দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন

শামীম আরা লুসি | মঙ্গলবার , ৮ মার্চ, ২০২২ at ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ

‘বিশ্বের যা মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তা করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। তবে নারীর কল্যাণকামী এ পথ চলায় শুরুর দিকে সহজ না হলেও পরবর্তীতে তা বিভিন্নভাবে সকলের মনে যুগিয়েছে প্রেরণা। আজ ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। বিশ্বের নারী মুক্তি আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল স্মরণীয় দিন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে এ দিবসটি। শিকাগোতে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে সংগ্রাম করেছিল নারী শ্রমিকরা। কিন্তু আমাদের দেশের নারী শ্রমিকদের দেখা যায় শ্রমঘণ্টা বলে তাদের কিছুই নেই। আবার পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করেও শ্রমের ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছে না নারী শ্রমিকরা। নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে তীব্র মজুরি বৈষম্যের শিকার।
নারীর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে প্রকট আকার ধারণ করছে। গবেষকরা মনে করেন নারীর প্রতি সহিংসতা হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে বিরাজমান অসম ক্ষমতা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। যুগ যুগ ধরে নারী নির্যাতিত হয়ে আসছে ঘরে বাইরে। এই নির্যাতনকারীর ভূমিকায় যে অংশগ্রহণ করে সে পুরুষ। তবে কখনো কখনো কিছু নারীও এই প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই নির্যাতনের চিত্র প্রায় একই রকম। উন্নত দেশগুলোর থেকে এই চিত্র আলাদা হলেও নারী সবস্থানেই আর্থ-সামাজিক অবমূল্যায়নের শিকার। সংস্কৃতি আর ধর্মের সীমানা ডিঙিয়ে এই সহিংসতা নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের অধিকার হরণ করেছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অশিক্ষিত, নিরক্ষর, এমনকি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীরা আজো অবহেলিত, অত্যাচারিত এবং নির্যাতিত। ধর্ষণ, বাল্য বিবাহ, পাচার, ফতোয়া, এসিড সন্ত্রাস ও শোষণের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র হিসেবে নারীরা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ধর্ষণ, হত্যার মতো মধ্যযুগীয় বর্বরতার ঘটনা আজো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। গণপরিবহণে গণধর্ষণ এখন বেড়েই চলেছে। রাস্তা থেকে শুরু করে চলন্ত বাসেও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। নারীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় আমাদের দেশে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা রচিত হয়েছে। ধর্ষকের শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু আদৌ কোনো ধর্ষক কি শাস্তি পাচ্ছে। বরং সমাজে ধর্ষিতা ও তার পরিবার কলংকময় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
আমাদের দেশে বাল্য বিবাহ এবং যৌতুকপ্রথা এক ভয়ংকর ব্যাধি। যা সংক্রমিত হয়ে গোটা সমাজকে জর্জরিত করে তুলেছে। যৌতুকের জন্য নিপীড়ন, হত্যা বাল্য বিয়ে ও শ্রম বৈষম্য থেকে নারীর মুক্তি মিলছে না। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন কর্তৃক নির্যাতনসহ সমাজের অসংখ্য নারী বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। দেশে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। গণপরিবহণে নারীদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা থাকলেও কর্মজীবী ও সাধারণ নারীরা সিটে বসার সুযোগ পায় না বরং শারীরিক বিভিন্ন যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকার আদায়েও রয়েছে নারীর দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। অধিকার বঞ্চিত নারীরা বিরাজ করছে গার্মেন্টসে, ইটভাটায় ও বিভিন্ন কারখানায়। সেখানেও যৌন নির্যাতন ও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নারী সমাজ। যদিও অতীতের চেয়ে নারী সমাজ অনেক বেশি এগিয়েছে। নানা ক্ষেত্রেই পুরুষের পাশাপাশি অবদান রাখছে নিরাপত্তাহীনতায়। নারীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে নেতৃত্বের শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে পূর্ণ মর্যাদা অধিষ্ঠিত হলেও নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ হয়নি। পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে এগিয়ে নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। প্রয়োজন গণশিক্ষা ও চেতনার আলোকে সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করা। এখনো বহু কুসংস্কার নারী নির্যাতনের মূলে রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় নারীরা স্বগৃহে পরিবারের সদস্যদের হিংসাত্মক আচরণের শিকার হয়ে থাকে। নারী নির্যাতন বন্ধে প্রথমেই সকলের উচিত নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। দায়ী ব্যক্তিদের জাতীয় আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা। নির্যাতিত নারীকে প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি জোগাতে হবে। ঘরে, বাইরে, সমাজের যেখানেই নারী নির্যাতন হয় সেখানে সকলের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা কিছুটা হলেও সম্ভব হবে। নারী নির্যাতনের আরো একটি মাত্রা যোগ হয়েছে পরকীয়ার ঘটনায় স্ত্রী নির্যাতন। সমাজের অসংখ্য নির্যাতিত নারীরা এখন পরকীয়ার বলি হচ্ছে অথবা আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বেছে নিচ্ছে। প্রতিদিন এমনই কত ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটছে। কিন্তু সমাজের পুরুষের রক্তচক্ষুর ভয়ে অসংখ্য নির্যাতিত নারী আজ শত ব্যথা বুকে নিয়ে মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে মেয়েরা কতটুকু অসহায় অবস্থার শিকার আজ সমাজ ব্যবস্থা কতটুকু বিপন্ন তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এসব অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তিই হচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই নারীর মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নারী নির্যাতন রোধে আইন ও আদালত আছে তার কঠোর প্রয়োগ এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধএখন সময় নারীর
পরবর্তী নিবন্ধনারীদের যাবতীয় অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হতে হবে