দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

রাষ্ট্রসংঘ জাতিসংঘ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী যা পারেন নি বা পারেন না তাই করে দেখালেন একজন গায়িকা। সুরের এমন ই শক্তি। দশকের পর দশক ধরে গান গেয়েছিলেন। সে গান কোন সীমান্ত মানে নি। মানে নি যুদ্ধ বিগ্রহ। আর সে কারণেই ভারতের চির শত্রু নামে পরিচিত পাকিস্তানেও নেমেছে শোকের ছায়া। এখন যিনি পাকিস্তানের উজিরে আজম বা প্রধানমন্ত্রী তিনি একজন ক্রিকেটার। শুধু ক্রিকেটার ই না তাঁর অধিনায়কত্বে পাকিস্তান জিতেছিল বিশ্বকাপ। ঠোঁট কাটা নামে পরিচিত ইমরান খান ও ভারতের সুর সম্রাজ্ঞী লতার প্রয়াণে ট্যুইট করতে পিছিয়ে থাকেন নি। বরং তাঁর ট্যুইটটি দারুণ। কথিত যে লতাজী ছিলেন ক্রিকেটপ্রেমী। নিজ দেশ ভারতের বিজয় কামনায় অনেক সময় উপবাস করতেন তিনি। নিশ্চয়ই সে উপবাস মাঝে মাঝে পাকিস্তানের জন্য ও করা হতো। তাতে কি? সুরের ধারা তো চলে গগণ বেয়ে। সে কারণেই নীরব থাকেন নি ইমরান খান। তিনি লিখেছেন দশকের পর দশক ধরে তাঁর গান সারা দুনিয়ার মানুষকে আনন্দ আর ভালোবাসায় রাঙিয়েছে।
বাংলাদেশেও যথাযোগ্য সম্মান আর শ্রদ্ধা পেয়েছেন লতা মঙ্গেশকার। লতা মঙ্গেশকারের বাংলা গানগুলি আমাদের পরম সম্পদ। একটার পর একটা গানে তিনি ডুবিয়ে রেখেছিলেন বাংলার সুর পাগল মানুষদের। শুনে বোঝার উপায় ছিলো না মারাঠী এক ভদ্রমহিলা গাইছেন। দু একটা উচ্চারণ এধার ওধার হতেই পারে। কিন্তু মূল বিষয় হলো ভাব। রোমান্টিক বিরহপ্রেম বেদনা সবগুলো বোধ কি চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর কন্ঠে । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে গীত দ্বৈত রবীন্দ্রনাথের গানগুলো যেন মায়ার খেলা।
প্রথম বাংলা গানটি তিনি গেয়েছিলেন আমার জন্মের বছর ১৯৫৯ সালে। অর্থাৎ ৬২ বছর আগে। এখনো আধুনিক সে গান। না যেওনা রজনী এখনো বাকী আরো কিছু কথা বাকী, বলে রাত জাগা পাখি গানটি শুনে দেখুন। মনে হবে আধুনিক কালের কোন শিল্পী গাইছেন। এই যাদু আর জাদুবাস্তবতাই ছিলো তাঁর ক্যারিশমা। খুব সহজে বিখ্যাতজনদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। সরস্বতীর বর পেতে হলে কষ্ট আর লাঞ্ছনাা পোহাতে হবেই। খুব সহজে যারা তরতর করে ওঠেন ততোটা সহজেই পতন হয় তাদের। আর যারা তাঁর মতো তাঁদের শুরুটা বা পথচলা যত কঠিন ভবিষ্যত বা কীর্তি ততোই উজ্জ্বল। ইতিহাস বলছে: এক মারাঠি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি, ১৯২৯ সালে। নাম ছিল তাঁর হেমা। কিন্তু বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর সেই নাম পরিবর্তন করে রাখেন লতা। ‘ভব বন্ধন’ নামে একটি নাটক ছিল, যার একটি চরিত্রের নাম ছিল লতিকা। সেই থেকে লতা। তিনি এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন এবং তার গাওয়া মোট গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি।[এছাড়া ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাতে ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তারই। ১৯৮৯ সালে ভারত সরকার তাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত করে। তার অবদানের জন্য ২০০১ সালে তাকে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়; এম. এস. সুব্বুলক্ষ্মীর পর এই পদক পাওয়া তিনিই দ্বিতীয় সঙ্গীতশিল্পী। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, ৪টি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ২টি বিশেষ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
তাঁকে নিয়ে একটি লেখায় পড়লাম : দেখা কি হয় সেসব মানুষদের সঙ্গে? তাঁদের আবির্ভাব ঘটে। আর তাঁরা একটা সাধারণ রক্তমাংসের শরীর ছেড়ে অনন্ত হয়ে যান। যাতে আমাদের সঙ্গে তাঁদের যুগ-যুগান্তর দেখাশোনা হতে পারে, কথা চালাচালি হতে পারে। সেই প্রথম দেখা মকবুল ফিদা হুসেনের সরস্বতী, যিনি দেবী কি ঈশ্বরী নন, জীবন্ত শরীরী এবং এক অনন্ত বিরহিনী রাধা। যিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন জীবনের গান। তা না হলে কি এত প্রেম, এত বিরহ, এত পূর্বরাগ, এত অভিসার অবলীলায় বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারতেন। আমি চুপ করে বসে সেই রাধারানিকে দেখছিলাম। লতা মঙ্গেশকরকে কেন্দ্র করে সলিল চৌধুরী নাইট, একের পর এক গান… কখনও ‘এ নদীর দুই কিনারে’ কখনও ‘আ যা রে পরদেসি’ হয়ে ‘না মন লাগে না’ থেকে ‘কেন কিছু কথা বলো না’, এ ভাবেই ‘না জানে কিউ’ ছুঁয়ে আরও কত গানে আমাদের গ্র্যান্ড হোটেলের রিহার্সাল রুমকে মোহিত করে তুলেছেন। দেখেছিলাম প্রতিটা মিউজিশিয়ানের চোখে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
লতা মঙ্গেশকার উপমহাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে আজ সব দেশে এক ও অভিন্ন যোগসূত্র। তাঁর মতো এমন কেউ আর কি আসবে কখনো? একশ বছর পর প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই সমাজে মাথা তুলে বলবে, আমাদের ভূখন্ডে এমন এক কোকিলকন্ঠী জন্মেছিলেন যাঁর সুর সারা দুনিয়াকে মোহিত করে রেখেছিল করেছিল আবেশমুগ্ধ। যাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই। এমন গায়িকা দুনিয়ার আর কোন দেশে নাই যিনি চরম শত্রুকেও এক করে রাখতে পারে। এমন গানের পাখি আকাশে হাওয়ায় থাকেন থাকেন মানুষের মনে। যে ভাঢ়াব যখন ই গান ধরেছেন তখনই তা হয়ে গেছে চিরকালীন সর্বজনীন। এ এক অদ্ভুত যাদুকরী গুণ। লতার মতো আমাদের জীবনে জড়িয়ে থাকা তাঁকে ভালোবাসার জায়গাটা চিরন্তন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের উপমহাদেশে এমন গুণী শিল্পী আর নাই হবে ও না।
এসব হিসেব নিকেশের গল্প। এই অর্জন বা পুরস্কার পদকের অনেক ওপরে তিনি। তাঁর মতো সম্মান বা ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বললেও কম বলা হয়। আপনি যদি তাঁর জীবনের দিকে ফিরে তাকান দেখবেন এ ছিল কর্ম আর ঈশ্বরের যৌথ ম্যালবন্ধন। লতা মঙ্গেশকার এর মূল্যায়ন বা তাঁকে নিয়ে আলোচনা করার সাধ্য আমাদের নাই। নাই উপমহাদেশের বহু সঙ্গীতজ্ঞেরও। তিনি সেই কুসুম যা ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন আমাদের পরিচয় সূত্র। আপনি যখন উপমহাদেশে কিংবা দেশের বাইরে তখন আপনাকে চেনার সূত্র কি কি? তার একটি শাখা সংস্কৃতি আর সে শাখার মূল এক গায়িকা লতা। বাঙালি না হয়েও দরদ আর মায়ায় বাঁধা গানে যুগ যুগ কাল থকে কালান্তরে ও মোর ময়নাগো কা’র বিহনে তুমি একেলা বা গোপীজন মনচোর গিরিধারী নাগর শুনে চোখে পানি আসবেই মানুষের। হঠাৎ করে আনন্দে মেতে উঠবে চোখ মুখ বাইরে তখন লতা গাইছেন গাচের পাতায় রোদের ঝিকিমিকি আমায় চমকে দাও চমকে দাও চমকে দাও…
আজীবন বুকে চমক দিয়ে যাওয়া লতাজীকে বিদায়ী প্রণাম।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসিলভার স্ক্রিনে আজ মুক্তি পাচ্ছে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ ২’