দেশ বিদেশে রয়েছে বিপুল চাহিদা : রেশম শিল্প রক্ষায় এগিয়ে আসুন

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৩ জুন, ২০২৩ at ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

কয়েকদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় এক জনসভায় বাংলাদেশের রাজশাহী সিল্কের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি কলকাতার তাঁতিদেরকে রাজশাহী সিল্ক কাপড় তৈরির টেকনিক আয়ত্ত করার আহবান জানান। ঐ জনসভায় তিনি আরো বলেন রাজশাহী সিল্ক শাড়ির মত সফ্‌ট ও মসৃণ শাড়ি বিশ্বের আর কোনো দেশ তৈরি করতে পারে না। সেজন্য রাজশাহী সিল্ক ওনার পছন্দের বলেও জানান উক্ত জনসভায়।

সিল্ক প্রোটিন ভিত্তিক প্রাকৃতিক তন্তু। যা বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুতা হিসাবে পাওয়া যায়। সম্রাজ্ঞী লেইজুই এবং তার কিছু সহপাঠী বিষয়টি খুব ভালোভাবে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই সুতা থেকে উন্নত মানের কাপড় তৈরি করা সম্ভব। তারপর সম্রাটের আদেশে রেশম গুটি সংগ্রহ করে সুতা তৈরি করা হয় এবং প্রাসাদের মেয়েদের দিয়ে সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন করা শুরু হয়।

ওই সময়ে প্রাসাদে থাকা রমণীদের একটি বড় বিনোদন ছিল রেশম বুনন। এরপর হাজার বছর ধরে রেশম কাপড় কিভাবে তৈরি করা হয় তা চীনারা গোপন করেছিল পুরো পৃথিবী থেকে। রেশম আবিষ্কারের ফলে চিত্র শিল্পের ক্ষেত্রেও বিশাল অগ্রগতি হয়েছিল। চীন রেশমি কাপড়ের উপর বিভিন্ন ধরনের চিত্র এঁকে স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছিল। কয়েক শতাব্দীর পর সম্রাট জাস্টেনিয়ানের আদেশক্রমে দুজন ইউরোপীয় পাদ্রী লুকিয়ে রেশম উৎপাদনের কৌশল শিখে নিয়েছিল। ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইউরোপে রেশম চাষ শুরু হয়। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইতালির পালেরমো, কাতানযারো এবং কোমো শহর ছিল ইউরোপের সব থেকে বেশি রেশম উৎপাদনকারী শহর। বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ১,২৫,০০০ টন সিল্ক উৎপাদিত হয় যার দুইতৃতীয়াংশই চীন উৎপাদন করে।

কয়েকমাস আগে আমি রাজশাহীর একটা সিল্ক মিলে গিয়েছিলাম। সেখানে তুতগাছ, রেশম পোকার লালন পালন থেকে শুরু করে সিল্ক সুতা উৎপাদন ও সিল্ক কাপড়ের বুননসহ সব কিছু দেখেছি। দেখলাম তুত গাছের পাতা খেয়ে কিভাবে রেশম পোকা গুটি তৈরি করে এবং কিভাবে রেশম গুটি হতে সুতা তৈরি করা হয়।

রেশম পোকা সাধারণত জীবনে একবার ডিম দে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে ৩৪ বার ডিম পাওয়া সম্ভব। একটি স্ত্রী মথ একসাথে ৩৫০৪০০টি ডিম পাড়ে এবং এরপর মারা যায়। রেশম মথের বৈশিষ্ট্য সাধারণত বংশানুক্রমিক হওয়ায় যদি কোনো মাতৃ মথের সমস্যা দেখা দেয়, তখন ডিমসহ তাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। ডিম থেকে লার্ভা পাওয়া যায়। ২৮৩০ দিন পর্যন্ত এদেরকে দিনে পাঁচবার করে তুঁতপাতা খাওয়ানো হয়। এর মধ্যে লার্ভাগুলো চারবার খোলস পাল্টায়, এরপর তারা কোকুন তৈরির জন্য প্রস্তুত হয়। পাতা খাওয়া বন্ধ হলে তাদেরকে নিয়ে বোর্ডের মধ্যে পেঁচানো রিং এর মধ্যে রাখা হয়। সেখানে রাখার পর তারা ৮১০ দিনের মধ্যে লালা নিঃসরণ করে লাভার বাহিরের দিকে একটা বন্ডিং করে গুটি তৈরি করে। এরপর ঐ গুটিকে ৪৮ ঘণ্টা প্রখর রোদে শুকাতে হয়। এতে করে গুটির ভিতরের লাভাটি মারা যায়। এরপর ঐ গুটিকে ৪০৪৫ মিনিট ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করা হয়। এরপর সেই সিদ্ধ গুটিকে ঠাণ্ডা পানিতে রেখে ডিসেক্টিং নিডল দিয়ে কোকুন থেকে সুতার মূলপ্রান্ত বের করা হয়। একবার সুতার প্রান্ত পেয়ে গেলে সেটা ধরে আস্তে আস্তে টান দিলে অবিচ্ছিন্ন সুতার আকারে সিল্ক বের হয়ে আসে। তবে ৮১০টা গুটিকে একসাথে দিতে হয়। এতে ৮১০ টি গুটির সূক্ষ্ম সুতা পেচিয়ে একটি সুতা তৈরি হয়। আর যদি গুটি হতে আবার রেশম পোকা উৎপাদন করতে হয় তাহলে রোদে না শুকিয়ে গুটিগুলোকে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ২২২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঘরে রেখে দিলে লাভাটি ১০১১ দিনের মধ্যে গুটি কেটে রেশম পোকা হিসাবে বের হয়। পোকাটি বের হয়ে অন্য পোকার সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টা থাকে। যৌন মিলন শেষে মাদী পোকাটি ৩৫০৪০০ ডিম দিয়ে উভয় পোকা মারা যায়। মাদী পোকা থেকে পাওয়া ডিমগুলো ৮১০ দিন পর ব্রাউন বর্ণ ধারন করে। এর ৮১০ দিন পর ঐ ব্রাউন ডিম হতে আবার লাভা বের হয়। তখন ঐ লাভাগুলোকে আবার তুত পাতার মধ্যে রাখা হয়। ২৮৩০ দিন পর তুত পাতা খেয়ে লাভাটি আবার গুটি তৈরির উপযুক্ত হয়। উল্লেখ্য প্রাকৃতিক ফাইবারের মধ্যে সিল্কই একমাত্র ফাইবার যা অবিচ্ছিন্ন এবং প্রতিটি কোকুন থেকে একটি সুতাই পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সেই সুতা মেশিনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাপড় তৈরি করা হয়।

পুরো প্রক্রিয়াটি দেখে মনে হলো রেশম গুটি বাংলাদেশের যে কোনো জায়গায় অতি সহজে উৎপাদন করা যায়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল, পার্বত্য ও বনাঞ্চল এলাকায় প্রশিক্ষণ দিয়ে এটি উৎপাদন করা সহজসাধ্য। তবে দুঃখজনক হলো সঠিক উদ্যোগের অভাবে এতো সহজ একটি জিনিস আমরা হেলাফেলায় নষ্ট করছি। এখন দেশে চাহিদার মাত্র ৫% সিল্ক সুতা আমরা উৎপাদন করতে পারি। বাকি ৯৫% সুতা আমদানি করে পূরণ করা হয়। অথচ আমরা রেশম কাপড়কে শতভাগ দেশীয় পণ্য হিসাবে গণ্য করি। আমরা মনে করি এর প্রতিটি উপাদান দেশে উৎপাদিত হয়। ধারনাটা একেবারে ভুল। বর্তমানে দেশে ২০০ টন রেশম গুটি উৎপাদিত হয় যা থেকে মাত্র ২৫৩০ টন সুতা পাওয়া যায়। অথচ দেশে রেশম সুতার চাহিদা ৫০০ টন। বাকীটা আমদানি করা হয় চীন ও ভিয়েতনাম থেকে। তবে বেশিরভাগ আমদানি করা হয় চীন থেকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সময় আমদানিকৃত রেশম সুতার প্রতি কেজি ছিল এক হাজার টাকা। এখন সম্পূর্ণ বিদেশ নির্ভর হওয়ায় মূল্য বেড়েছে কয়েক গুণ। বর্তমানে এক কেজি রেশম সুতা কিনতে হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার টাকায়।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে রেশমের উপর গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য রাজশাহীতে ‘সিল্ক কাম ল্যাক রিচার্স ইন্সটিটিউট’ নামে রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হলে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের আওতায় আসে এবং বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নামে নামকরণ করা হয়। ২০০৩ সালে ২৫নং আইন বলে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটকে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের আওতামুক্ত করে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ২০১৩ সালে ১৩নং আইন বলে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশনকে একীভূত করে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। অন্যদিকে তুঁত গাছের উচ্চ ফলনশীল বীজের গবেষণার জন্য ১৯৬২ সালে পাবনার ঈশ্বরদীতে স্থাপিত হয় রেশম বীজাগার। এই বীজাগারে উৎপাদিত হতো বিপুল পরিমাণ সুতা। সেই সুতা সরবরাহ করা হতো রাজশাহীর সিল্কপল্লিতে। কয়েক দশক পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি লাভজনকভাবে পরিচালিত হওয়ার পর এইটি হঠাৎ লোকসানে পড়া শুরু করে।

স্বাধীনতার পর ভাবা হয়েছিলো সিল্ক সুতা উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। কিন্তু সেই আশা গুড়েবালি, শুরু হয় পিছিয়ে পড়া। অযত্ন, অবহেলা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় সিল্ক উৎপাদনে ভাটা পড়ে। লাভজনক পাবনার ঈশ্বরদীতে অবস্থিত রেশম বীজাগারটিও বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৫১৬ অর্থবছরে সিল্ক থেকে রফতানি আয় ছিল ২০ হাজার ডলার। সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা জানান, একসময় এলসির মাধ্যমে সিল্কের কাপড় রফতানি হতো। তবে এখন এর পরিমাণ কমে গেছে।

আসলে গত ৩০ বছরে ধীরে ধীরে রেশম শিল্পটি বিলুপ্তির পথে এগিয়েছে। যা সত্যি দুঃখজনক। সিল্কের কাজ খুবই সুক্ষ ও ধৈর্যের। ধৈর্য্য ধরে কাজ করার আগ্রহ নেই এখনকার প্রজন্মের। ফলে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা কমে গেছে ব্যাপক হারে। আগে যে কাপড় বিক্রি হতো ৪৫০ টাকায়। এখন সেই কাপড়ের দাম দুই হাজার ৭০০ টাকা। মনে রাখতে হবে, সিল্ক হলো আভিজাত্যের প্রতীক। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রুচিশীল উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পের সঙ্গে অলংকরণ যুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে উন্নত তুঁতপাতা, বীজ, আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। বর্তমানে এই শিল্পে দক্ষ কারিগরের বড়ই অভাব, ফলে সিল্ক শিল্পেরও নিভু নিভু অবস্থা। অথচ দেশ বিদেশে রয়েছে এর বিপুল চাহিদা। তাই সরকারের উচিত রেশম শিল্পকে রক্ষায় বিশেষ করে রেশম সুতা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম নেওয়ার। কারণ এই শিল্পটি দাঁড়িয়ে গেলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা শুধু সময়ের ব্যাপার। তাই রেশম শিল্পের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধঅভিনয়ের সঙ্গে সিনেমা প্রযোজনাতেও গাউসুল আলম শাওন