দূরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৮ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

সব বিঘ্ন পেরিয়েও
আলোকশিখার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ যা হতে চেয়েছিল তা হয় নি। হবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের দেশ হয়ে উঠতে পারে নি। আমরা পারি নি অসামপ্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করতে। এ লেখা যখন লিখছি তখন চট্টগ্রামে জে এম সেনের সেই কাচারি বাড়ি যা শিশুবাগ ও বাংলা কলেজ নামে পরিচিত হয়েছিল সেটি পড়েছে ভূমি খোরের কবলে।
কতোশত অনাচার, খোদ জাতির জনকের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই দেশে এখন জীবন ঘাটে ঘাটে বিপদসংকুল। হত্যা মারামারি আইনের অপব্যবহার শাস্তি হীনতা ধর্ষণ সব চলছে। মানুষ বাঁচলে বাঁচে না বাঁচলে বাই বাই। এক শ্রেণীর মানুষজানে না কতো টাকা থাকলে তারপর শান্তিতে ঘুমানো যায়। আর একশ্রেণী নিতান্ত হতদরিদ্র। তারপরও দেশ চলেছে।
বাংলাদেশ মহামারীর সময় থেমে থাকে নি। দুনিয়ার বহুদেশ থমকে যাবার পর আবার গতি ফিরিয়ে আনতে সময় নিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। আমাদের মনে রাখতে হবে এটি পৃথিবীর জনবহুল ঘনবসতির দেশ। দীর্ঘকালের শাসন অপশাসন পরিকল্পনাহীনতায় এর নাজুক অবস্থা হলেও সে এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়াতে শিখে গেছে।
মানুষ এই দেশে সবসময় পরিশ্রমী। তাদের করে খেতে হয়। মিডিয়ায় আমরা যাদের খবর দেখি বা পড়ি তারা হাতে গোনা। একজন দাগী আসামী চোর ডাকাত বা লুটেরা এদেশের মুখচ্ছবি হতে পারে না। কাটতি রেটিং বা জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য নেগেটিভ বিষয়গুলোর ব্যাপক প্রচার ও মানুষের পছন্দ এক ধরনের মানসিক রোগ। সে রোগ ক্রম বর্ধমান বলেই আমরা পজিটিভ জিনিসগুলো এড়িয়ে যাই কিংবা চোখে পড়ে না। এতো ঘনবসতির দেশে কোভিডকে মোকাবেলা করা সহজ ছিলো না। বিশেষজ্ঞ নামধারী একদল সমালোচক ও সরকার বিরোধী মূলত স্বাধীনতা বিরোধী লোক ফতোয়া দিয়ে দিয়েছিল যে করোনায় লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাবে। কিন্তু তাদের সে দূরাশা বা অভিশাপ কাজে আসে নি। মাস্ক কেলেংকারী থেকে নিয়ম না মানার পরও বেশির ভাগ মানুষ সুস্থ আছেন। আর অল্প সময় নিয়ম মেনে চললেই তাঁরা সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তের আলো দেখতে পাবেন ।
উন্নয়ন আসলে কি এবং কেন এ বিষয়টি সরকারি দল ঠিকভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ দুটি। প্রথমত সাধারণ নেতা কর্মী ও সিনিয়রদের মাঝেও এ বিষয়ে জ্ঞান বা চর্চা কম। বাকী কারণ তাদের কথা আদৌ কেউ আমলে নেয় না। ফলে যেটুকু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন সেটাই কেবল মানুষ শোনে বা বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। আমাদের জানা মতে করোনার সময় পেঁয়াজ বা এ জাতীয় কয়েকটি খাদ্যের কৃত্রিম অভাব বা সংকট বাদ দিলে মানুষজন মোটামুটি খেয়েই বেঁচে আছেন। বলে রাখা উচিত আমরা দুনিয়ার সব দেশগুলোর সাথে তুলনায় যাবো না। সেটা হবে অবাস্তব। যেমন উন্নত দেশগুলো মানুষকে মাসের পর মাস বলতে গেলে বছর ধরে ভাতা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশে কোন সরকারের সে সাধ্য নাই। জনবহুল এই দেশকে বাঁচতে হলে যেসব বিকল্প পথে হাঁটতে হবে তা মোটামুটি অনুসরণ করা হয়েছে। না হলে চাকরি হারা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও গরীবেরা বাঁচতে পারতেন না।
ধন্যবাদ দিতে হবে কৃষি খাতকে। তারা যদি ব্যর্থ হতো বাংলাদেশে অভাব অনটনের বাইরে কিছুই থাকতো না। শস্য ভান্ডার উপচে পড়া আর চালের বাজার ওঠানামা করলেও আয়ত্তে থাকায় মানুষ এখনো বাঁচতে পারছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে মূল রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প নিয়ে। বাজার বন্ধ রপ্তানি বন্ধ সব মিলে মালিকেরা যা দেখালেন তা রীতিমতো হতাশার। হাজার হাজার কোটি টাকার আয়ে যারা আঙুল ফুলে কলাগাছ যারা প্রণোদনাভোগী তাঁরা একটি মাসও কাজহীন বেতন দিতে পারলো না। এটি পোশাক শিল্পের লজ্জা।
চলতি বছরের শুরুতে প্রকল্পটিতে প্রায় সাড়ে চার হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন। মহামারীর শুরুতে চীনাসহ বিদেশি শ্রমিকরা চলে যাওয়ার পরও মার্চের শুরুতে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক ছিলেন। তাদের নিয়েই সীমিত পরিসরে কাজ চলছিল। বছরের শেষে এসে পুরোদমে কাজ শুরু হয় প্রকল্পটির। দক্ষিণ জনপদের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল পদ্মার পাড়ে, তা পূর্ণ অবয়ব পায় গত ১০ ডিসেম্বর। সেতুর ৪১তম স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমান হয় সেদিন; তৈরি হয় রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগের পথ। ১০ মাস থেকে একবছরের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ হবে। এর মধ্যে সেতুতে ঢালাইয়ের কাজ, সড়কের জন্য প্রস্তুত করা, রেলের জন্য প্রস্তুত করার কাজ শেষ করা হবে।
সব ঠিক থাকলে ২০২২ সালের প্রথমভাগেই এ সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে বলে সরকার আশা করছে। এতো বড় অগ্রগতি আমরা জীবদ্দশায় দেখবো ভাবি নি।
উন্নয়নের অন্তরায় শুধু করোনা না রোহিঙ্গা সমস্যার মতো উটকো ঝামেলা আমাদের থমকে দিচ্ছে বারবার। এ লেখা যখন লিখছি তখন দেখলাম নয়টি দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও চীন রাশিয়া এখনো তাদের সমথর্ন দিচ্ছে। বিশ্বের রাজনীতিতে প্রভাবশালী এ দুই দেশকে বাদ দিয়ে আমরা কিছুই করতে পারবো না। উন্নয়ন ও জাতির স্বার্থ কূটনীতির নজর কড়া হওয়া দরকার। এদিকে মনোযোগ না দিলে উন্নয়নের গুড় খাবে ভিনদেশের ডেকে আনা সমস্যা।
তবু আমরা আশাবাদী। শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা মেধা ও নেতৃত্ব আর পরিশ্রমী কৃষক শ্রমিক কর্মজীবীদের জন্য এ বছরটি আরো চ্যালেঞ্জের। তারা চৌকোনা বাক্সে বা টেবিলে বসে লেকচার দেন না। ঠিক যেমন কঠিন সময় স্বাসহ্যকর্মী ডাক্তারদের। এঁরা ব্যর্থ হলে আমরা কিছুই করতে পারবো না। উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি আর মস্তানতন্ত্র বন্ধ হলে সুফল আরো তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব। রাজনীতি যদি কাজ করে এবং দলবাজীর পরিবর্তে দেশ ও মানুষের কল্যাণ ও অগ্রযাত্রাকে সামনে রাখে বাংলাদেশ এতো কিছুর পরও তার চূড়ান্ত পর্বে পা রাখতে পারবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারে না। জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২০৬ বছরে এমন হামলা দেখেনি যুক্তরাষ্ট্র
পরবর্তী নিবন্ধকল্লোল সংঘের সভা অনুষ্ঠিত