দেশ হতে দেশান্তরে

হাতের মুঠোয় পৃথিবী

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাতিশের পর)

বাহ, এ তো দেখছি অভ্রর চমৎকার পরিবর্তন! নাহ, অ্যাপেল কোম্পানির নানান বিপণন কৌশলের ফলাফল হিসাবে এ কোম্পানির পণ্যের ব্যাপারে আগে থেকেই অভ্রর যে আছে আইপণ্যের উপর প্রবল আস্থা, তা তো জানাই। ভাবছি এখন, ও তো কুনমিংয়ের রাস্তায় সাক্ষাৎ ফেরারি, রোলস রয়েস দেখার পর তুমুল উত্তেজিত হলেও, একসময় কিন্তু সে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে ওইগুলি আসলেই আসল কি না? নাকি ওগুলো সব চায়নিজ , মানে নকল। কিন্তু এখানে তো দেখছি সে একদম নিশ্চিত যে এই বিটস ফোনের সবই ঠিক আছে। এ কি তাহলে এই স্টোরের সেই ভেল্কি, দেখাতে চেয়েছিল যে স্টিভ জবস? যদিও এই স্টোরটিও আছে চায়নারই বুকে– ‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলো এবার। ওদের তো খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।’

যদিও মনে মনে ভাবছিলাম অতি দ্রুতই এখানকার কর্ম যেহেতু সম্পাদন হয়ে গেল, এখন তাহলে একটু গোটা স্টোরটা ঘুরে দেখি। মনে হচ্ছে বেইজম্যান্টেও এই স্টোরের একটা অংশ আছে। সেটাও একটু ঘুরে দেখা গেলে ভাল হতো। কিন্তু লাজুর উপরোক্ত তাড়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বলে ফেললাম, হুম তা যাওয়া যায় এখন। হেলেন কোথায়?

এন ? ঐ তো এন।’ গলা উঁচু করে ফুপ্পিকে একবার ডেকেই, দ্রুত এগিয়ে অন্যপাশের একটা টেবিলের উপরে থাকা কোন একটা আইপণ্য গভীর মনোযোগে পরখ করায় ব্যস্ত হেলেন হাত ধরে টেনে আনতে লাগল অভ্র।

কি মনু, কেনা হয়ে গেছে তোমার হেডফোন ? দেখি তো ওটা একটু।”

না, না এটা এখন দেখা যাবে না। খুলিনি তো এটা এখনো। রুমে গিয়ে দেখো।’

কেন টেস্ট করে দেখে নেবে না ?’

না, না এটা ঠিক আছে। টেস্ট করা লাগবে না। যদি কোন কিছু ঠিক না থাকে, কাল এখানে এসে তা দেখালেই তারা এটা বদলে দেবে।’

বাইরে বেরুতে বেরুতে পেছনে দীপ্রর ও হেলেনের ঐ কথোপকথন কানে যেতেই বুঝলাম যে, এই সামান্য ব্যাপারটিও একদিকে যেমন জেনারেশন গ্যাপের ব্যাপার, অন্যদিকে এটা ঐ অ্যাপেল কোম্পানির বিপণন দক্ষতার প্রমাণও বটে।

এই কোম্পানির পণ্যের ব্যাপারে নিশ্চয় আমার কিম্বা হেলেনেরও আস্থা আছে। কিন্তু আমরা দুজনেই মানি যে, কোন ইলেকট্রিকক্যাল বা ইলেক্ট্রনিকস পণ্য কেনার পর, দোকানে তা পরখ করে নিতে হয়। এ ব্যাপারটি আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। তারা এই আইপণ্যের উপর এতোটাই আস্থাবান যে, কেনার সময় ঐসব পণ্য চালিয়ে বাজিয়ে দেখাটাকে অনর্থক মনে করছে!

তবে এ তো এমনি এমনি আর তৈরি হয়নি। হয়েছে তা ঐ কোম্পানির মানুষের হাতের মুঠোয় পৃথিবী এনে দেয়ার দুর্দান্ত উদ্ভাবনী ক্যারিশমার সাথে পণ্যের কঠোর মান নিয়ন্ত্রনের যোগফলে। না এ শুধু তাই নয়। এর সাথে আরো অন্তত দুটো ব্যাপার আছে। যার প্রথমটি হল ক্রেতাসেবার ব্যাপারে এদের সুনিশ্চিত নিশ্চয়তা। দ্বিতীয়টি সবকিছু নিয়ে তৈরি করা এদের সুসমন্বিত বিপণন কর্মকাণ্ড। এইসব কিছু মিলিয়ে এরা যা তৈরি করেছে, অন্তত আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মনোজগতে, একেই তো বিপণনের নানান পাঠ্যবইয়ে বলে ব্র্যান্ড ভ্যালু, ব্র্যান্ড ইমেজ বা ইকুইটি। হ্যাঁ পেশাগত কারণে এই ব্যাপারটা বইপত্রে, ম্যাগাজিনে নানান সময়ে পড়লেও আজ যেরকম প্রত্যক্ষভাবে বুঝলাম, তা তো বুঝিনি, আগে!

এছাড়াও আরেকটি ব্যাপারে আজ আমার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল, তা হলো, এরা স্টোরের কর্মীদের নানা ট্রেনিং দিয়ে এমনি চোখা বানিয়েছে যে, এই প্রথম একজন চায়নিজের ইংরেজি শুনে আমার মোটেও মনে হয়নি যে, শুনছি চিংলিশ । তদুপরি দেখলাম স্টোরের ঐ অ্যাপলম্যানের কথাবার্তা আর আচরণে বুদ্ধিদীপ্ত সেলসম্যানশিপের ঝলকও ।

আমাকে প্রশ্ন করার সময় দুই ছেলের জন্য দুটো আনতে হবে, নাকি আমার জন্যও একটা আনতে হবে হেডফোন জিজ্ঞেস করেছে সে ইঙ্গিতে। আর তা সে এমনভাবেই জিজ্ঞেস করেছে, সেলসম্যানশিপের নানান কেতাবি কায়দা সম্পর্কে যার ধারণা নেই, সে ভুলেও টের পেত না যে এ হল ক্রেতার ঘাড়ে প্রয়োজনীয় পণ্যের অতিরিক্ত পণ্য গছিয়ে দেবার একটা কৌশল। আমি বুঝেছি , কারণ এ নিয়েই তো কাটালাম পেশাগত জীবনের পুরোটা সময়ই !

বাবা, বাবা, এখানে আসো! তাড়াতাড়ি আসো! দেখে যাও! দেখে যাও’। পেছন থেকে দীপ্রর উত্তেজিত গলা কানে যেতেই, ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, ওদেরকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেছি নিজে অনেক। কারণ আনমনে ভাবছিলাম তো আজকের ভোগবাদী পুঁজিবাদী সমাজে নানান পণ্য মানুষের হাতে গছিয়ে দেবার নানান কায়দা কানুন নিয়ে। যার ফলেই কি না মানুষের জীবন আজ বন্দি হয়ে গেছে নানান কোম্পানির নানান পণ্যে পণ্যে।

পুত্রের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘুরে পিছু হাঁটতে হাঁটতে ওদের দিকে তাকিয়ে বোঝা গেল, দাঁড়িয়ে আছে তারা একটা অতি উচ্চবংশীয় স্টোরের সামনে । খুব বেশি দূরে নয় সেটা ঐ অ্যাপেল স্টোরের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅহংকার মারাত্মক এক ব্যাধির নাম
পরবর্তী নিবন্ধএক মানবতার ফেরিওয়ালার কথা বলি