পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপমহাদেশে নতুন ধারা
পাকিস্তানেও হানা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। সমপ্রতি পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালে আমারো পরাণ যাহা চায় গানটি গীত হতেই ভাইরাল হয়ে গেছে। এক সময়ে পকিস্তানে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিন পর সেই পাকিস্তানেরই জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালে ব্যবহৃত হলো রবীন্দ্রসংগীত।এমনই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালে পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে গাওয়া হয়েছে “আমারও পরাণ যাহা চায়”। আর তা দেখে উচ্ছ্বসিত আপামর বাঙালি দর্শকরা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি শেয়ার করেছিলেন পাকিস্তানি পরিচালক মেহরিন জাব্বার। তিনি আবার তাতে ইনস্টাগ্রাম লিংকও সংযুক্ত করে দেন। যাতে দেখা যায় পুরোনো একটি ভিডিওই নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে। মেহরিন জাব্বার পরিচালিত “দিল কেয়া করে” ধারাবাহিকে ব্যবহার করা হয়েছিল গানটি। ক্যাপশনে মেহরিন জানিয়েছেন, গানটি গেয়েছিলেন শর্বরী দেশপাণ্ডে। পুরনো এই ভিডিওটিই আদিল হোসেন নামের একজন বাঙালির চোখে পড়ে। তিনি সেটি আবার বৃহস্পতিবার (৩ জুন) টুইটারে শেয়ার করেছেন। আবার একই দিনে ইউটিউবে একটি রঙিন ভিডিও শেয়ার করা হয় যাতে দেখা যায় আবার নায়কের অনুরোধে নায়িকা তাকে “আমারও পরাণ যাহা চায়” গানটি গেয়ে শোনাচ্ছে।
২০১৯ সালে পাকিস্তানের জিও টিভিতে সমপ্রচারিত হয় “দিল কিয়া কারে” ধারাবাহিকটি। মেহরিন জাব্বার-এর পরিচালনায় এই সিরিজের সংগীত পরিচালনায় ছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় সংগীত তারকা শাদাত আলী। ধারাবাহিকটির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফিরোজ খান, ইয়ুমনা জাইদি ও মির্জা জাইন বাগ।
এই পরিবর্তন বা পরিবর্তনের বাঁক ইতিহাসে কিভাবে নেবে? আমরা বাংলাদেশীরা পাকিদের রবীন্দ্র বিরোধিতার সবচেয়ে বড় শিকার। আইয়ুব খানের রোষাণলে পড়ে বঙ্গদেশে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। বাঙালি নামে পরিচিত কিছু মীরজাফর বাংলার দুশমন ছিলো এ প্রক্রিয়ার হোতা। আজ যদি আমরা পেছন ফিরে তাকাই লজ্জিত হবার বিকল্প থাকে না। স্বাধীনতার গান বা দেশ প্রেমের গান গেয়ে নামধাম করা গায়ক থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের নায়িকা গায়িকা লেখক বুদ্ধিজীবী কতো জন যে এ নিষিদ্ধকরণের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন তার তালিকা রীতিমত ভয়ংকর । এখন এদের উত্তরসূরী কিংবা পরিবার পরিজন হয় এসব কথা এড়িয়ে চলেন নয়তো খোঁড়া যুক্তি দেন সরকারের চাপে বা তখনকার বাস্তবতায় এমন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁদের পূর্বসূরীরা। আসলে কি তাই?
মূলত এ ছিলো সামপ্রদায়িক বাংলা ও বাঙালি নির্মানের অনিবার্য প্রক্রিয়া। যে সব মহারথীরা রবীন্দ্র বিরোধিতার জন্য মাঠে নেমেছিলেন তাদের ছান পোনাদের অনেকে এখন আবার সুযোগ বুঝে কবিগুরু বিরোধিতায় কসুর করে না। এবার তাদের ভাষা বা আক্রমনের ধারা ভিন্ন। তারা জানে নিষ্দ্িধ করা অসম্ভব। তাছাড়া এরা জানে আনন্দ বেদনা কষ্ট সুখে তাঁর গান তাঁর সৃষ্টিতেই আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে হয়। তাই এখন তাদের আক্রমণ বা টার্গেট রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ভূমিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কবির বিরোধিতার প্রমাণহীন সব যুক্তি তর্ক এখন এদের হাতিয়ার। মূল বিষয় একটাই যেন তেন প্রকারে রবীন্দ্রনাথকে অপমান। বলাবাহুল্য এদের অপকৌশলের ভরসা পাকিস্তান। পাক প্রীতি আর সামপ্রদায়িকতাই এখানে পুঁজি।
বলা উচিৎ স্মরণ করা উচিৎ সেসব বাঙালিদের যাঁরা সরকারের আক্রোশ আর পাকিদের হামলা মামলাকে তোয়াক্কা না করেই বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন কবির গান। ছায়ানট থেকে শুরু করে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি লড়াইয়ে ছিলেন তাঁদের সহযোগী হয়েছিল তখনকার রাজনীতি। আওয়ামী লীগেরও নানা রূপ আছে। তখনকার রূপটি বাঙালি হবার সংগ্রাম। আর সে আন্দোলনের রূপকার ও নেতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। তিনি তাঁর কথার বরখেলাপ করেন নি কখনো। দেশ স্বাধীন করে রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গানটিকে বেছে নেন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। তা নিয়েও কতো কথা। কতো ষড়যন্ত্র: এখনো সে অপকৌশল চলছে। মাঝখানে বিএনপি ও জামাত জোটের সরকার এমন এক আবহ তৈরি করে ফেলেছিল মনে হতো অচিরেই বদলে যাবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। শেখ হাসিনার শাসনকালে বর্তমানে তা আর সম্ভব না। তবে সময় সুযোগে থাবা বিস্তার করার দুর্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমাদের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের নিষিদ্ধকরণ ছিলো পাকিস্তান পতনের শুরু। আজকের বাংলাদেশে যারা নানা অজুহাতে তাঁর বিরোধিতা করেন তাদের কোন ধারণা নাই কতোটা গভীরে আছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ উপমহাদেশে দুটি দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা। সরাসরি না হলেও শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীত ও তাঁর অবদানে ভাস্বর। তাঁকে মূর্খ দালাল ও রাজাকারের দল ছাড়া সবাই ভালোবাসেন। নতুন যেসব বুদ্ধিজীবী লাইনে আছেন তাদের বলি পাকিস্তানের দিকে তাকান। পাকিস্তানের নামে দিল ব্যাকুল আর যারা ও পাকিস্তান বলতেই নাক সিটকান সবাই জেনে রাখুন সেখানকার নতুন প্রজন্ম বদলেছে। বদলে গেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে আর পরাজিতদের মনোভাব বুঝতে পাকিস্তান গিয়েছিলেন মুনতাসীর মামুন ও মহিউদ্দীন আহমেদ। তারা পৌঁছে গিয়েছিলেন আত্মসমর্পণকারী পাক সেনা প্রধান নিয়াজীর বাড়িতে। জেনারেল নিয়াজীর দুই কন্যা তাদের বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিল যেন ভারতকে বন্ধু মনে না করে। তারা এ উপদেশ দিতেও ভোলে নি দরকার হলে ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্ব করলেও ভারতের সাথে না। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, তিনি কন্যাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দেয়ালের ছবিতে যেখানে অজয় দেবগন কাজল আর শাহরুখের পোস্টার। একটুও বিচলিত না হয়ে কন্যারা বলেছিল সিনেমা গান বাজনার জন্য ভারত জায়েজ। এটাই পাকিস্তান ।
তারা বিরোধিতা করার বেলায়ও অন্ধ। আজকাল সে দেয়াল ভাঙ্গছে। নবীন প্রজন্ম আমাদের বাংলায় ক্রমাগত পিছু হটলে ও অন্য সবদেশে তারা অন্ধত্ব মুক্ত। আমি সিডনিতে দেখছি ভারত আর পাকিস্তানের ছাত্রদের গলায় গলায় ভাব। মনে রাখতে হবে তাদের ভাষা পোশাক দৈহিক গড়ন এক। আমরা খামোখাই একদলকে সমর্থন করে আরেকদল কে বিরোধিতা করি। কিন্তু এই ঘটনা এই সীমানা ডিঙানো মানুষটি বাঙালি। যিনি আমাদের আত্মার আত্মীয়।
রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে যদি ভারত পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তাঁর গানের মালা গলায় জড়িয়ে বন্ধু হতে পারে তবে তার চেয়ে ভালো আর কিছু ই হতে পারে না। মনে যাই থাক পাকিস্তানের টিভি সিরিয়ালে খাঁটি বাংলায় আমারো পরান যাহা চায় তুমি তাই মূলত বাংলার বাঙালির পাকিস্তান বিজয়। উড়ুক এই জয়পতাকা।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও কবি