একটু আগে সবাইকে গাড়িতে উঠার তাড়া যে দিয়েছিলাম তার প্রতিক্রিয়ায়, এই প্রথমবারের মতো স্বামীআজ্ঞার বিপরীতে স্ত্রীদের অবশ্য করণীয় বিষয়ক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে, সাড়া দিল লাজু সোৎসাহে সবার আগে। আসলে ও তো আগেই পণ করেছিল একবার গাড়িতে উঠে বসতে পারলে, নামবে না সে আর এই বেলা। কিন্তু পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা আর ঝুলতে থাকা বরফের অপূর্ব দৃশ্য, তার সেই প্রতিজ্ঞা যেমন ভুলিয়ে দিয়েছিল, তেমনি ভুলে গিয়েছিল হয়তো সে তার পায়ের ব্যথাও। নেমে পড়েছিল তাই সেও আর সবার সাথে।
আসলে খুব ভাল খোঁজ খবর না নিয়ে, কোন জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার এটাই হয়তো এক ভিন্ন রকমের মজা। তাতে হঠাৎ করে এরকম অভাবনীয় কোন কিছু যদি সামনে পড়ে, তবে এতে আমেরিকা আবিষ্কারক কলম্বাস বা ইউরোপ থেকে ভারতে আসার নৌপথ আবিষ্কারক ভাস্কো ডা গামা হওয়ার মজা পাওয়া যায় কিছুটা হলেও। আজকাল গুগলের কারণে এমনিতেই এরকম মজা পাওয়ার সম্ভাবনার পারদ নেমে গেছে অনেক নীচে। এ কথা ভেবে চিন্তে না হলেও, ব্যস্ততার কারণে যে এই ভ্রমণের আঁতিপাঁতি গুগল করে আগে জেনে রাখিনি তাতে মাঝে মাঝেই নিজের উপর বিরক্ত হলেও, এখন তো মনে হচ্ছে এ এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে!
সে যাক, আমার ডাকে বিশ্রামপ্রত্যাশী লাজু দ্রুত সাড়া দিলেও বাকীরা দেখছি গা করছে না। দুপুত্র এরই মধ্যে পাহাড়ের গায়ে থমকে বরফ হয়ে থাকা ঝর্নার, নাকি গড়িয়ে চুইয়ে পড়া পানির জমাট সৌন্দর্য উপভোগ করা বাদ দিয়ে , নানান গাছের নীচ থেকে বরফের টুকরা তূলে তূলে ঐ পাহাড়ের দিকে ছুঁড়ছে। ওদের ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে আমি যে তাড়া দিইয়েছিলাম, তা বোধহয় কানেই যায়নি ওদের। অতএব ফের রাস্তা পার হয়ে দুজনকে বগলদাবা করে গাড়িমুখো হাঁটা দিয়ে , হেলেনকে তাড়া দিতেই, রওয়ানা করলো সেও।
গাড়িতে উঠে সবাই যার যার জায়গামতো যুৎ করে বসতেই , সবশেষে বিনা বাক্যব্যয়ে লি খাঁ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি জ্যান্ত করে তূলে সামনের দিকে এগুতেই, পেছন থেকে প্রশ্ন এলো লাজুর কাছ থেকে প্রথমত, যাচ্ছি কোথায়? দ্বিতীয়ত লাগবে কতোক্ষন ওখানে যেতে?
যেতে তো বলেছি সামার প্যালেস। কতোক্ষণ যে লাগবে তা তো জানি না। আর তাকে জিজ্ঞেস করেও এর উত্তর বের করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। বলতেই ও বলল
“আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমাবো আমি। এই অভ্র চুপচাপ বসে থাকবে নড়াচড়া করবে না। আমি একটু ঘুমাই।”
“পিকাসো বাচ্চা ঠিক আছে তুমি সামনে চলে আসো আমাদের সাথে, মা’কে ঘুমাতে দাও।” লাজুর কথার পরিপ্রেক্ষিতে হেলেনের ডাকে সাড়া দিয়ে এসময় অভ্র যে দ্রুত সামনে চলে এলো হেলেনের পাশে, বুঝতে পারলাম তা মাথা না ঘুরিয়েও। আমার ধারণা অচিরেই তারাও ঘুমিয়ে পড়বে সবাই। কারণ ঐ মহাপ্রাচিরের উঠানামার ধকল নিজেও তো পাচ্ছি টের । শুধুই ঐ ধকল না, এতোক্ষণ বাইরের হিমের সাথে, বেড়ে যাওয়া বাতাসের ঝাপটায় তিন চার স্তরের গরম কাপড়ের নীচে থেকেও বাঙালি শরীর আমাদের এক্কেবারে সিটকে ছিল। গাড়ির হিটারের ওম ওম গরমের আদর পেয়ে মনে হচ্ছে সে শরীর এখন একদম হাত পা ছেড়ে দিয়েছে নিশ্চিন্ত আরামে। ফলে ঘুম ঘুম লাগছে আমারও। কিন্তু তা তো আমার করা চলবে না কিছুতেই । গাড়িতে ওঠার আগে যতোই হিম থাকুক না বাইরে , গাড়িতে রাখা খাওয়ার পানির বোতল থেকে একটু পানি হাতে নিয়ে এক্কেবারে চোখে মুখে না হলেও শুধু চোখে হলেও ছিটিয়ে দেয়া দরকার ছিল। এখন তো আর তা করার উপায় নেই। চলছে গাড়ি চলুক সামনে, আমি বরং বাইরেটা দেখি।
আমাদের ফেরত যাত্রার শুরুতেই ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের জানান দিয়েছিল যে যাচ্ছি আমরা নতুন পথে। অচেনা জায়গায় এসে শুরুতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কথায় কান দিতে না চাইলেও, অচিরেই যখন আসার পথে দেখা স্কুলঘর মার্কা বিল্ডিং দেখতে পাইনি, তাতে ষষ্ঠইন্দ্রিয় যে ঠিক ছিল তা মোটামুটি ভাবে প্রমাণিত হলেও, একদম নিশ্চিত হয়েছিলাম একটু আগের ঐ বরফ জমা পাহাড়টি দেখে। এখন দেখা যাক এ পথে আর নতুন কোন কিছুর দেখা পাই কি না।
বাইরে মনোযোগ দেবার আগে, সাবধানতা হিসাবে লি খাঁর দিকে একটু কাত হয়ে, চোখ রাখলাম স্পিডোমিটারে। নাহ খুব একটু জোরে চালাচ্ছে না গাড়ি। মোটামুটি আশি কিলোমিটারেই স্থির আছে লি খাঁ। স্বস্তি পেলাম তাতে। তবে কথা হচ্ছে, এই রাস্তাটা কি ওয়ান ওয়ে কোন রাস্তা নাকি? এর মধ্যে তো কোন গাড়িকে উল্টা দিক থেকে আসতে দেখিনি। আর পেছন থেকেও কোন গাড়ি পার হয়নি আমাদের। ঘটনা কি ?
ঘটনা যাই হউক, পরবর্তী পাঁচ সাত এমনকি দশ মিনিটের মতো পার হলেও উল্টা দিক থেকে কোন গাড়ি যেমন আসতে দেখলাম না। আশে পাশে দৃশ্যও বদলালো না তেমন। পাহাড়ি সবুজে ঘেরা রাস্তা। মাঝে মাঝে নানান জায়গায় গাছের নীচে জমে আছে বরফ, এসব দেখতে দেখতে একঘেয়ে চোখ ফের ঘুমে ঢুলু ঢুলু করতে লাগলো। গাড়ির পেছন থেকেও কারো কোন নড়াচড়া বা কথাবার্তা না শোনাতে ধরে নিলাম ঘুমিয়ে গেছে ওরাও। আমারও তুমুল ইচ্ছা হচ্ছে পিঠটা সিটে এলিয়ে দিয়ে এ পশলা ঘুম দিয়ে নিতে। কিন্তু তা তো করা যাবে না, কারণ সেই পুরানো ভয়। যদি আমার সেই ঘুম লি খাঁর চোখেও সংক্রমিত হয়!
অতএব বসে থেকেই বারবার হাত উপরে উঠিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে তাড়াতে চাইছি ঘুম। অথচ আমি নিশ্চিত এক্ষুনি যদি পেতাম হোটেলের দুগ্ধ ফেননিভ সেই আরামদায়ক নরম বিছানা, নিশ্চিত ঘুম আসতো না, আসছে যা এখন। ঘুমের এই কুটিল ষড়যন্ত্রের কারণে, মনে মনে তাঁর গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে, শেষ চেষ্টা হিসাবে লি খাঁ কে বললাম, চাচা মিয়া একটা সং লাগাও তো দেখি ।
কপাল ভাল যা বলেছি, তার মধ্যে শুধু এ মুহূর্তের অতি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ‘সং’ টাই বুঝতে পেরেছে লি খাঁ। আর যে কোন ভাবেই হউক, একই সাথে সে এও বুঝতে পেরেছে যে, বলেছি কথা তার উদ্দেশ্যেই। ফলে আমার দিকে তার অবিচল চোখে মুখে তাকিয়ে একটু নড করে, স্টিয়ারিং এ হাত রেখেই চালু করে দিল গাড়ির ডি ভি ডি।
জানি না, কোন চায়নিজ উচ্চাংগ সঙ্গীত নাকি পল্লিগীতি লাগালো কি না। চিকন চি চি মহিলা কণ্ঠে যে গান বাজছে, তা যদি কোন পল্লিগীতিও হয় তাও যে সে আমাদের নীনা হামিদের কণ্ঠের মতো উঁচু তাল লয়ে যে গাইছে না, এ বিষয়ে আকাট মুর্খ হলেও বুঝতে পারছি তা। এই গানে বেশিক্ষণ মনোযোগ দিলে ঘুম যে আসবেই তা নিশ্চিত। তদুপরি বোঝার উপর শাঁকের আটি হয়ে আছে মসৃণ পেলব এই রাস্তায় চলতি গাড়ির আরামদায়ক গতিজড়তা । অতএব ড্যাশবোর্ডে রেখে যাওয়া, হোটেল থেকে বেরুবার সময়ে মিস ইনার দেয়া সেই ট্রাভেল গাইডটা হাতে নিয়ে সামার প্যালেস সম্পর্কে একটু জ্ঞানার্জন করাটাই শ্রেয়। তাতে, ঐ জায়গায় গেলে কি কি দেখতে হবে তা যেমন জানা যাবে, তেমনি যা কিছুই দেখি তার বৃত্তান্ত কিছুটা হলেও জানা থাকলো আর কি?তো বেইজিং এর এই বিখ্যাত গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ সম্পর্কে পড়তে গিয়ে প্রথমেই বুঝতে পারলাম, যাচ্ছি মিং থেকে কিং এ। মানে এ যাত্রা আমাদের চায়নার ভিন্ন আরেক রাজবংশের কীর্তিস্থলে। আগেই বলেছিলাম ২১ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশী দীর্ঘ মহাপ্রাচিরের মুতিয়ানু অংশটি বানিয়েছিল মিং রাজারা। আর এই সামার প্যালেস বা গ্রীষ্মকালীণ প্রাসাদ হল এখানকার কিং রাজবংশের কীর্তি।
ঘটনা হল এই কিং রাজারাই ছিলেন এখনকার মহাচীনের শেষ রাজবংশ, যারা চায়না শাসন করেছেন ১৬৪৪ সাল থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। এরই মধ্যে বেশ কবারই বলেছি যে, আমি হলাম দিককানা ফলে ম্যাপ কানাও অবশ্যই । তারপরেও ছোট্ট এই ট্রাভেল গাইডটিতে যে ম্যাপ দেয়া আছে দেখে, ওইটি একটু ভালমতো নিরীক্ষণ করার সাথে, সামার প্যালেসের অবস্থান বিষয়ে দেয়া দুরহ চিংলিশ বর্ণনা পড়ে মনে হল যে, ঐটির দূরত্ব আমাদের হোটেল থেকে খুব বেশি নয়। যার মানে দাঁড়ায় যাচ্ছি এখন তাহলে বেইজিং শহরের দিকে। হাতে যেহেতু সময় নাই তেমন আমাদের, এটি অবশ্যই একটি ভাল খবর। মুতিয়ানু মহাপ্রাচিরের থেকে বেইজিং শহরের দিকে না হয়ে, এটি ভিন্ন কোনদিকে হলে, হোটেলে ফিরতে নিশ্চয়ই অনেক রাত হয়ে যেতো। তাতে হোটেলে ফিরে অ্যাপলস্টোরে যাওয়ার পুত্রদের প্রবল দাবি বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়তো, যা নাকি হয়ে আজকের উঠত রাতের শান্তি ভঙ্গের কারণ। সেদিক থেকে আপাতত রক্ষা পাওয়া গেল ।
এই ভেবে যখন কিছুটা নিশ্চিত হওয়া গেল মনে মনে, তখনই দেখলাম এতোক্ষনের ছায়া সুনিবিড় নির্জন পাহাড়ি পথ থেকে লি খাঁ উঠে পড়েছে গাড়ি নিয়ে মোটামুটি ব্যস্ত এক হাইওয়েতে, যার গন্তব্য নিশ্চিত মনে হচ্ছে বেইজিং শহর। হাইওয়েতে গাড়ি ওঠাতে আরেকটা স্বস্তি পেলাম মনে। তা হল, এরকম ব্যস্ত রাস্তায় সারাক্ষণই যখন সাই সাই করে নানান আকারের গাড়ি যাচ্ছে আসছে , তখন আর চুপচাপ গাড়ি চালাতে গিয়ে লি খাঁর এ ঘেয়েমিতে পেয়ে বসবে না। ফলে তার চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু হবার সম্ভাবনাও অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও কমে গেল। সকলের নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বক্ষণের জন্য সজাগ অবচেতন মন এতে বেশ শান্তি পেল ।
রাস্তায় চোখ রেখে নানান রঙ্গয়ের, আকারের আর ঢঙ্গয়ের গাড়ি দেখতে দেখতে, পুত্রদের নিজদের মধ্যে এ ক’দিনের গাড়ি দেখা বিষয়ক প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরতেই দেখি চলছে ওখানে ঘুমের রাজ। আহারে, জেগে থাকলে নিশ্চয়ই এখন দু ভাই তুমুল ব্যস্ত থাকতো কে ক’টা পোর্শে, মার্সিডিজ বা বি এম ডব্লিউ দেখলো তা নিয়ে। পেছনের সিট থেকে মাথা ঘুরিয়ে উইন্ডশিল্ডের বাইরে নজর দিতেই মনে হল আচ্ছা, বাজে কয়টা এখন? শহরের পথে যাচ্ছি বলে যে স্বস্তিতে ছিলাম এতোক্ষণ, সেটিকে এখন অনিবার্য অস্বস্তির ভয় কালো মেঘের মতো ঘিরে ধরল এসময়। তা হল জ্যাম ভয়!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক