দূরের দুরবিনে

যে খেলা চলছে নিরন্তর

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ২০ অক্টোবর, ২০২৪ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়, রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী। কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি? খেলা ভেঙে দেয়ার খেলা খেলার ডাক না খেলা ভাঙা রোধের খেলা। সে জানি না তবে ভাঙাভাঙি বেশ ভালোই চলছে। না, ভাববেন না আমি খালি মূর্তি ভাঙার গল্প বলছি। ওটা এখন গা সওয়া ব্যাপার। সামাজিক মিডিয়ায় কারা যেন উপদেশ দিচ্ছেন সামনের বার থেকে দু সেট করে প্রতিমা বানাতে। এক সেট যখন ভাঙবেই নিশ্চিত বাকী সেট দিয়ে পূজা হবে। মন্দ না আইডিয়াটা। এই ভাঙার পাশাপাশি  চলছে আরো অনেক ভাঙাভাঙি।

মন ভাঙার কথাই বলি। সাকিব আল হাসান তো একজন ই হয় বলে জানি। আমাদের এই সিডনি বা অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট দারুণ জনপ্রিয় খেলা। যদি ও তার জায়গা তিন নাম্বারে। তার আগে আছে এ এফ এল রাগবি এসব। এই খেলা মানে ক্রিকেট ভারত পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মানুষদের জন্য কবে যে নাম্বার ওয়ান হয়ে যাবে বলা যায় না। এই নাম্বার ওয়ান হবার খেলাটিতে বাংলাদেশের এগারজনের নামই সাকিব আল হাসান। কেন বললাম? অনেক সাদা কালো মানুষদের বলতে শুনেছি সাকিবরা খেলছে বা খেলবে। সাকিব দেশে এখন একজন অপরাধী মানুষ অন্তত বিচার না হওয়া পর্যন্ত। যেন তেন না গুরুতর অপরাধ। যে কারণে তার মাদার বা ক্রিকেট বোর্ডও তাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলে দিয়েছে। এই সাকিব আল হাসান উপমহাদেশে পপুলার ক্রিকেটার হলেও তাকে এখন আমেরিকায় যেতে হয়েছে। আর কবে কখন খেলবে কে জানে? এই কারণে মন ভাঙা বাঙালির সংখ্যা কম না।

তা ছাড়া কার পোশাক কেমন হবে কী ধরনের কাপড় পরবে নারী হলে কীভাবে চলবে এটা নিয়েও চলছে ভাঙা। এক নারীর গাড়ির কাচে থুথু দিতে থাকা মানুষটিকে দেখে অবাক লাগছিল। ভদ্রলোক ভালো করে চোখে দেখেন কি না কে জানে। তারপরও গাড়ির ভেতর বসে থাকা নারীর পোশাক তার ভালো লাগে নি। তাকে উপদেশ দিতে দিতে একসময় কাচে থু থু আর এমন সব গালাগালি দিয়েছে যে সে নারীতো বটেই তাবৎ নারীদের মন ভাঙা কাচের মতো টুকরো হবার পথে।

যে দিকে চোখ রাখবেন খালি ভাঙা আর ভাঙা। পথ ভাঙছে রাজনীতি ভাঙছে সমাজ ভাঙছে। এমন কি যে ঐক্য গড়ে শয়তান হটানো তাও নাকি ভাঙতে শুরু করেছে। অথচ আমরা আশা করেছিলাম এবার ভাঙার বিপরীতে গড়ার কিছু হবেই। সে স্বপ্ন যদি ভাঙে তো উপায়?

কথা হচ্ছে এসব বন্ধে বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে? গুজবের মুখে তালা লাগাবে কে? কোথায় আমাদের সেই সব স্বপ্নবাজ? শেষে যেন ঠগ বাছতে গাঁ তথা দেশ উজাড় না হয়ে যায়।

এ বিষয়ে সৌভিকের গল্পটি দারুণ:

রাজা মশায়ের কাছে খবর আছে, কারা যেন বেশি বেশি খায়। রাজা মশায় পাত্রমিত্রসভাসদ আদি সক্কলরে ডাকেন আর প্রশ্ন করেনতোমরা জানো কে কে বেশি খায়? পাত্রমিত্রসভাসদ আদি কেউ বলল, হ্যাঁ, কেউ বলল, না। রাজা বললেন, তা তোমরা তাদের আটকাতে পারো না? সব্বাই সাথে সাথে রে রে করে চীৎকার করে উঠে বলল, পারি নাপারি নাপারি না

রাজার ভুরু কুঁচকালোবললেন কেন পারো না? সব্বাই আবার হাউমাউ করে উঠে বলল, ওরা নিতান্তই চালাক, দুষ্ট, কূটকৌশলী মহারাজ! আর আমরা নিতান্তই সাদাসিধা, সরল, সৎ চিন্তক, ওদের গুপ্ত গতিবিধির খবর রাখি এমন চতুরতা কি আমাদের সাজে?

রাজা আবার ভুরু কুঁচকালেন, জিভ কামড়ালেন, বললেন, তবে উপায়? সব্বাই এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল, সত্যিই তো উপায় কী হবে? আরে চোরে চুরি করবে, ডাকাতে ডাকাতি করবে, ঠগবাজ লোক ঠকাবে, ঘুষখোর ঘুষ খাবে, কালোবাজারী দুনম্বরি করবেএই তো চিরটাকাল শুনে আসছিএর আবার কোন উপায় হয় নাকি?…না হতে হয়?

তবু সভা বসল। রাতারাতি ঠিক হয়ে গেল উপায়। মধ্যরাত্রে ঘোষণা হল

শোনো শোনো শোনো নগরবাসীএখন থেকে তোমরা দুদিন আহারাদি করবে নাআর পঞ্চাশদিন অর্ধাহারে থাকবেতা হলেই যারা বেশি খেয়ে শরীরে বেশি মেদ জমিয়েছে তারা পটপট করে ধরা পড়ে যাবে

নগরে হুলুস্থুল পড়ে গেল। রাজা বলে কী? যারা বেশি খেয়ে মেদ জমিয়েছে তারা না হয় ধরা পড়ে গেলযারা খায়নি?! হ্যাঁ গো তারা তো দুর্বল হয়ে শয্যা নেবে! আর যারা এমনিতেই খেতে পায় নাতারা তো মৃত্যু শয্যা নেবে গো!

নগরে ছিল কিছু অনেক উঁচুতে বসা জ্ঞানীর দল, যারা সব নগরেই থাকে সব সময়। যাদের পায়ে ধুলোবালি লাগে না। আর তারা এত উঁচুতে থাকে বলে এত দূরের জিনিস দেখতে পায় যা ইতর সাধারণ লোকে দেখতে পায় না।

তো তারা চোখ রাঙিয়ে, মাথায় ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, বাছারা ত্যাগ কর। সাহসের সাথে দাঁড়াও রাজার পাশে। বেশি খাওয়া লোকগুলোকে বের করতে দাও

তখন এক পাগলা অঙ্কের মাস্টার ক্ষেপে গিয়ে বলল, ক্যানো রে পোড়ামুখো, হাড় হাভাতের দলআমরা প্রত্যেক মাসে কর দিই নাযাতে করে দেশের সুরক্ষা, আইন, তদন্ত, গোয়েন্দা, শুল্ক ইত্যাদি বিভাগের লোকেরা মাইনে পেয়ে তাদের কাজগুলো ঠিকঠাক করতে পারে? তাতো তোরা পারলি নাএখন নিজেদের সেই ব্যর্থতার বোঝা আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাস কেন?

তা সেই অঙ্কের মাস্টারের কথা কে আর শুনবে? কেউ শুনল না। না জনতা, না জননেতা। নগরে তখন প্রচণ্ড হুলুস্থুলু বেঁধে গেছে। সব্বাই বলছে আজ যতটা পারিস খেয়ে নে রেখেয়ে নেখেয়ে নেখেয়ে নে

শুধু নগরের মূর্খ, দরিদ্রলোকগুলো কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, এরা ছুটলে ওরাও ছুটছে, এরা থামলে ওরাও থামছেআর মাঝে মাঝেই একে তাকে প্রশ্ন করছেকই যামু কত্তাকী খামু কত্তাকদ্দিনের নিষেধ কত্তাসব আনাজ ফেলে দিমু

কেউ শুনছে নাসবাই বলছে সব কালো সাদা হবেঘরে আরো ধন হবে

নিন্দুকেরা বলছে ভোটে ভোটে আর দিন গোনো নাদুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না

বলল, এরেই নাকি বলে, ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়….

আমরা ভাঙাভাঙি চাই না। আস্ত পুরা একটি সমাজ চাই। চাই আমাদের চমৎকার স্বদেশ। স্বদেশ ভালো না থাকলে কেউ ভালো থাকে না। কেউ বাঁচলেও বাঁচতে পারে না।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধশ্রমিক শ্রেণীর লড়াইয়ে চৌধুরী হারুনের আদর্শ অনুসরণ করার আহবান