একজন অসহায় মা, পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। প্রসূতি হওয়ার পর হাসপাতালের বিল মেটানোর মতো সামর্থ্যও নেই। সেই দূরাবস্থার সুযোগ নিয়েছে একটি দুষ্টচক্র।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে মাত্র ১০ হাজার টাকা বিল পরিশোধ ও শিশুর মায়ের হাতে ৫ হাজার টাকা মোট ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে এক নবজাতক তুলে দেওয়া হয়েছে এক নিঃসন্তান দম্পতির হাতে। মধ্যস্থতায় ছিলেন হাসপাতালেরই এক নার্স।
শনিবার (১৪ জুন) সকাল সাড়ে ৯টায় কর্ণফুলীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে জন্ম নেয় শিশুটি। প্রসবের পরপরই শুরু হয় টানাপোড়েন। গর্ভবতী থাকা অবস্থায় স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য, চাকরি হারানো—সব মিলিয়ে জয়া দাশের জীবনে তখন শুধু সংকট আর অনিশ্চয়তা।
চরম অর্থকষ্টে থাকা পরিবারটি পরে নিরুপায় হয়ে হাসপাতালের নার্সের সহায়তায় নবজাতক ছেলেটিকে তুলে দেয় হাটহাজারীর দিকের এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। বিনিময়ে হাসপাতালের ১২ হাজার টাকা বিলের ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন তারা। বাড়তি দেন ৫ হাজার টাকা নগদ।
নবজাতকের নানা পরিমল দাশ বলেন, ‘আমার মেয়ে ডিভোর্সি, আগেও এক বাচ্চা আছে। কৃষিকাজ করে কোনোমতে সংসার চালাই। এত খরচ কোথা থেকে আসবে? বাধ্য হয়েছি দত্তক দিতে।’ তবে দত্তক নেওয়া দম্পতির পরিচয় জানেন না তিনি। শুধু জানেন, নার্সের আত্মীয়।
এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। ম্যানেজার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দুই পরিবারের সমঝোতা, আমরা কিছু করিনি।’ কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—হাসপাতালের ভেতরে এমন লেনদেন কীভাবে হয়? নার্সের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জেবুননেসা বলেন, ‘আমরা টিম পাঠিয়েছিলাম। দুপক্ষের সম্মতিতে হয়েছে। তবে এটি অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত ছিল।’
আইন জানে না, এমন নয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু অর্থকষ্টে থাকা পরিবারকে আইনি পরামর্শ না দিয়ে বরং তড়িঘড়ি করে নার্সের মাধ্যমে এক গোপন ‘সমঝোতা’র দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি জানানো হলেও কর্ণফুলী থানা থেকেও আসেনি কোনো ব্যবস্থা। ওসি ফোন ধরেননি। ডিউটি অফিসারদের জানানো হলেও নীরব প্রশাসন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের মানবিক অপরাধগুলো আসলে কারা প্রশ্রয় দেয়?
আইনি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে শিশু দত্তকের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা রয়েছে। অভিভাবকত্ব নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সেটিও অবশ্যই আদালতের মাধ্যমে করতে হয়। ‘সাদা কাগজে’ লেখা কোনো মুচলেকা দিয়ে নবজাতক হস্তান্তর করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
চট্টগ্রামের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এভাবে শিশুর দায়িত্ব হস্তান্তর করা আইনত অবৈধ। আদালতের আদেশ ছাড়া এসব শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।’
নবজাতকের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। কে তার আইনি অভিভাবক, কোথায় বড় হবে সে—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই এখন। শুধু রয়ে গেছে অভাবগ্রস্ত পরিবারের হাহাকার আর ব্যবস্থার নীরবতা।