দূরের দুরবিনে

জয় পরাজয়ে বাঙালির অনুভূতি

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ছাত্র জনতার বিজয়ের পর দেশব্যাপী গণতন্ত্র ও সুশাসন কামনার অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল। যার প্রবাহ ধাবমান থাকলেই আমাদের অনুভূতির শুদ্ধতা জয়ী হবে। মনে রাখতে হবে অনুভূতি সবসময় ই ভালো যদি তার প্রকাশ ও বিস্তার হয় সবার মতো করে। কারণ তা দেখা যায় না কিন্তু সবার হৃদয় কে তা আচ্ছন্ন করে রাখে।

বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলি দেখা বা ছোঁয়া যায় না। এগুলি অবশ্যই হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিতে হয়। এর নাম অনুভূতি।

মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির একটি হচ্ছে অনুভূতি। এটি না থাকলে আপনি যে বেঁচে আছেন তার প্রমাণ থাকে না। অনুভূতি আমাদের অস্তিত্ব আমাদের জাগরণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অনুভূতিপ্রবণ বাঙালির একসময় অনুভূতি ছিল সর্বজনীন। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমরা যে অনুভূতি দেখেছি তার নাম দেশপ্রেম। সে অনুভূতি না থাকলে দেশ স্বাধীন হতো না। পরে অনুভূতি আরেক ধরণের হয়ে গেল। পঁচাত্তরের পর আমরা অনুভুতি প্রকাশে সাবধান হয়ে গেলাম। কারণ সব অনুভূতি যে সমান না সেটা শেখানো হলো আমাদের।

আবেগ হলো মনের একটি বিশেষ অবস্থা যার দ্বারা আমরা আমাদের কান্না, হাসি, রাগ ও দুঃখ অনুভব করি আর প্রকাশ করি। অধিকাংশ মানুষের আচরণ তাদের আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে আবেগ হলো মনের সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশমান অবস্থা যা একজন ব্যক্তিকে দৈহিক এবং মানসিক দিক থেকে বিচলিত করে। কোন মানুষের খুশীতে উচ্ছল হওয়া, ভয় পাওয়া, বিস্ময়ে অবাক হওয়া, রাগে উত্তেজিত হওয়া সবই আবেগের অনুভুতি আর তার দৈহিক প্রকাশ নিবিড় ভাবে জড়িত।

তার মানে অনুভূতি সবার। আচ্ছা এখন কি আসলেই সবাই পারে অনুভূতি প্রকাশ করতে? যেমন ধরুণ এক সময়ের রাজনীতি ও তার শাসকের জন্য আপনার কোন ভালো অনুভূতি থেকে থাকলে তা কি এখন বলা সম্ভব? আবার যারা দলকানা বা অন্ধ তারভ জুলাই মাসে নিহত আহতদের বেলায় কি শোক ও বেদনার অনুভূতি প্রকাশ করবেন? দুটোর উত্তর ই হবে , না । তাহলে সর্বজনীন হলো কি ভাবে ?

আজকাল আমরা মাঝে মাঝে অনুভূতিকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ছবিতে মিডিয়ায় এমন অনুভূতি কি প্রমাণ করে? বলে দেয়, আর যাই করো হে বাপু সব অনুভূতি প্রকাশ করো না।

সৌভাগ্য হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ফাহমিদা খাতুনের ইন্টারভিউ করার। আড্ডা দেয়ার। সিডনি ভিত্তিক বাংলা টিভি বাংলার মুখ তখন বেশ জনপ্রিয়। তাদের হয়ে কথা বলতে গিয়ে জেনেছিলাম ফাহমিদা খাতুনের অনুভূতি। আপনি আমি হয়তো ভাবছি কপালে টিপ পরা নারীদের দেখলে এখন যে বিরূপ অনুভূতি তা সামপ্রতিক সময়ের কিছু। জ্বী না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন ফাহমিদা খাতুনকে পাক বাহিনীর লোকেরা খুঁজে ফিরেছিল। তাদের ভাষায় টিপ পরা হিন্দু মহিলাটি কোথায়? যে কালীর গান গায়? মা কালীর গান বলতে তারা কোনটা মনে করতো জানেন? রবীন্দ্রনাথের তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরেএটা না কি কালীর গান। এই যে ভিন্ন অনুভূতি তার বেলায় আমরা কি বলব?

অনুভূতি মানুষ জাতি ও রুচিভেদে ভিন্ন। আজকাল সংবেদনশীল মানুষ যে কোন কিছুতেই তেতে ওঠে। আমাদের দেশে আমাদের সমাজে এখন যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনুভূতি হয়ে গেছে এক তরফা। আপনি বা আপনারা যা খুশী বলতে পারবেন করতে পারবেন আর এক দলকে অপমান করতে পারবেন এমন কি পিটাতেও পারবেন। আপনাদের বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বললেও অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। কিছু বলা যাবে না। তার মানে একদল বলবে করবে আর একদল মুখ বুঁজে সহ্য করবে। এই অপমান বা অনাচারের মূল জায়গা করে দিচ্ছে বিশ্বাস। আচার আচরণ বা সংস্কৃতি অনুভূতির বড় শিকার। কারো অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের গায়ে লাগে এমন গান গাওয়া বা আচরণ করা যাদের সঠিক অনুভূতি তারা নিজেদের বেলায় তা মানেন? আপনার অনুষ্ঠানে আরো কাউকে কি বলতে দেবেন? গাইতে দেবেন না কিছু করতে দেবেন?

অনুভূতির বেলায় বাঙালি এখন একমুখী। যে যখন পাওয়ার পায় অনুভূতি তখন তার বা তাদের দাস। তারা যে ভাবে যা প্রকাশ করেন তাই হচ্ছে সফল ও সঠিক। বাকীরা আধো ভয়ে আধো লাজে আর আধো সংকোচে বলতে গিয়ে বলেন না। করতে গিয়ে করতে পারেন না। আর হ্যাঁ মতে না বললে বা কথা শুনলে মার দেয়াটাও কিন্তু অনুভূতি। এর ভেতর কারো ব্যথা বা আঘাত লাগলে সে তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে কি না সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু সংখ্যায় যারা বেশী যাদের পেশীর জোর আছে তারা মারতে পারার অনুভূতির লাইসেন্স পেয়ে গেছে।

আমাদের সমাজে বা দেশে বা জাতিতে অনুভূতির প্রাবল্য এত বেশি যে তা আর সবকিছুকে ছাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এতো অনুভূতি আর কারো নাই। এই যে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ আমি দেখেছি রাশান বা ইউক্রেনিয়ানদের চাইতেও এ বিষয়ে আমাদের অনুভূতি বেশী। তরুণ তরুণী এমন কি বয়স্কদের ভেতর ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে আবেগ অনুভূতি তার ছিটেফোঁটা নাই আরবদের ভেতরে। এর কারণ কি? আমরা বোদ্ধা জাতিআমাদের ইন্দ্রীয় বেশি সচল? না কি আমরা বেশি বুঝি? না আমাদের আর কোন কাজ নাই? এর যেটা বা যেগুলোই সত্য হোক না কেন অনুভূতির বেলায় আমরা এখন কিছু মানতে নারাজ।

এভাবে চললে অতি অল্প সময়ের ভেতর জাতি অনুভূতিশূন্য হতে বাধ্য। কারণ তখন তার সব অনুভূতি এক জায়গায় জড়ো হয়ে তাকে এমন উগ্র করে তুলবে যে তাকে দেখলেই অন্যরা সরে দাঁড়াবে। ভয়ে পালাবে। এমন অনুভূতির কি দরকার আছে? সমাজ বিজ্ঞানীরা এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কথিত দেশ হিতৈষীরা আছেন অন্তরালে। সমুখে শান্তি পারাবার দেখানোর কেউ নাই। তবু আশ্চর্যজনক ভাবে অনুভূতি মরে না।

কাশবন দেখলে ভোরের শিউলি দেখলে ঢাকের আওয়াজ শুনলে আজানের মধুর ধ্বনি কানে গেলে বাঙালির অনুভূতি জাগে। জেগে ওঠে। বারংবার তাকে বিপদে পড়তে হলেও সে অনুভূতি বিসর্জন দিতে পারে না। কারণ তার ইতিহাস ঐতিহ্য আর অতীতের সাথে অনুভূতির যোগ নিবিড়।

আমাদের অনুভূতিগুলি আমাদের শক্তির উৎস, যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের বেঁচে থাকার রসদ যোগায়।” এই বাক্যটি আমার খুব প্রিয়। শক্তি ও অনুভূতি এক না হলে কোন জাতি এগুতে পারে না। যারা অনুভূতির নামে অনাচার আর অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার নামে দেশজুড়ে অশান্তি করে তাদের মনে করিয়ে দিই অনুভূতি শুদ্ধ ছিল বলেই যুগে যুগে বাঙালি সংগ্রাম ও বিজয়ে এক হতে পেরেছিল। উত্তেজনাহীন অনুভূতির জয় হোক।

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ায় হাটে চালু হচ্ছে ‘কৃষক কর্নার’