ঘটনা, মানে কী ধরনের দুর্ঘটনা যে ঘটেছে ঐখানে, তা তো আর বুঝাতে পারছি না এতো দূর থেকে! তবে ওই স্ট্রেচার নিয়ে লোকজনদের দৌড়াতে দেখে, ঘাবড়ে গেলাম ভালোই নিজে। একবার ভাবছি তা হলে কি স্কেটিং করতে গিয়ে বা স্কিইং করতে গিয়ে একজন আরেকজনের সাথে টক্কর লেগে হাত পা ভাঙলো নাকি একাধিক জন, নাকি ঘটেছে আরো গুরুতর কিছু? ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তে পায়ের দিকে নজর যেতেই ভয়ের একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে। মনে হল দাঁড়িয়ে আছি তুমুল ঝুঁকিপূর্ণ এক জায়গায়। আমাদের পায়ের নীচের বরফ মেঝেটা নিরেট সাদা বরফ তো নয়! স্বচ্ছ পানির রঙের এই বরফ দেখে মনে হল এর সামান্য নিচেই টলটল করছে হিমশীতল জল। এখানটায় বরফ তো মনে হয় তত পুরু নয়! পুরু হলে তো নিরেট সাদা রঙের হতো এই বরফের রং। এছাড়া এদিকটায় আমরা তিন বঙ্গসন্তান ভিন্ন অন্য কোনো লোকজনই তো নেই। এক্ষুণি যদি পায়ের তলার পাতলা বরফ ভেঙে গিয়ে পড়ি তিনজনে বরফ শীতল জলে, তবে কী হবে অবস্থা আমাদের!
কী যে হবে অবস্থা? তা নিয়ে চিন্তা করারও সাহস হল না মনে। বরং কালবিলম্ব না করে দ্রুত পুত্রদের বগলদাবা করে দিলাম ফিরতি হাঁটা। তবে হাঁটা শুরু করেছি আরো কিছুটা ডানে সর, যেখানে বরফের রং একদম ধবধবে সাদা না হলেও ঘোলাটে রঙের সাদা। এই এতক্ষণ যেই স্বচ্ছ বরফের উপরে দাঁড়িয়েছিলাম, তার চেয়ে এখন যেদিক দিয়ে হাঁটছি সেটাকেই অনেক নির্ভরযোগ্য মনে হল।‘বাবা, বাবা, ওখানে কী হয়েছে? আর আমরা এতো তাড়াতাড়ি হাঁটছি কেন?’
পুত্রদের যুগল কণ্ঠের যুগল প্রশ্নদ্বয়ের প্রথমটির উত্তরে বললাম, স্কেটিং করতে গিয়ে বা স্কিইং করতে গিয়ে একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা লেগে, পড়ে গিয়ে হাত পা ভেঙেছে হয়তো। আর ওদের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে, কমিয়ে দিলাম এগুনোর গতি। কারণ আসলেই তো, মনে মনে ঘাবড়ে গিয়ে যে রকম দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করেছি, তাতে যে কোনো একজন পিছলে পড়লেই বাকি দুজনকেও পিছলে পড়তে হবে বরফের উপর।
আর ওরকম পিছলে পড়ে হাত পা ভাঙলে, ওই স্ট্রেচারধারী লোকজন তো তা দেখতেই পাবে না। যেহেতু আছে তারা অনেক দূরে। যে জায়গাটি দিয়ে নেমেছিলাম আমরা, লেইকের সেই পাড়েও তো দেখিনি কোনো উদ্ধারকারী জাতীয় কোনো লোকজন। আমাদেরই দলের দুই বঙ্গনারী ব্যতিত আর কেউ তো নেই ওখানে,
ওদের কথা মনে হতেই, কী না মনের আয়নায় এসময় ভেসে উঠল ভয়াবহ এক দৃশ্যপট, যে দৃশ্যে দেখতে পেলাম আমাদের পায়ের নীচের বরফ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো হঠাৎ। ফলে দুই পুত্রসমেত পড়লাম এক্কবারে রক্ত জমিয়ে দেয়া জলে। হাবুডুবু খেতে লাগলাম তিনজনে। নিজের দুই হাত দুইপুত্রের হাত ধরে রাখায় নিজের তলিয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারছি না। অন্যদিকে পুত্রদ্বয় ডুবতে ডুবতে তাদের মুক্ত হাত উঁচিয়ে চিৎকার করতে করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভেসে থাকার। ওদের চিৎকারে পাড়ে থাকা ওদের মা আর ফুপ্পি হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো সাহায্যের আশায় চিৎকার করতে করতে নামছে লেইকের পাড় বেয়ে। তবে কপাল ভালো যে আমাদের গায়ের মোটা জ্যাকেটগুলোতে সম্ভবত বেশ কিছু বাতাস ঢুকে ছিল, যার ফলে ডুবছি না কেউই ঝুপ করে।‘বাবা, এই লেইক থেকে উঠে, আমরা কি এখনি ফিরে যাবো হোটেলে?’
যাক বাঁচা গেল! দীপ্রর এই প্রশ্নে সেই, চোখের সামনে থেকে ভীতিকর সেই দৃশ্যটি নেই হয়ে গেল। জানি না কুনমিং লেইকের জমাট বরফের উপর দিয়ে ক্রমাগত শোঁ শোঁ করে বয়ে যাওয়া হিম বাতাসের মধ্যে বরফের উপর দিতে হাঁটতে গিয়েই কাঁপন ধরল নাকি সারা গায়ে আমার? নাকি হচ্ছে তা একটু আগে চোখের সামনে ভেসে উঠা তুমুল ঐ ভীতিকর দৃশ্যটির কারণেই। কারণ যাই হোক, বুঝতে পারছি যে কাঁপতে শুরু করেছে শরীর। কিন্তু ছেলেদের হাত ধরে রাখা নিজের হাত বেয়ে সে কাঁপুনি যেন ওরা টের না পায়, প্রাণপণ চেষ্টায় তা থামাতে চেষ্টা করছি নিজেকে সামলে।
‘তোমার কি খুব ঠাণ্ডা লাগছে নাকি, বাবা?’ অভ্রর এই প্রশ্নে বোঝা গেল, নাহ, বিফলেই গেছে আমার সে চেষ্টা!
হ্যাঁ বাবা, খুব ঠাণ্ডা লাগছে। দ্রুত এ কথা বলে মনের তীব্র ভয়ের ব্যাপারটি ধামাচাপা দিতে দিতে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁফ ছাড়লাম। আর বড়জোর মিটার পাঁচেক দূরেই দেখছি কুনমিং লেইকের পাড়। সেখানে চোখেমুখে ভীষণ উদ্বেগ মেখে দাঁড়িয়ে আছে লাজু আর হেলেন! জানি না তারাও কি লেইকের মাঝের ঐ দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখেই অরক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো নাকি।
সে যাক, এবার আর নিজে আগে পাড়ে না উঠে, একে একে পুত্রদ্বয়কে উপরে উঠিয়ে দিতে দিতে হৃদয়ঙ্গম করলাম, আমাদের সেই কথাটা কতোটা সত্য। মানে বলছিলাম আর কি ওই যে বলে না, মানুষকে বনের বাঘে না, মনের বাঘে খায়। একটু আগে অবস্থা তো হয়েছিল তাই আমার!
“যাক, বাঁচা গেছে। লেইকের আরো ভেতরে যাও তোমরা। আমি তো ভয়ে মরেই যাচ্ছিলাম।, ভাবছিলাম তোমরা বুঝি ঐ লেইকের মাঝের ওই ভিড়ের কাছেই যাচ্ছ কি না। সারক্ষণই মনে হচ্ছিল যদি ভেঙে পড়ে তোমাদের পায়ের নীচের বরফ! ’
‘এই মনু, পিকাসো তোমরা ভয় পাওনি এই লেইকের উপর দিয়ে এভাবে হাঁটতে। আমারও তো ঐ রকমই মনে হচ্ছিল! মনে মনে সারাক্ষণই আমি দোয়া দরুদ পড়ছি যাতে তাদের পায়ের নীচের বরফ না ভেঙে যায় ‘লাজুর কথার পিঠাপিঠি হেলেনের এই কথায় মনে হল, আরে এ কি টেলিপ্যাথি নাকি? তিনজনেই তো দেখছি আমরা বন্দি হয়ে পড়েছিলাম একই ট্যালিপ্যাথিক ভয়ের জালে!মা আর ফুপ্পির মনের ওই তীব্র আশঙ্কার ব্যাপারটি মনে হয় দীপ্র বুঝতে পারেনি, ফলে সে নিজ কৃতিত্ব জাহির করার জন্য বলে উঠলো-‘আরে আমিই তো প্রথম দেখে বাবাকে বললাম যে ওখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
‘এক্সিডেন্ট? কোথায় হল এক্সিডেন্ট? কী হয়েছে?”
‘বরফ ভেঙে মানুষ ডুবে গেছে নাকি?’
দীপ্রর কথার বিপরীতে যাথাক্রমে লাজু আর হেলেন উপরের কথাগুলো বলে উঠতেই বুঝলাম, লেইকের মাঝখানের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ব্যাপারটি নজরেই পড়েনি ওদের। আর পড়বেই বা কীভাবে? ওরা তো সারাক্ষণই তাকিয়ে ছিল মনে হয় আমাদের দিকেই।
‘ঐ যে, ঐ যে দেখছো না। ঐ যে দুটো স্ট্রেচারে করে মনে হচ্ছে ইনজুড়দের নিয়ে যাচ্ছে।’ মা আর ফুপ্পির দৃষ্টি লেইকের মাঝখানের সেই ভিড়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা দীপ্রর এই কথার পিঠে অভ্র জানালো
‘না না, দুটো না তিনটা। না ওই যে দেখো চারটা স্ট্রেচার।’
ওদের এই বাতচিতে এতক্ষণ পর ফের লেইকের মাঝখানের রং বেরঙের উৎসবমুখর সেই ভিড়টির দিকে নজর দিতেই মনে হল, ঐখানকার উৎসবমুখর ভাবটা এখন আর নেই। কেমন যেন ছত্রভঙ্গ একটা অবস্থা ওখানটায় এখন। এছাড়া আলোও কমে এসেছে চারদিকে। লেইকের বুকজুড়ে যে ধোঁয়াশা ছিল এতোক্ষণ, তার ঘাড়ে মনে হচ্ছে ক্রমশ জেঁকে বসছে আসন্ন সন্ধ্যার আঁধার।
‘না না, আর এখানে থাকা যাবে না। চল চল গাড়িতে চল। ঠাণ্ডাও বাড়ছে মনে হচ্ছে।’ শীতকাতুরে হেলেনের এই কথায় এসময়ে অকপটে লাজুও সায় দিয়ে, আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই দেখি দুপুত্রকে দুজনে টেনে রওয়ানা দিল গেটের দিকে। অগত্যা কথা না বাড়িয়ে অনুসরণ করলাম নিজেও।
হাঁটছি ওদের পিছু পিছু কিন্তু ভাবছি মনে, চলে যাবো কি তবে এতোই দ্রুত এইখান থেকে? যদিও জানি না কতক্ষণ থাকা যাবে। এদিকে সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে, কিম্বা হয়েই গেছে সন্ধ্যা হয়তো বা, কিন্তু তাতে কী? কেউ তো আর এক্ষুণি বের হয়ে যেতে বলছে না। এইরকম একটা ঐতিহাসিক জায়গা এসে শুধু একটু লেইকের বরফে হেঁটেই চলে গেলে কি চলে নাকি? চারদিকে ফের একবার নজর বুলিয়ে মনে হল, আসলে সামার প্যালেস দেখার জন্য কমপক্ষে পুরো একদিন বরাদ্দ করা দরকার ছিল। আরে এই লেইকের পুরোটা ঘুরতেই তো চলে যাবে আধাবেলা। তার উপর ঐ যে আয়ুষ্মান পাহাড় আছে ঐ পাড়ে, ওইখানে যে রাজ প্রাসাদ, প্যাগোডা সহ নানান স্থাপনা আছে ঐগুলোর সবই নাকি যাদুঘরে পরিণত হয়েছে। সে সব শুধু একনজর দেখতেও তো আধা বেলা পার হয়ে যাবার কথা। আমার এই ভাবনার জেরে হঠাৎ করে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বললাম– এই, তোমরা সবাই গিয়ে বস গাড়িতে। আমি একটু দেখে আসি বা দিকের এই পাড়টা ঘুরে। মনে মনে ইচ্ছা আসলে আমার ঐ লংজিবিটি পাহাড় পর্যন্ত যাওয়া। কিন্তু এখনি যদি তা বলি, তবে নিশ্চিত সে ইচ্ছা আমার নিষেধাজ্ঞার খাড়ার নিচে পড়বে। বললাম না তাই সে কথা।
আমার এই ঘোষণায়, গেট পেরুতে পেরুতে পেছন ফিরে তাকিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও লাজু ‘ঠিক আছে। তবে দেরী করো না কিন্তু।’ এক্কেবারেই অভাবনীয় ভাবে স্ত্রীর এরকম সম্মতি পেয়ে যেতেই বলতেই আনন্দে টগবগ হয়ে যাকে বলে লেফট টার্ন, করে হাঁটা ধরলাম লেইক পাড় ধরে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক











