বই মেলায় যাওয়া আর বই কেনা ভিন্ন বিষয়। বাইরের কথা বাদ দিয়ে শুধু কলকাতার কথা ধরলেও দেখছি সেখানে যারা বই মেলায় যায় তাদের বেশীর ভাগ বই কিনে ফেরত আসেন। তাদের যাবার উদ্দেশ্য বই কেনা। আমাদের দেশে নিশ্চিতভাবেই বই কেনার প্রচলন হয়েছে। মানুষ ব ই কেনে বিশেষত নারীরাই বেশী কেনে। আর কেনেন বয়স্ক ব ই যুগের মানুষরা। কিন্তু তারপরও আমাদের সমাজ আর জনসংখ্যার দিকে তাকালে এক ধরনের প্রশ্ন থেকেই যায়। লাখ খানেক মানুষ একুশের দিনে বাংলা একাডেমি বই মেলায় গিয়েছিলেন শতকরা কতজন কিনেছেন সেটা গবেষণার বিষয়। এই ব্যবধান একদিকে যেমন ব্যবসার জন্য মন্দের, আরেকদিকে আমাদের পড়াশোনার মান নিয়েও প্রশ্ন রাখে বৈকি। এই আলোচনায় পাঠকের পাশাপাশি আমরা লেখক প্রকাশকদের কথাও ভাববো। তাঁদের দায় দায়িত্ব নিশ্চয় ই গুটিকয় উপন্যাস গল্পের বই বা কবিতার বই প্রকাশ করা হতে পারে না। কতো কতো বিষয়ে বই লেখা বাকী। বিজ্ঞান মহাকাশ সাগর অসীম সম্ভাবনা সব বিষয়গুলো এখনো অধরা। এগুলোর প্রয়োজন খুব বেশী।
আর একটা বিষয় বলা দরকার। বঙ্গবন্ধু আমাদের জনক। আমাদের সোনার খনি। তাঁকে নিয়ে লেখার আগে ভাবনা চিন্তা গবেষণা আর জানার পরিধি বাড়াতে হবে। আবেগ মথিত ভাবাবেগ ক্লান্ত লেখা অনেক হয়েছে। বের হয়ে গেছে হাজার হাজার বই আর নিয়ত হচ্ছে তাঁকে ঘিরে লঘু সব প্রকাশনা। এখন রাশ টানার সময়। আশা করব এমন সব লেখক বা গবেষকরা সামনে আসবেন যারা খেটেখুটে কষ্ট করে তাঁকে নিয়ে লিখবেন তাঁদের জন্য আগাম অভিনন্দন।
বই বিক্রি করা হলেও বইকে আমি পণ্য মনে করি না। বই হচ্ছে আত্মার খোরাক, মনের খাদ্য। খেয়াল করবেন, মানুষ টিভি দেখতে দেখতে কঠিন হিসাব কষতে পারে। গান শুনতে শুনতে রান্না করা হয়ে যায় কারো কারো। সঙ্গীতানুষ্ঠান কিংবা খেলা দেখতে দেখতে উপন্যাস ও রচিত হয়।কিন্তু বই পড়তে গেলে তখন আর অন্য কোন কাজ করতে পারে না মানুষ। বই পড়াটা উপাসনার মতো পবিত্র। তাই উপাসনালয় ও লাইব্রেরি মানেই পিন পতন নীরবতা।
এসব কারণে বইয়ের কোন দোকান হয় না, আমি বলি বইঘর। সিডনি”র উপকন্ঠে এই বইঘরটিতে নিয়ম হচ্ছে মোবাইল জমা রেখে ঢুকতে হবে। কিন্তু ল্যাপটপ বা তেমন কিছু নেয়া যাবে টাইপ করার জন্য বা নোট নিতে হলে। বই কিনতেই হবে কথা নাই, পড়া যাবে। সে বইঘরে চা কফি ফ্রি। খানাপিনারও ব্যবস্থা আছে। তবে কিনে নিতে হয়। ছোট অথচ বইঠাসা এই বইঘরে মজাদার খাবারও বই দুটোই সমান আকর্ষণীয়।
বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর জন্মলগ্ন মানেই একুশে। দুনিয়ায় এমন ভাষা ভিত্তিক দেশ খুব একটা চোখে পড়ে না। এই যে আমরা সিডনিতে থাকি এই দেশ অবশ্যই উন্নত এক দেশ। অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর আধুনিক দেশ হলেও এর অতীতের সাথে কিছুটা কালো কিছু কলংক জড়িয়ে আছে। ৬০ হাজার বছরের ইতিহাস সম্পন্ন এই দেশের আদিবাসীদের বলা হয় এবরজিন্যাল। এরাই এদেশের আদি মানুষ। দেখতে কালো দশাসই বিরাট আকারের এদের শারীরিক শক্তি অধিক হলেও তারা ইংরেজদের সাথে কৌশল বা যুদ্ধে পেরে উঠতে পারে নি। কাপ্তান কুকের আগমন আর ইংরেজদের আধিপত্যে পরাজিত আদিবাসীদের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছিল এই মাটিতে। আজ এরা গলগল করে ইংরেজি বলে বটে কিন্তু তাদের মুখের ভাষা উধাও। দুনিয়ার যে কোন জাতির বা মানুষের মাতৃভাষার অপমৃত্যু কিংবা কেড়ে নেয়া সমর্থন করা যায় না। আমরা তো তা করতে ই পারি না। আমাদের দেশে সেই বায়ান্ন সালে জেগে উঠেছিল যুবশক্তি। আজ যারা নানা কারণে এই দেশ ও ইতিহাসের ভিন্ন পথে চলে আধুনিক হবার ভান করে তারা জানেই না কি অসীম শক্তি ছিলো সে সময়। এই শক্তির আধার ছিল বাঙালি হওয়া। সে বাঙালি হবার সংগ্রাম ই ত্বরান্বিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের। যার অনিবার্য পরিণতি একাত্তরের যুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশ।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ নানাভাবে বিকশিত। আজ তার গায়ে লেগেছে উন্নয়নের হাওয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগুয়ান দেশে শান্তি চায় না একদল মানুষ। এদের কাজ হচ্ছে সমালোচনার নামে নিন্দা। এদের কাজ হচ্ছে অশান্তির দাবানল তৈরী করা। সে দাবানল আজ দুনিয়ার নানা দেশে দেখতে পাচ্ছি। অকারণে বা মিথ্যা অজুহাতে তাদের যে বিরোধিতা তার পেছনে আছে দেশ ও ভাষার প্রতি অবহেলা। সে কারণেই তারা বাঙালি হতে পারছে না। বাঙালি হবার পথে আজ না দেশ অন্তরায় না সমাজ। রাষ্ট্র হিসেবে এই দেশ বাংলা ও বাঙালির একমাত্র প্রতিনিধি। সে কারণে ভাষার মাসে প্রত্যাশা ও বেশী। কিন্তু সে আশা পূরণে কি আমরা সঠিক পথে এগুচ্ছি?
বলছিলাম বাংলা ভাষার কথা। বই মেলা ও ভাষার জয়যাত্রা থামবে না। সেটা কথার কথা না। এটা সত্য। কিন্তু দু:খের বিষয় আমাদের দেশে কথিত ইংরেজি শেখার নামে এখন চলছে বাংলার আকাল। বাচ্চাদের ভুলভাল ইংরেজি শেখানোর জন্য কথিত কিন্ডারগার্টেন বা এমন সব স্কুলে পড়ানোর নামে যে প্রতিযোগিতা তার অবসান চাই। সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একটি দামী কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে ভাষা দূষণ নদী দূষণের চাইতেও ভয়ংকর। কথাটা যে কতো সত্য তা আজকালকার নাটক সিনেমা কবিতা গান যে কোন কিছুর দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
মূল কথা এই আমাদের গৌরবের ভিত্তি ভূমি এই ভাষার মাস। সে যখন ই আসে দেশজুড়ে বিদেশে প্রবাসে বাংলার শীতল হাওবা বয়ে যায়। মনে আত্মায় বাঙালি হবার ডাক পাই আমরা। বলছিলাম সিডনির একটি নতুন ধারার বইঘরের কথা। এমন ধারা দেশেও শুরু হয়ে গিয়েছে। মোবাইল নির্ভরতা কমিয়ে ফেইসবুক বা সামাজিক মিডিয়া থেকে মুখ ফেরানোর জন্য এমন উদ্যোগের বিকল্প নাই আজ। ভাষার মাস আসুক বাঙালি হবার উদাত্ত ডাক নিয়ে। ভাসিয়ে নিয়ে যাক বাংলা বাঙালির সকল জঞ্জাল।
দেশের বই মেলার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও আজ এই মেলা জমজমাট। প্রতিভা আর মেধার শহর চট্টগ্রাম। এই শহরের ঐতিহ্য আর অতীতের সাথে জুড়ে আছে বর্তমান। এই শহরের মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছিলেন একুশের প্রথম কবিতা। এই শহরের দায় আছে বাংলা বাঙালিকে বই কে প্রিয় করে তোলার। সে কাজটি ই শুরু করা হোক এবার। এটাই কামনা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, কলামিস্ট