আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু,
বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ,
তবু অনন্ত জাগে।
কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত বাণী দিয়ে শুরু করতে চাই। বর্তমানে ভয়াবহ এক অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের সমাজে। আক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদপত্রে প্রতিদিন এরকম কোন না কোন সংবাদ পুরো দেশবাসীকে কাঁদিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যাচ্ছে কারও না কারও সাজানো গোছানো সংসার। শেষ হয়ে যাচ্ছে কোন না কোন পরিবার। বিধবা মা হারাচ্ছে তার আদরের সন্তানকে, স্বামী হারাচ্ছে স্ত্রী অথবা স্ত্রী হারাচ্ছে স্বামীকে। সমাজের উচ্চপদস্থ থেকে নিম্নপদস্থ পর্যন্ত কেউ এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এই মারাত্মক, ভয়াবহ অসুখের নাম আত্মহত্যা। আরও সহজভাবে বললে, নিজেকে নিজে শেষ করে দেওয়া। একটি সুন্দর জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত, অকাল মৃত্যু। একটা আত্মবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। যা ঘটে গেলে সে জীবন ফিরে পাওয়ার আর কোন সম্ভাবনা থাকে না। এটা এখন মানসিক ক্যান্সারে পরিণত হচ্ছে। এর থেকে কীভাবে সমাজে মুক্তি মিলবে বা এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি!
অনেক সময় সামান্য ভুল বুঝাবুঝিতেও আত্মহত্যা করছে অনেকে। সহনশীলতা এখন মানুষের মধ্যে নেই বললেই চলে। মাবাবা তার আদরের কিশোর সন্তানকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পাশাপাশি সামান্য শাসন করলেই মনে হয় বিপদ। সন্তান তার মাবাবার ত্যাগ, আদর, স্নেহ, মায়া–মমতা, ভালোবাসা সব মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র শাসনটাকেই বড় করে দেখল! ভুলে গেল তাকে ঘিরে তার মাবাবার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং হাজারো স্বপ্নের বুনন। মানুষের জীবনে সফলতা–ব্যর্থতা পাশাপাশি অবস্থান করে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের পাশাপাশি খারাপ ফলাফলও আছে, থাকবে। তাই বলে জীবন শেষ করে দেওয়ার মধ্যে কোন বাহাদুরী নেই।
‘একবারে না পারলে দেখ শতবার’– এই কথাটি আমরা ছোটকালে মনেপ্রাণে ধারণ করতাম। এখন আমরা আমাদের সন্তানকে মনে হয় সেটা বোঝাতে পারছি না! প্রত্যেক পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টের পরে আশানুরূপ ফল করতে না পারা , প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অথবা নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামীর অবহেলা, প্রেমিকের প্রতারণা, ধর্ষণের শিকার, ব্যবসা বা চাকরিতে সফল হতে না পারা, ঋণগ্রস্ত, বিভিন্ন কারণে হতাশা কিংবা নিকটজনের সাথে অভিমান করেও অনেকে আত্মহননের মত ভয়ংকর পথ বেছে নিচ্ছে।
এখন আমাদের সমাজে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। সন্তানকে লেখাপড়া ছাড়া অন্য কোনদিকে তাকানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এই বিকৃত প্রতিযোগিতা, অতিরিক্ত প্রত্যাশা আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অনেক সময় এর জন্য অভিভাবকও দায়ী থাকে। তারা সন্তানকে ছোটকাল থেকে শুধুমাত্র লেখাপড়ার দিকে দৃষ্টি দিতে গিয়ে অন্য অনেক সৃজনশীল, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বাদ দিচ্ছে। নিজের অজান্তে তার আদরের কিশোর সন্তানটি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হয়। ফলে তারা নিজের কোনরকম ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে না।
বর্তমানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনেক জ্ঞানি–গুণী ব্যক্তিও সাময়িক হতাশা কিংবা বিষণ্নতায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার মত ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। আত্মহননকারী নিজেও জানে না তার এই সিদ্ধান্তে তার পরিবারকে কী মারাত্মক যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে! কিছুদিন আগে আমাদের দেশের খুবই জনপ্রিয় শিল্পী, বিশেষ করে আমাদের জেনারেশন, আমরা যারা সারাক্ষণ রবীন্দ্রসংগীতকে আঁকড়ে থাকি, আমাদেরকে রবীন্দ্রসংগীতের সাথে পরিচিত করেছে, রবীন্দ্রসংগীতকে ভালোবাসার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, উনার উদার কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত। সেই প্রিয় শিল্পী আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে শেষ করে দিল। বিষয়টা মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে। নিজের প্রিয় শিল্পীর এমন মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। শিল্পীর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে জানা গেছে, তিনি সমপ্রতি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন।
জীবন মহামূল্যবান। আত্মহত্যা একধরনের মানসিক অসুস্থতা। বর্তমানে অনেকে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করছে। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রী ফেসবুকে তার এক সহপাঠী এবং শিক্ষককে দায়ী করে সুইসাইড নোট পোস্ট করে আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী সেই শিক্ষক ও সহপাঠীকে পুলিশ আটক করেছিল। পরবর্তীতে তাদের বিচারের কোন আপডেট আর জানা যায়নি। ২০২২ সালে ধানমন্ডিতে ফেইসবুক লাইভে এসে প্রায় ১৬ মিনিটের মত ব্যবসায় কিভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছিল তা বলে নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন।
সমপ্রতি একটি আত্মহত্যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাইকে কাঁদাচ্ছে। এক গৃহবধু ফেইসবুক লাইভে দীর্ঘসময় ধরে তার স্বামীর অবহেলা এবং পিতার দ্বিতীয় বিয়ের কারণে তার এই পরিণতির কথা উল্লেখ করে, পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এত সুন্দর একটা স্মার্ট মেয়ে বারবার বলছে, মাবাবা খারাপ হলে সন্তান খারাপ হয় না। মাবাবার কোন দায় যেন সন্তানের উপর না পড়ে। সে নিজে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের মা। যে সন্তানের দিকে তাকালে হাজার দুঃখ কষ্ট ভুলে থাকা যায়। অথচ সে সন্তানের কথাও চিন্তা করলো না ।
প্রতিদিন সকালে পত্রিকা খুললেই এধরনের খবরে শংকিত সাধারণ মানুষ। ২৬ জুন দৈনিক আজাদী’র প্রথম পাতায় নিউজ, ‘ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে নারীর আত্মহত্যা’। ওই একই দিনেই শেষ পাতায় ‘আমি আর পারছি না’ স্ট্যাটাস দিয়ে নারী চিকিৎসকের আত্মহত্যা। যে চিকিৎসক মানুষকে বাঁচানোর শপথ নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে লেখাপড়া করেছে, সে নিজেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখলো না। নিজের জন্মদাতা বিধবা মায়ের কথা চিন্তা না করে প্রতারক প্রেমিকের কারণে আত্মহত্যা করলো। যার কাছে তার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই , সেটাকে ইস্যু বানিয়ে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিল। ওই প্রেমিকের নাম সে উল্লেখ করে দিলেও বিচার কী পাবে তার বিধবা মা! আবার দৈনিক আজাদী’র প্রথম পাতায় নিউজ, ‘হবু বরের সঙ্গে মোবাইলে তর্ক, মেহেদী অনুষ্ঠানের কয়েক ঘন্টা আগে তরুণীর আত্মহত্যা’। এ প্রসঙ্গে একটা চিঠিও মেয়েটি লিখে গেছে, যেখানে সে হবু বরের যৌতুকের দাবির কথা উল্লেখ করে , তার শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
বিপজ্জনক ও মর্মান্তিক এই প্রবণতা রোধে করণীয় সম্পর্কে আমাদের সমাজ, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া –সবারই চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন। আত্মহননের কুফল সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সব ধর্মেই লেখা আছে, ‘আত্মহত্যা মহাপাপ’। সেটা সবাইকে বোঝাতে হবে। মানুষের জীবনে দুঃখ–কষ্ট, সুখ– শান্তি ঘুরে ফিরে আসে । খারাপ সময় ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সান্ত্বনা বা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আত্মহত্যা প্রশংসাযোগ্য কোন কাজ না, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তা যদি বোঝাতে ব্যর্থ হই, তাহলে এই ব্যর্থতার মাসুল আমাদেরই দিতে হবে।
আত্মহত্যার চেষ্টা যেমন অপরাধ তেমনি আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়াও অপরাধ। আত্মহত্যায় প্ররোচনা বা উস্কানি দেওয়ার বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণিত হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্ষণ, প্রতারণা, নারী নিগ্রহ ইত্যাদির জন্য কঠোর আইনের পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নের দিকেও নজর দিতে হবে।
এই পৃথিবীতে কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না, তার জীবনে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, হতাশা নেই। আমাদের একাত্তরের সেই বীরমাতা যাদের আত্মত্যাগে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। রমা চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, তারামন বিবি। একাত্তরে তাঁরাতো সব হারিয়েছেন। তবুও জীবনে পরাজয় স্বীকার করেননি। বেঁচেছিলেন সমাজের জন্য, সন্তানের জন্য, নিজের জন্য। তাঁরা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন, জীবনে কখনও হার মানতে নেই। আজ তাঁরাই আমাদের গর্ব, দেশের গর্ব।
মানবপ্রেমে আপ্লুত কবিগুরু লিখেছিলেন–
‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে।
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
জীবনের প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয়ের গোপন গভীরতম প্রদেশে হয়ত এমন একটি ভাবনা কাজ করে। মৃত্যু সতত সুন্দর। জন্মিলে মরতে হবে, মৃত্যু জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যক্তিগত শোক– দুঃখ সংবরণ করাই আমাদের কর্তব্য। ব্যক্তিগত শোককে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ এই পথচলায় যেমন আনন্দ আছে, তেমনি রয়েছে বেদনাও। বেঁচে থাকলে পৃথিবীর বিচিত্র রহস্য ভান্ডারের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। পৃথিবীর চতুর্দিকে আলোকের এই ঝরনাধারার গুঢ় রহস্য, সমুদ্র, পর্বতের বিচিত্র রহস্য জানার এবং চিনে নেওয়ার আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়। মৃত্যু চিরন্তন সত্য, একটা দূরত্ব রচনা করে মাত্র। কিন্তু স্বেচ্ছা মৃত্যু কোন মানুষের কাম্য নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী আধ্যাপক, অর্থনীতি,
বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।