কিছু করা তো বিক্রিবাট্টা বাড়ানোর গ্রন্থসমূহের সূত্র মোতাবেক মহাপাপই বটে। তদুপরি এ ব্যাপারে মানে পণ্য বিক্রি করা বা গছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের চায়নিজরা ইতিমধ্যেই যে বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ তো আজ এ গ্রহের যে কোনও দেশের যে কোন সুপার মার্কেটে গেলেই সহজে মেলে। তা হলে এখানে এর ব্যতিক্রম কি হলো শুধুই ভাষাগত বিভ্রাটের কারণেই, যখন এখানকার সেলসগার্লরা সবাই হল নতুন প্রজন্মের!
হতেও পারে তা। কারণ প্রথমত এই বেইজিংয়ে এখন পর্যন্ত তেমন সংখ্যক বিদেশীর দেখা পাইনি। তদুপরি এই মার্কেট যে ধরনের ঘর গৃহস্থালির পণ্য বিক্রি করে সে মার্কেটে বিদেশী ক্রেতাদের ঢোকার সম্ভাবনাও কম। ফলে এখানকার বিক্রয়বালকদের কন্যাদের হয়তো বিদেশীদের মুখোমুখি হতে হয় না মোটেই সম্ভবত। তাই হয়তো হঠাৎ করে দুই বঙ্গনারীকে ক্রেতা হিসেবে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ভড়কে গিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে ওরা। কিন্তু কথা হচ্ছে কী এমন মহার্ঘবস্তু এ দুই বঙ্গনারী যে এখান থেকে কিনতে চেয়েছিল তা তো বুঝতে পারছি না !
অতএব তা বোঝার জন্যই বললাম, ঠিক আছে সামনের কোনও মার্কেট থেকে কেনা যাবে ঐসব। ‘আরে দূর নাহ। হেলেন কী কিনতে চেয়েছিল জানি না। আমি যেগুলো কিনতে চেয়েছি সেগুলো অন্য কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’
তা কী এমন দুস্প্রাপ্য জিনিস ওখান থেকে কিনতে চেয়েছ যে ভাবছ অন্য মার্কেটে সেগুলো পাওয়া যাবে না? যাবো নাকি ফিরে তাহলে ঐ মার্কেটে। নাহ থাক এখন না। ফেরার সময় তো এদিক দিয়েই যাবো, তখন না হয় ওগুলো কিনে নেয়া যাবে। তখন আর তোমরা না, আমিই কিনবো। বল কী কিনতে চেয়েছিলে?
‘রান্নাঘরের জিনিস। নানান সব্জি, ফল এগুলো কাঁটার ছোট ছোট বেশ কয়েকটা যন্ত্র, আর মশলা গুঁড়া করার একটা ব্লেন্ডার। বাচ্চাদের জন্য তো প্রায়ই নানান রকম বিদেশী রেসিপি রান্না করতে হয়। ঐগুলো থাকলে সুবিধা হতো।’
পুত্রদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সর্বক্ষণ সজাগ ও উদ্বিগ্ন লাজুর এ উত্তরে বুঝলাম, ভুল বলেনি ও। এসব যন্ত্র অন্যকোনও মার্কেটে যে পাওয়া যাবে তার তো আসলেই ঠিক নেই। নাহ ফেরার পথে দাঁড়াতেই হবে আসলে ঐ লাল বাজারে। মনে মনে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে হেলেনকে জিজ্ঞেস করলাম ও কী কিনতে চেয়েছিল।
‘না না তেমন কিছু না। ঐ ছয়টা ট্র্যাডিশনাল চায়নিজ স্যুপের বাটি, চায়ের কাপ পিরিচ আর ক’টা ফ্লাওয়ার ভাস নিতে চেয়েছিলাম আর কী।’
আরে দূর ওইসবের আবার কী দরকার? ঘর তো বোঝাই ওইসবে। রাখার তো জায়গাই নেই ঘরে। বোনের কথার উত্তরে এই ঠিক কথাগুলোই মনে তুমুল বুঁদ বুঁদ তুললেও মুখ ফুটে তা আর বেরুতে দিলাম না। অন্যদেশের বিবাহিত পুরুষদের কী অবস্থা জানি না। কিন্তু বঙ্গপুরুষ বিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তাকে তার বোনদের সাথে কথা বলতে হয় অতীব সাবধানে। বিবাহ করিবার পূর্বে যে ভাইটি বঙ্গবোনের কাছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম পাত্র ছিল, যার জন্য কী না সে উপযুক্ত পাত্রী পাচ্ছিল না গোটা ভূ সংসারে, সেই ভাইটি বিবাহ করার পর পরই বেকুব, অকর্মা বউ ভেড়ুয়ায় পরিণত হয়ে যায়। অতএব কথাবার্তা বলতে হয় তাকে অনেক হিসাব করেই। এইমাত্র স্ত্রীর ক্রয়েচ্ছায় নির্দ্বিধায় সম্মতি দেবার পর আমি যদি ঐ মনে বুদবুদ তোলা কথাগুলো বলি, তবে খবর আছে আমার! লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক