দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলেয়মান | রবিবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

পেটশপ ফ্যাটশপ বিভ্রাট

নাস্তা পর্ব শেষ করে, রুমে ফিরে গিয়ে বাইরে বেরুবার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে ফের নীচে নামতে নামতে বেজে গেল সাড়ে দশটা। বেরুচ্ছি এখন পদব্রজেই, থাকবো ঘুরে ফিরে এই এলাকাতেই, কারণ আজ তো শপিং ডে। ভাল কথা হল নাস্তা খেতে খেতে সকলকে একটা ব্যাপারে একাট্টা করা গেছে, তা হল আজকের প্রথম অভিযান হবে, অভ্রর সেই পেট শপ খুঁজে বেড়ানোর। ঘোরাফেরা যেহেতু হবে আজ পদব্রজেই, তাই বাইরে ঠাণ্ডা কতোটা সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া জরুরী ছিল।

অভ্র দীপ্র তাদের হাতযন্ত্র মোতাবেক আবাহাওয়ার যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাতে জানা গেছে গত দুইদিনের তুলনায় বেইজিং আজ অন্তত তিন চার ডিগ্রী উত্তপ্ত হয়েছে। তবে রোদের দেখা মিলবে না আজো। আশার কথা বাতাসের প্রকোপ কমেছে। যার মানে হল আজ তাপমাত্রা মাইনাস চৌদ্দ ডিগ্রী হলে, অনুভূতিটাও ওরকমই হবে। তার বেশী হবে না। তদুপরি এরই মধ্যে হয় আমাদের শরীর অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিয়েছে এখানকার তীব্রহিমের সাথে, না হয় হতে পারে প্রথম দিন তিয়েন আন মেন স্কয়ারের তীব্র হিম বাতাসের তোড়ে সেদিনের মাইনাস সতের ডিগ্রী যখন মাইনাস বিশ বা একুশের মতো মনে হচ্ছিল তাতে শরীরের অনুভূতি ভোতা হয়ে গিয়েছিল, তাই গতকাল আজকের থেকে বেশী ঠাণ্ডা হওয়ার পর, কাবু করতে পারেনি তা আমাদের।

সবাইকে নিয়ে হোটেলের বাইরে বেরুবার জন্য এগুতেই, দূর থেকেই আমাদের দেখা পেয়ে কন্সিয়ার্জ ডেস্কের মিস ইনা সহাস্যে হাত নাড়ল। তাতে মনে হল, আচ্ছা মিস ইনার কাছ থেকে একটা খবর নিয়ে বের হওয়াই ভাল। আজ ভোরে ভি পি এন মারফত এখানকার সাইবার ব্যারিকেড ভেঙে গুগুল ম্যাপে ঢুকে ওটি পর্যালোচনা করে, অভ্র সম্ভাব্য যে পেটশপটির খোঁজ বের করেছে, তা এই হোটেলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই ধারণা করছি। তবে সেই এক কিলোমিটার যে দশ দিকের মধ্যে কোন দিকে, তা তো বুঝতে পারিনি দিক কানা ম্যাপ কানা আমি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লুও পাওয়া গেছে গুগুল মামুর কল্যাণে, তা হল ঐ পেটশপটির ধারে কাছে একটা মেট্রো রেলস্টেশন আছে। যদিও পরবর্তীতে ভিপি এন দিয়েও আর গুগল ম্যাপ খুব বেশী ঘাটাঘাটি করা যায়নি সাইবার মহপ্রাচিরের জন্য, হাতের পাঁচ হিসাবে অভ্র যে ঐটির স্ক্রিন শট নিয়ে রেখেছিল সেটিই ভরসা । এখন দেখি মিস ইনা দিতে পারে কি না সেই পেট শপের খবর।

বাকি সবাইকে গেইটের দিকে অগ্রসর হতে বলে হাসিমুখে তাই এগিয়ে গেলাম মিস ইনার কাছে। প্রথমে ভেবেছিলাম সরাসরি তাকে জিজ্ঞেস করি যে এ এলাকায় পেট শপ মানে পোষা পশুপক্ষীর কোন দোকান আছে কি না? কিন্তু যতোই সে আর সব চায়নিজদের চেয়ে ভাল ইংরেজি বলুক না কেন, এরকম একটা অপরিচিত ব্যাপার যা নিয়ে কোন হোটেলবাসির কাছ থেকে কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম , তা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বাংলিশ চিংলিশের ধাক্কাধাকিতে আবার কোন হাঙ্গামা যে হয় তা তো বলা যায় না । পেটশপের জায়গায় সেই অতি সম্ভাব্য ভাষা বিভ্রাটের কারনে শেষ পর্যন্ত না সে আমাকে ফ্যাট শপ মানে “মেদ ভুঁড়ি কি করি মার্কা” কোন চায়নিজ কবিরাজের কাছে পাঠিয়ে দেয় কি না ? তা তো বলা যায় না! নাহ সে ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তার চেয়ে বরং জিজ্ঞেস করি যে আশেপাশের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন জায়গায় আছে এখানকার মেট্রো রেলস্টেশন। গুগুল ম্যাপ মোতাবেক অভ্রর বের করা সেই পেটশপের কাছে বড় ল্যান্ডমার্ক হিসেব যেহেতু ওটা আছে, ওটার খবর পেলেই, প্রয়োজনে সেটার দশ দিকে ঘুরে না হয় বের করে ফেলবো না হয় ঐ পেটশপ। যেই ভাবা সেই কাজ, মিস ইনাকে গিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করলাম যে, এই হোটেলের কাছে ধারে কোন মেট্রো রেলস্টেশন আছে কি না? থাকলে সেটির হদিস দিতে। উত্তর দিতে গিয়ে সবসময়ের অভ্যাসবশত, কন্সিয়ার্জ ডেস্কে মজুদ বেইজিং শহরের ম্যাপগুলোর একটা নিয়ে, সেটি মেলে ধরে ওটিতে আঁকিবুঁকি কেটে, সেই মেট্রো স্টেশনের হদিস দিতে উদ্যত হতেই, ম্যাপ কানা আমি দ্রুত তাকে থামিয়ে বললাম, দেখো দেখো ঐ রকম বিশদ বর্ণনার দরকার নাই। শুধু বলো এই হোটেল থেকে বেরিয়ে ডানে না কি বাঁয়ে গেলে পাওয়া যাবে সেই স্টেশন। আরো বল আছে সেটা কত দূরে, রাস্তার কোন পাড়ে? বলেছিলাম সেব বেশ দ্রুত কথাগুলো। বলা সেই কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করার জন্য কিছুক্ষণ থমকে থেকে মিস ইনা তার স্বভাবমাফিক সুপ্রচুর হাত পা নড়িয়ে চি চি করে বলা চিংলিহশে যে বয়ান দিল, তাতে বুঝলাম হোটেল থেকে বেরিয়ে, ডানে বায়ে যেদিকেই যাই পাওয়া যাবে একটা মেট্রো রেলস্টেশন। তার জিজ্ঞাসা হল যেতে চাই আমরা কোন স্টেশনে?

একবার ভাবলাম বলি যে, জায়গার নাম জানি নাকি যে বলবো তা। আবার ভাবলাম বলি যে, যেতে চাই সেই স্টেশনে যার আশেপাশেই পাওয়া যাবে ঐ পেটশপ। সাথে সাথেই মনে হল, নাহ ওটা বলে আবার সেই পেট আর ফ্যাট বিষয়ক ঝামেলায় পড়ে মেদ ভুঁড়ি কমানোর কোন চায়নিজ কবিরাজ বা আকুপাংকাচারিস্টের পাল্লায় পড়ার দরকার নাই। জিজ্ঞেস করলাম তাই , বল কইন্না সবচেয়ে কাছের যেটা আছে সেটা পেতে যেতে হবে কোন দিকে, আর আছেই বা সেটা রাস্তার কোন পাশে।

উত্তরে বোঝা গেল কাছেরটা আছে ডানে এবং আছে সেটা রাস্তার এ পাশেই।হৃষ্টচিত্তে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গেইটের সামনে আসতেই দেখি, নেই কেউ ওইখানে। তারা কি সবাই এই ঠাণ্ডায় বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকি তবে? এ প্রশ্ন মনে জাগতেই হতেই হোটেলের সেই গোল ঘূর্ণায়মান গেইটের পেট থেকে, হুড়মুড় করে দু পুত্র বের হয়ে মহা উৎসাহে জানালো যে, পাশের ফেরারি শো রুমটি খুলেছে।

তোমাদের মা আর ফুপ্পি কোথায়? ওরা কি বাইরে নাকি?

ঐ যে ওইখানে বসে আছে ওরা বলেই, মা মা, এন এন” বলেই ওদের ডাকতে শুরু করলো দীপ্র । তাতে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখি ওরা এরই মধ্যে গিয়ে বসেছে লবির ডান দিকে পাতা দুটো সোফায়। দীপ্রর ডাকে সোফা ছেড়ে ওরা এগিয়ে আসতেই জানালাম যে, বের হয়ে ডানেই যাবো। মিস ইনার বয়ানে বুঝতে পারলাম রাস্তার এ পাশেই আছে সেই মেট্রোস্টেশন। কপাল ভাল হলেই কাছে ধারেই পেয়ে যাবো মনে হচ্ছে সেই পেটশপ।

বলতে বলতে সপরিবারে ঘূর্ণায়মান গেটের পেটের ভেতরে ঢুকে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলাম অন্তত আমরা তিনজন আজকের দিনের প্রথম হিমঝাপটার। তবে এরই মধ্যে গায়ে সয়ে যাওয়ার কারনেই হউক, কিম্বা ঠাণ্ডার তীব্রতা কমে যাওয়ার সাথে বাতাসের ঝাপটা না থাকায় হউক, গত দুই দিনের মতো আর কেউ কুঁকড়ে গেলাম না।

বাবা, বাবা, চল আমরা ফেরারি শো রুমে যাই। তুমি না বলেছিলে ছবি তূলে দেবে ওটার ভেতরে গিয়ে । এখন তো ওটা খোলা আছে।”

গেইট থেকে বেরিয়ে সবাইকে নিয়ে ডানে যাওয়ার উপ্রক্রম করতেই দীপ্রর ঐ কথায়, স্থগিত করতে হল তা। ঠিক আছে চল সবে।

আমরাও কি যাবো নাকি?” হেলেনের এই জিজ্ঞাসার উত্তরে বললাম যদি ফেরারি গাড়ীর সাথে ছবি তুলতে চাস তবে চল। অবশ্য সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে কি যে মনে করে ওরা ? খুব বড়ও তো নয় মনে হচ্ছে এই শো রুমটা।

না আমি যাবো না। এই ঠাণ্ডায় এখানে দাঁড়িয়ে ও থাকতে পারবো না । তোমরা ছবি তূলে আসো। আমি গিয়ে ফের ভেতরে বসি” বলে লাজু হোটেলের ঢোকার জন্য ফের সেই ঘূর্ণায়মান গেইটের পেটে ঢুকে যেতেই, ফের ভাবি ননদের আরেকটি বিরল ঐক্যমত্যের দেখা মিলল।

অতএব পুত্রদ্বয়কে, নিয়ে এগুলাম বাঁ দিকের এই হোটেলেরই সম্ভাব্য অংশ সেই ফেরারি শো রুমের দিকে।

শো রুমের দরজার দিকে এগুতে এগুতে এ মুহূর্তে শো রুমের ভেতরের হালচাল বোঝার জন্য এর সামনের কাঁচের দেয়ালের ওপাশে চোখ ফেলতেই, সেই লাল ফেরারিটা ছাড়া আর কোন কিছুই নজরে পড়লো না ।

যদিও পুত্রদের সেদিন আশ্বস্ত করে বলেছিলাম যে ওদেরকে শো রুমের ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঐ গাড়ি দুটোর সাথে ছবি তূলে দেব, এখন শুধু ছবি তোলার জন্য তাতে ঢুকতে গিয়ে কেমন যেন লাগছে মনে। ভাবছি কি যে ভাববে শো রুমের চায়নিজরা!

শো রুমে ঢোকার মুখে হঠাত করে এই আড়ষ্টতা এসে ভর করলেও সেটিকে পাত্তা না দিয়ে, ভেজিয়ে রাখা ফ্রস্টেড কাঁচের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে পা রেখে সামনে তাকাতেই, ঠিক দরজা বরাবর ছয় সাত ফিট দূরে থাকা চমৎকার ডিজাইনের টকটকে ফেরারি লাল কাউন্টারের পেছনে একটা উঁচু টুলে, সাদা খাটো টপস, আর লাল মিনিস্কার্ট পরে বসে থাকা এক চাইনিজ ফেরারি কন্যার দিকে নজর গেল। চাইনিজ ব্র্যান্ডের তার চোখ যতোটা পারা যায় বড় করে এই দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই, মাথা নড করে বললাম গুড মর্নিং।নাহ, কোন উত্তর তো পেলামই না, না আমার নডের, না গুড মর্নিং এর। পায়ের উপর লম্বা তার সারস পা মডেলের কায়দায় ভাঁজ করে নিস্পলক আমাদের দিকে তার চুপচাপ তাকিয়ে থাকা দেখে একবার মনে হল এটা কি কোন ম্যানিকিউর নাকি? আবার মনে হল নাকি এ হল ফেরারি মডেল। যার কাজ হল এভাবে বসে থাকাই শুধু। পোশাকে আসাকে চেহারা আর সজ্জা মিলে মনে হচ্ছে এই ফেরারি শো রুমের মালিক এক বুঝি, সরাসরি বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে আমাদনি করে বুঝি এইখানে বসিয়ে দিয়েছে। যতোই চমৎকৃত হই না কেন এর সৌন্দর্যে, এ পর্যন্ত তার যে ভাবভঙ্গীর মুখোমুখি হয়েছি তাতে বরং একটু আগে যে অস্বস্তিটি হঠাত হাজির হয়েছিল মনে, তা শুধু বাড়লোই।নাহ বেশিক্ষণ থাকা যাবে না এখানে। এ সম্ভবত আমাদের চিড়িয়া ঠাউরেছে। সম্ভাব্য ক্রেতাদের সাথে নিশ্চয় তার ব্যবহার এরকম হয় না। তদুপরি আমাদের গায়ের রং আর চেহারার কারনে এই সাত সকালে আমাদের দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝি বিরক্তই হয়েছে। তারপরেও, লজ্জার মাথা খেয়ে ফের তাকেই সবিনয়ে বললাম, দেখো আমার ছেলেদের খুব সখ তোমাদের এই গাড়ী গুলোর সাথে ছবি তোলার তাই ঢুকেছি।বললাম তো ফের কথা, কিন্তু পেলাম উত্তর ফের সেই নীরবতাই। অতএব মৌনং সম্মতি লক্ষণং কে আপ্তবাক্য ধরে নিয়ে দু পুত্রকে বা দিকের লাল ফেরারিটির পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বললাম। একই সাথে বলে দিলাম ভুলেও যাতে ঐ গাড়ীর গায়ে হাত না দেয় তারা বা তাতে ঠেস নিয়ে না দাঁড়ায়। নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বলা কথায় কান দিয়ে বললাম এসব পুত্রদের মহানন্দে দুজনেই ওরা শো রুমের অভ্যন্তরে গিয়ে গাড়িটা থেকে সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে হাসি মুখে পোজ দিয়ে দাঁড়াবার পর, পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওদের দিকে তাক করতেই পেছন আর পাশ থেকে বেশ উচ্চ কণ্ঠে ধ্বনিত নো নো র সাথে চিং চং চুং চাং চায়নিজ ধ্বনি ভেসে আসতেই হকচকিয়ে ডান দিকে ঐ কাউন্টারের পেছনে ম্যানিকিউরের দিকে তাকাতেই দেখলাম , মুখে তার ফুটেছে কথা । তবে তার কথার সাথে পেছন থেকেও ভেসে আসছে একই জাতিয় ধ্বনি। ঘুরে ওদিকে তাকাতেই দেখা মিলল একই পোশাকের আরেক ফেরারি কন্যার । বেশ বিরক্ত ও অনেকটাই মারমুখী ভঙ্গি তার। মুখে ফুটছে খই “নো নো। নো পটো । ন পটো। গো গো !”

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেপরোয়া ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেল
পরবর্তী নিবন্ধসরকারি স্কুলে ভর্তিতে লটারি: ভালো ফলাফলের চ্যালেঞ্জ আসছে সামনে