মুক্ত এবং স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।এর মাধ্যমে নাগরিকরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের তথ্য জানার পাশাপাশি তাদের নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারে। স্বাধীন গণমাধ্যমের অধিকারের বিষয়টি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার দলিলের পাশাপাশি বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের গুরুত্বকেস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ঘোষণাপত্রের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে; কোন ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়া অবাধে মতামত পোষণ করা এবং রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে যে কোন মাধ্যমের মারফতে তথ্য ও ধারণাগুলো জানা/অনুসন্ধান, গ্রহণ ও বিতরণ করা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।”
গণতন্ত্রের মোড়ল নামে পরিচিত আমেরিকায় প্রায় ই এমন সব কান্ড ঘটে যাতে মনে হয় সত্যি কি গণতন্ত্র এমন? যেখানে স্কুলে ঢুকে কলেজে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করা যায়? যেখানে বাচ্চা ছেলেরা আততায়ীর হাতে বিনা কারণে মারা যায়? যে দেশে একজন কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিশ পায়ের তলায় পিষ্ঠ করে আর আক্রান্ত আমি শ্বাস নিতে পারছি না বলে জান হারায়? যে দেশে এক বুশের পর আরেক বুশকে জেতার জন্য আলগোরেকে অন্যায্য ভাবে হারানোর ন্যায্য অভিযোগ মাথা কুটে মরে? গণতন্ত্র কি এমন যে সমাজে একজন নিরীহ বাঙালি যুবক তার গাড়ি ছিনতাই করতে না দেয়ায় জীবন হারাতে বাধ্য হয়? কিন্তু গণতন্ত্র আছে বলে এসব ঘটনা বাইরে আসে। প্রতিক্রিয়া হয় সে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মানুষ জানে এবং তাদের অবস্থান ও নিতে পারে নিঃশঙ্ক চিত্তে। যা আমাদের সমাজে এখন হয় না। বা হবার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
একদল মানুষ গণতন্ত্র বলতে বোঝেন শুধু ভোট দেয়ার অধিকার। আরেকদলের মত হচ্ছে গণতন্ত্র যদি সবার মতামত হয় তো হিরো আলমের মতো নেতাদের মানতে হবে সুতরাং সে গণতন্ত্র না হলেও চলে। গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ যে আচরণ বা শিক্ষা সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ও চর্চা নাই। এখন এমন একটা সময়কাল চলছে যেখানে গণতন্ত্রের নামে ছাপ্পা মারার প্রতিযোগিতা অথবা মারদাঙ্গা বাধানো এটাই যেন নিয়ম।
বাঙালি এখন দুনিয়ার নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা এক জাতি। এক কোটি বাংলাদেশীর বসবাস প্রবাসে। এই এক কোটি জনসংখ্যা ইউরোপের বেশীর ভাগ দেশের মোট জনসংখ্যার চাইতে অধিক। এই যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী জনগোষ্ঠী তারা কি সেসব দেশের মুক্ত উদার সমাজ ও গণতন্ত্রকে আত্মস্থ করতে শিখছে? শিখছে না। দেশের উগ্র ও নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে পৃথিবীময় বিভক্ত হয়ে পড়া বাংলাদেশীরা কি পারবে নিজেদের দেশে গণতন্ত্র বজায় রাখতে? নেগেটিভ দিকগুলো আলোচনা করার আগে বলতে চাই, ইউরোপ আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়া বা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশীদের ভেতর এখন যে হারে দেশের রাজনীতি চর্চা তার সিকিভাগ ও তারা সেসব দেশের গণতন্ত্র বা জীবন নিয়ে ভাবে না। হ্যাঁ জীবনযাপন তারা করে কিন্তু ডুবে থাকে দেশের পঙ্কিল রাজনীতিতে। আমেরিকার কথা বলছিলাম সেখানে একটা কথা চালু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট শাসন করে চার বছর তারপর হয় থাকে নয়তো বিদায় হয়। আর মিডিয়া সে সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর। এবং এটাই নিয়ম।
গণতন্ত্র বিষয়ে দেশের মানুষজনের সঠিক ধারনা কি আসলেই আছে? যেসব মৌলিক বিষয় একটি দেশ ও সমাজকে চালায় তার দিকে খেয়াল করার মতো রাজনীতি নাই। আছে হানাহানি। সমপ্রতি পদযাত্রা শোভাযাত্রা শান্তি মিছিল সব মিলিয়ে আবার উত্তপ্ত স্বদেশ। কোন দল বা মতের প্রতি অন্ধ না হয়েই বলি গণতন্ত্রের একটি বড় ধাপ সহিষ্ণুতা। তারপরের ধাপ দেশ ও সমাজের মঙ্গলে ঐক্যবদ্ধ থাকা। এ দুটির একটাও আমাদের দেশে নাই। নাই বলেই মারমারি আর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় সমাজ উত্তপ্ত।
বাংলাদেশের যে অগ্রগতি ও উন্নয়ন তার পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ অবস্থান জরুরি। আমাদের পাশের বড় দেশ ভারত আছে চীন। দু দেশের সাথেই তাল মিলিয়ে চলতে হয়। ভারতে যেমন গণতান্ত্রিক ধারা বিরাজমান চীনে চলছে কমিউনিস্ট পার্টির একক শাসন। এ দুয়ের পার্থক্য অর্থনীতিতে তাদের প্রভাব ও প্রভুত্ব সবটাই সত্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সংবিধানে যাই থাক মূলত সবার সাধে সমান বন্ধুত্ব একটি আজগুবি বিষয়। এটা মানি যে কারো সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়া বা পায়ে পা লাগিয়ে হাঙ্গামা করার বিরুদ্ধে আমরা, এটাই নীতি। কিন্তু তাতে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? থাকলে নিশ্চয় ই মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলতো না। যার ভুলেই হোক দেশের কাঁধে লাখ শরণার্থীর বোঝা চাপতো না।
গণতন্ত্রের এই দিকটি কি সরকারী বা বিরোধী দল মানে না বোঝে? কোন দল রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিচলিত? কোন দল রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিছিল মিটিং করে? সে কারণেই বলছিলাম গণতন্ত্রে এক ধরনের সমঝোতা থাকে। সরকারী বা বিরোধী দল উভয়েই দেশের স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছে। একসাথে কাজ করে। যা আমাদের ভাগ্যে জোটে নি। জুটবে বলেও মনে হয় না।
তা হলে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে হৈ চৈ করার দরকার কোথায়? যে গণতন্ত্র মানে সমাবেশ জনভোগান্তি বা সরকারী আগ্রাসন তার সাথে কি জনকল্যা ণের কোন সম্পর্ক আছে? আমি জানি অনেকেই এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবেন। সেটাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু মানতে হবে আমেরিকা ইউরোপ বা অন্যদেশের নিন্দায় যেমন সমাধান নাই তেমনি তাদের অনুগ্রহে ও মুক্তি নাই। এই কারণে ভারতকে কেউ চোখ রাঙাতে পারে না। কারণ তারা গণতন্ত্রের পূর্ন মর্যাদা দেয় কি না জানা না থাকলেও এটা জানি নির্বাচন ও নানাবিধ সমাজ প্রক্রিয়ায় সে দেশে গণতন্ত্র আছে। আমাদের ও সেটুকু থাকলেই চলে।
সবার আগে মিডিয়া। একটা সময় ছিল যখন মানুষ ঈশ্বরের পর মিডিয়াকে বিশ্বাস করতো। তার সে বিশ্বাস এখন ভঙ্গুর। তার ওপরে আছে সামাজিক মিডিয়ার প্রকোপ। বহু অঘটনের সমাধান এবং বহু আপদ বিপদে সোশ্যাল মিডিয়া পাশে দাঁড়ায় এটা সত্য। সুরাহা ও করে দেয়। কিন্তু সিংহভাগ তার অপস্রোতে ভাসার বিষয়। কে কাকে কি লিখলো কে কাকে কি বললো বা কি করলো এ নিয়ে যে আগ্রহ উত্তেজনা তার একফোঁটাও নাই বাঙালির মনোজগত পরিবর্তনে। এই সামাজিক মিডিয়াকে কি আসলেই মিডিয়া বলা সঙ্গত? শুরুতে যে কথা বলছিলাম এসব উটকো সামাজিক মিডিয়ার কারণেই দেশে বিদেশে অপপ্রচার এখন সর্বগ্রাসী। আর তার আছর পড়ছে মানুষের মনে । মূল যে মিডিয়া বা মূল যে স্রোত তার পরিচর্র্যা না করলে তাকে তার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে না দিলে তার কন্ঠ রোধ করলে এমন ই হবে। আর একটা কথা লিখে শেষ করবো। শুধু সরকার বা দল নয় মালিক শ্রমিক বাণিজ্য আর মানুষ ও কি গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত? তারা কি আধুনিক সমাজ ও জীবনের মতো দায় মেনে নিতে চায় না পারে? যদি তার উত্তর না হয় তো সব দোষ নন্দঘোষের মতো সরকারের ওপর না চাপিয়ে যে যার জায়গা থেকে উদার ও গণতান্ত্রিক হতে পারলেই আমেরিকা বা অন্য মুরুব্বীর প্রয়োজন পড়বে না।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট