মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় ধরা দেয় যা অভূতপূর্ব। যার কোন ব্যাখ্যা বা পূর্বাভাস ও অসম্ভব। তেমনি এক বিরল ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে। সে ঘটনায় যাবার আগে বলি, আমরা সবাই জানি আড়াই শ বছর ধরে আমরা বৃটিশের অধীনে ছিলাম। তখন উপমহাদেশ মানে একটি রাষ্ট্র। অখন্ড সেই ভারতের অংশ ছিলাম আমরা। বৃটিশ শাসনের সুফল আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। তারা না শেখালে আমরা চা পান করতে জানতাম কি না, বা জানলেও তা কখন জানতাম তা বলা মুশকিল। ইংরেজ ছিল বলেই আমরা পোশাকে আধুনিক হয়েছিলাম। সেটা না হলে আমাদের হয়তো ধুতি টিকি লুঙ্গিতেই জীবন কাটতো। ইংরেজ শাসনের কারণে আমরা ফুটবল বা সকার শিখেছি। ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড এমন দেশগুলোর দিকে তাকালে জানবেন কেন আমরা ক্রিকেট পাগল জাতি। কারণ ইংরেজরাই আমাদের শিখিয়ে গেছে এই খেলা। তারা চলে গেছে অনেক বছর। কিন্তু এখনো তাদের গৌরবের রেশ বহমান। অন্য কোন শাসক দেশের কমনওয়েলথ নামের কিছু নাই। একমাত্র ইংরেজ শাসিত দেশগুলো ই এখনো কমন ওয়েলথে একীভূত। যার শক্তি বা গুরুত্ব কম কিছু না।
প্রথমেই বলি সিডনিতে অভিবাসন নিয়ে আসার পর প্রথম যে ভোটটিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাই, তা ছিল একটি গণভোট। তখন ছিলেন রাণী এলিজাবেথ। তাঁকে মানবে কি মানবে না এটি নির্ধারণ করার জন্য গণভোট হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া জুড়ে। রিপাবলিকের রাষ্ট্রপ্রধান রানী থাকবেন না এদেশের কেউ তার জায়গায় বসবেন এই ভোটে রাজত্বের জয় হয়। রাণী থেকে যান এদেশের আলংকরিক প্রধান হিসেবে। সেই নির্বাচনে আমার ভোটটি নষ্ট হয় নি। আমি তখনই বুঝেছিলাম এদেশের জন্য রাণীর ছায়ার প্রয়োজন ছিল। নানাবিধ ঘটনা বা রাজা রাজত্বের বহু অঘটনে মতামত দ্বিধাবিভক্ত হ ওয়াটা খুব স্বাভাবিক। যেমন প্রিন্সেস ডায়ানার অকাল মৃত্যুর পর ইংরেজ রাজ পরিবারের ওপর মানুষের এক ধরনের বিতৃষ্ণা জন্মে। জনপ্রিয় ডায়না‘র মৃত্যুকে হত্যাকান্ড মনে করা মানুষের সংখ্যা বেশ বড়। তারা এখনো রাজ পরিবারের ওপর বীতশ্রদ্ধ। তবু ও রানী যতদিন ছিলেন আস্থা আর বিশ্বাস ছিল অটুট।
তাঁর মৃত্যুর পর রাজা হন চার্লস। দীর্ঘ সময় যুবরাজ থাকা চার্লস আসলেই রাজা হতে পারবেন কি না এ প্রশ্ন যখন সবার মনে মনে তখন শেষ বয়সে তিনি সে আসন লাভ করেন। ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৮ তারিখে গ্রীনিচ মান সময় ৯:১৪ ঘটিকায় বাকিংহাম প্রাসাদে চার্লস জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পূর্বেই ২২ অক্টোবর, ১৯৪৮ তারিখে রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজাজ্ঞা পত্রের মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল যে, প্রিন্সেস এলিজাবেথ এবং ডিউক অব এডিনবরার কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলেই সন্তানটি রাজকুমার হিসেবে বিবেচিত হবে। সেইসূত্রে চার্লস জন্মকালীন সময় থেকেই প্রিন্সের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন।
এই রাজ পরিবারের সাথে আমাদের দেশের সম্পর্ক বাঙালির সম্পর্ক গভীর। যাঁরা স্যার বা নাইট হুড উপাধি লাভ করেন তাঁরা রানী বা রাজার সাধে দেখা করতে পারেন। কারণ ঐ খেতাবটি তাঁর কাছ থেকেই নিতে হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্র প্রধান সরকার প্রধান না হলে তাঁদের দেখা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। যদি না কোন কারণে তাঁদের প্রাসাদে আপনি আমন্ত্রিত না হন। আমন্ত্রিত হলেই যে আপনি কাছে গিয়ে কথা বলতে পারবেন বা করমর্দন করতে পারবেন তার ও কোন গ্যারান্টি নাই।
আমার এক অসাধারণ সৌভাগ্যের কথা বলার আগে রাজা চার্লসের এবারের অস্ট্রেলিয়া সফরের নেতিবাচক একটি ঘটনা বলি। রাজা েক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। রাজা চার্লসের বক্তৃতার পর সিনেটর থর্প চিৎকার করে বলে উঠেন, ‘আমাদের জমি ফেরত দাও! তুমি আমাদের কাছ থেকে যা চুরি করেছ তা ফেরত দাও! এটা তোমার জমি নয়, তুমি আমার রাজা নও।’ এর আগে, তিনি ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের ‘গণহত্যা’ করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। কেননা, অস্ট্রেলিয়া ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। আর সেই সময়ে হাজার হাজার আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানকে হত্যা করা হয়েছিল এবং সমগ্র সমপ্রদায়গুলিকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল। এই দেশ ১৯০১ সালে প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু কখনই একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজাতন্ত্র হয়ে উঠতে পারেনি। যেখানে রাজা চার্লস বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান। আর সেই সুবাদেই বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ও সামোয়ায় ৯ দিনের সফেের এসেছিলেন তিনি। যা তার ক্যান্সার নির্ণয়ের পর প্রথম বড় সফর।
এসব বাদানুবাদ আছে এবং থাকবে। অন্যদিকে বেশীরভাগ মানুষ ই তাঁর আগমনে অখুশী ছিলো না। মিডিয়াগুলো বেশ ক‘দিন ধরে রাজা চার্লসের আগমন ও সফর নিয়ে ছিল মুখর। হঠাৎ করে একদিন আমি একটি ম্যাসেজ পেয়ে বিস্মিত হয়ে যাই। আমার পুত্র অর্ক আমাকে একটি আমন্ত্রণ পত্র পাঠায়। নিউ সাউথ ওয়েলস তথা এদেশের সবচাইতে বড় এবং জনবহুল অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পাঠানো এই আমন্ত্রণ পত্রে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রী অর্ককে বার বি কিঊ পার্টিতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এবং সে সাধে একজন অতিথিকেও নিতে পারবে। এই বার বি কিঊ পার্টিতে উপস্থিত থাকবেন বৃটিশ রাজা চার্লস ও তাঁর পত্নী কামেলা। সিদ্বান্ত হলো সে একজন অতিথি হিসেবে অর্ক আমাকে সাথে নেবে। এরপর অপেক্ষআর পালা। পার্টির তিন দিন আগে জানানো হলো কড়া নিরাপত্তার লিখিত বিধান। ড্রেসকোডে না স্যুট না টাই ক্যাজুয়াল এমন কি যার যার দেশের ঐতিহ্যবাহি পোশাক পরিধান করলেও চলবে। বাড়ির কাছে বিশাল এক পার্কের একটি চত্তরকে নিরাপত্তায় মুড়ে আয়োজিত বার বি কিউ পাটরইতে গিয়ে দেখি আমন্ত্রিতদের জন্য জামাই আদরের ব্যবস্থা। ত্রিশ বত্রিশটি স্টলে বা তাঁবুতে খানাপিনার আয়োজন। বিশ্বখ্যাত সুরা নরম পাণীয় থেকে শুরু করে দেশিয় খাবার চা কফি সবকিছু অঢেল। আমরা খাই আর ঘুরি। ভাবলাম রাজা আসবেন হাত নাড়বেন চলে যাবেন।
কিন্তু তাঁর আগমনের ঠিক দশ মিনিট আগেই দড়ি দিয়ে দু ভাগে ভাগ করা হলো মানুষজনকে। মাঝখানে অল্প একটু যাবার পথ। যে পথ দিয়ে রাজা হেঁটে গিয়ে খোলা মঞ্চে উঠবেন। দড়ির একদিকে কামেলা আরেক দিকে রাজা চার্লস। সৌভাগ্যক্রমে কিং পড়লেন আমাদের দিকে। কা‘র সাথে হাত মেলাবেন আর কা‘র সাথে মেলাবেন না সেটা ভাগ্য কিংবা লটারীর মতো। ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকা রাজা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দনের ফাঁকে কথাও হলো একটু আধটু । আমার পেছনে দাঁড়ানো পুত্রের সাথেও বাক্য বিনিময় করে করমর্দন করলেন কিং চার্লস। আমাদের ঘোর কাটতে না কাটতে পার্কের খোলা মঞে দাঁড়িয়ে স্বল্ল কথায় ভাষণ দিলেন তিনি। কী আশ্চর্য বসার জন্য একটি চেয়ার ও রাখা ছিল না। ঐ ছোট্ট ভাষণে কোন গুরুগম্ভীর কিছুই বলনে নি। রাজনীতি ও না। হালকা রসিকতা আর অস্ট্রেলিয়ার সাথে তাঁর দীর্ঘ চেনাজানার গল্প বলেই শেষ করলেন।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হলো একেই বলে ভাগ্য। আমাদের দেশের দু একজন প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যাবার ভাগ্য হয়েছিল। চামচা স্তাবক আর ভক্ত নেতাদের ভিড়ে কাছে যাবার উপায় থাকে না। স্টেজ জুড়ে থাকে বক্তৃতা দেয়ার অসংখ্য লোকজন। এঁরা দুনিয়া কাঁপানো হলেও সহজ সরল। রাজা চলে গেছেন। আর কোনকালে তাঁর সাথে দেখা হবে না। কিন্তু আজীবন মনে থাকবে করমর্দনের সুখস্মৃতি যা এক জীবনে বারবার আসে না।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট