কিছুদিন আগে জরুরি পারিবারিক কারণে দেশে যেতে হয়েছিল। ঢাকা এয়ারপোর্ট নিয়ে আমার দু ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। একটি ভালো অপরটি নিঃসন্দেহে ভালো না। হয়রানী আর দেরী করানোর বেলায় আমাদের বিমানবন্দর শীর্ষে । বিশেষ করে আমাদের মতো প্রবাসীদের পেলে তো কথাই নাই। সব সময় যে তা হয় তা কিন্তু না। যেমন এবার পৌঁছে দেখি আমাদের বিমান বন্দর থেকে যেন বিদায় করতে পারলেই বাঁচে তারা। খুব দ্রুত পাসপোর্টে সীল মেরে মুখের দিকে ভাবলেশ হীন তাকিয়ে হাতে পাসপোর্ট টা ধরিয়ে দিয়েছিল। ধন্যবাদ বা স্বাগতম এসব কিছু আমাদের দেশের এয়ারপোর্টে চলে না। এমনকি আমরা বললেও তার জবাব মেলে না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঘ আর সারসের গল্পের মতো। ব্যাটা জান নিয়ে পালা। মুখ থেকে মাথা বের করতে পেরেছিস এটাই তো যথেষ্ট। এবার তাদের আগ্রহ আর তাড়াতাড়ি বিদায় করার কারণ বুঝলাম ইলিগ্রেশান পার হবার পর। ঢাকা‘র আকাশ তখন অন্ধকার। চারদিকে সবাই ব্যস্ত ভাবে ছোটাছুটি করছেন। এও বুঝলাম কেন মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনসের বিমানটি অবতরণ না করে আকাশে চক্কর মারছিল। যদিও তারা যাত্রীরা মানে আমরা ভয় পাবো বলে ঘোষণায় অন্য কিছু বলছিল। আসলে কারণ ছিল রোমেল। ঘূর্ণিঝড় তখন প্রায় আসন্ন। সে কারণে দ্রুততম সময়ে পার হয়ে গেলাম বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এটাও মানতে হবে এখন আর আগের মতো ঝুট ঝামেলা নাই। কাউন্টারে কর্মরত অনেকেই বয়সে নবীন। তারা দেরী করানোর সংস্কৃতি শেখে নি। বরং ব্যবহার আর সেবায় তাদের এগিয়ে রাখতেই হবে ।
দেশের ভেতরটা সবসময় ভিন্ন ধরনের। আপন মানুষজন আর পরিচিত গন্ডি মানেই সুখ। যে কথা বলছিলাম দেশে গেলে আমি সাধারণ নামে পরিচিত অসাধারণ মানুষদের সাধে সময় কাটাতে পছন্দ করি। যখন ই সুযোগ মেলে তাদের সাথে মন খুলে কথা বলি। চট্টগ্রাম যেতে এবার দু দিন সময় লেগে গেছিল। পরপর দু দিন ফ্লাইট বাতিল হবার পর তৃতীয় দিনে যাত্রা এবং পৌঁছানো। এই দু দিন আমি ঢাকা শহরে কোথাও যেতে পারতাম না? অবশ্যই পারতাম। কারণ ঢাকায় রোমেল আঘাত হানে নি। কিন্তু এই দু দিন আমাকে রাস্তার পানিবন্দী মানুষ আর বন্যার মতো পানির আসা যাওয়া দেখেই সময় পার করতে হয়েছে। খটকা লেগেছে এই ভেবে বাইরে বসে আমরা যে উন্নয়নের কথা শুনি এবং যে অগ্রগতি চোখে পড়ে তার সাথে তো এটা মেলে না। একটু বৃষ্টি হতেই তলিয়ে গেল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। চট্টগ্রামের পানিবদ্ধতা তো ইতিহাস। দেশের দুই প্রধান নগরীর এই হাল আমাদেরকে ব্যথিত করে। কোথায় তাহলে গলদ?
ঐ যে বলছিলাম এর কারণ দুর্নীতি। যে বিষয়টি চোখে পড়লো সিস্টেম লস বা নিয়মহীনতা। এবং আশ্চর্য হলেও সত্য এই নিয়মহীনতার ভেতরেই আরেকটি নিয়ম কাজ করে। যে কারণে সবকিছু হয় বা হচ্ছে। অথচ শুরুতে মনে হবে এ কাজ হবে না বা হতে পারে না। এর ভালো দিকটি যেমন বললাম তেমনি খারাপ দিক হছে অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তা মানুষকে ভাগ্যমুখি করে তোলে। অদৃশ্যের কাছে নতজানু মানুষ আস্থা হারায় নিজের প্রতি। তখন এসব আগাছাদের জন্ম যারা নানা বেড়াজালে সমাজকে আটকে ফেলে। শুরু হয় অন্ধত্ব ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিষয়টি মায়া। দুনিয়ার আর কোন দেশে আপনি এমন মায়া ভরা সমাজ পাবেন না। পাশের বঙ্গে ও বাঙালির বসবাস। তারা আমাদের মতো বাংলায় কথা বলে। তাদের পোশাক খাদ্য আচার ব্যবহার আমাদের মতো। কিন্তু আমার সেখানে গেলে নিজকে আগন্তুক বা পরবাসী মনে হয়। এর মূল কারণ আন্তরিকতার অভাব। তাদের পেশাদারিত্ব আমাদের চাইতে বেশি, সার্ভিস বা সেবা ও তাই। কিন্তু আমাদের মতো টান বিষয়টি সেখানে কাজ করে না। ডিজিটাল জগত এই টানের ওপর তার থাবা বিস্তার করলেও বাংলাদেশে মায়া আছে। যা এখনো অম্লান ।
বিশ্ব বাস্তবতার কঠিন ছায়া পড়েছে সমাজে। বিশেষ করে বাজারে জিনিসের দাম আগুনের মতো। সাধারণ মানুষের রাগ আর অসন্তোষের মূল কারণ সেটাই। তারা কিনতে পারছেন না। কেবল গুটিকয় মানুষ আর একটি শ্রেণির কথা ভাবলে বা বাস্তবতায় রাখলে হবে না। সাধারণ মানুষ দামের জন্য বড় খারাপ অবস্থায় আছেন। আমাদের এই সিডনিতেও আমরা ভালো নেই। আগের মতো বাজার করা বা যা খুশি কেনাকাটা করার দিন শেষ। মেপে মেপে প্রয়োজনমতো সবকিছু করছে মানুষ। পার্থক্য এই আগুন দামের জিনিষ পানির মতো করে কেনার কোন বিশেষ শ্রেণি নাই এখানে। যে কারণে দুঃখটা এক কারো নয়। সবাই সমান ভুক্তভোগী।
সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর ডিজিটাল এমন ভাবে ঢুকেছে যে মানুষ আসলে ভালো মন্দের তফাৎ করতে পারে না। আমার মনে হয়েছে সরকার বা প্রশাসন খারাপ চলছে না। খারাপ চলছে সমাজ। সমাজের এই সংকীর্ণ ও নাজুক অবস্থার জন্য দায়ী রাজনীতি। জনমানসে এর কোন প্রভাব না থাকলেও মিডিয়ায় আছে। ফলে মানুষ মিডিয়া বিমুখ। তাদের ঘরে ঘরে ওপারের চ্যানেলগুলোর রমরমা অবস্থা। হবে না কেন? যে ক‘দিন আমি ছিলাম চ্যানেল ঘোরালেই চোখে পড়তো টক শো। নানা ভাবে কথা হচ্ছে। সব চ্যানেলে খালি কথা আর কথা। এতো কথা হজম করার শক্তি নাই মানুষের। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মতামত দেয়া। যে জানে যে জানে না সবাই মিলে খালি উপদেশ দেয়। এই উপদেশ ক্লানত সমাজে সবচেয়ে কঠিন জায়গায় আছে শিশু কিশোর আর বয়োবৃদ্ধেরা। তাদের নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা কোথায়? সুস্থ বিনোদন বা সংস্কৃতি আজ প্রায় উধাও। আগে ঘরে ঘরে গান বাজনা আর আনন্দের উৎস ছিল আড্ডা। গান বাজনা বিলুপ্ত প্রায়। আর আড্ডা? সে জায়গা দখল করেছে বায়বীয় জগৎ। যে কারণে মানুষ এখন একা। ভীষণ অসহায় ও একা। এমন ই এক বাস্তবতা কেউ হাসপাতালে গেলে তাকে দেখতে যাবার আগে সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট দিতে ব্যস্ত সবাই। যাত্রা পথে আরেক পোস্ট। তারপর পৌঁছানো মানে ফটো সেশন। এর ভেতর আন্তরিকতা কোথায়? কোথায় ভালোবাসা?
আধুনিক হবার জন্য যে সব উপাদান জরুরি তার সব ই আছে দেশে। কিন্তু আদর্শ বা দিক নিদের্শনা নাই। মানুষ বই পড়ে না এ কথা আমি মানি না। বাতিঘর নামের বুকশপে গিয়ে দেখলাম দলে দলে বাচ্চারা যায় সেখানে। বই পড়ে। কিন্তু কি বই পড়ে কোন বই তাদের চোখ খুলে দিতে পারে সেটা সম্ভবত জানে না। লেখকেরা সেখানে যায় নিজেদের প্রচার করতে। ভাষণ দিতে। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য বা নবীনদের জন্য যায় না। এই অভিভাবকত্বের সংকট দেশের সব জায়গায় দেখা যায়। যে কারণে আমরা এক পা এগিয়ে দু পা পিছিয়ে পড়ছি বারবার। তারপর ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। এটা গেলেই টের পাই। সঠিক নেতা সঠিক পথ আর সঠিক কাজ করলে আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশ তার তারুণ্যের প্রতি আস্থা রাখতেই পারে। বাকীটা যারা সমাজপতি তাদের দায় দায়িত্ব। এখন তারুণ্যের জয় জয়াকার। তারা যদি শক্ত হাতে হাল ধরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইতিহাসমুখী হয় জয় হবেই।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট