বাজেট ঘোষণা হলেই সবাই খুঁজতে থাকেন কিসের দাম বাড়বে আর কোনটার দাম কমবে। এ এক ফাঁকির শুভংকরের খেলা। ভালো করে চিন্তা করে দেখুন তো গত ৫০ বছরে কোন জিনিসের দাম বাজেটের পর এমন ভাবে কমেছে যে মানুষ আত্মহারা হয়ে বলতে পেরেছে, যাক বাবা এবার একটা কিছুর দাম এমন কমলো যা অকল্পনীয়। দাম বাড়ানোর কমানোর নিক্তি কোনো অর্থমন্ত্রী বা সরকারের হাতে থাকে না। ছিলো ও না কোনো কালে। আসলে বিশ্ববাজার মূল্য স্ফীতি মুদ্রার মান সহ নানা বিষয় এখানে জড়িত। আমরা অর্থনীতির কোনো কঠিন তথ্য বা থিওরী আলাপ করতে বসি নি। আমাদের টার্গেট গ্রুপ সাধারণ মানুষ এবং তাদের প্রত্যাশা।
‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায়’ প্রত্যাবর্তন শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন তিনি, যেখানে ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির সাড়ে পাঁচ শতাংশ।
প্রস্তাবিত এই বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে মেটানো হবে বলে বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে। এছাড়া আগামী অর্থ বছরে মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আসবে বলে বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে।
এমন কথা কি সাধারণ মানুষ বোঝেন? না তাদের আগ্রহ আছে এতে? সাধারণ মানুষের কাছে এখন দুটো খবর জনপ্রিয়। তারা জানে মুড়ির দাম কমেছে। চিনির দাম কমবে বলা হয়েছে। ভাত চিড়া মুড়ি এসব এক পদের খাবার। কিন্তু বাঙালির খিদে ভাতের খিদা। চালের দাম কমবে বললে যে প্রতিক্রিয়া হতো মুড়ির দাম অর্ধেক হলেও তা হবে না। চাল ডাল তেল এসবের বাইরে বাঙালি বাজেট দিয়ে কী করবে? বাজেটের সে দিকটা কি আমরা খতিয়ে দেখেছি? বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অনেকবার অসন্তোষ দেখা গেছে। আর সামপ্রতিক কয়েক মাসে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে খরচ সামলাতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষেরা। যদিও সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি গত পাঁচ বছর ধরে গড়ে সাড়ে ৫ শতাংশের কাছাকাছি আছে। নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য হিসেবে চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, চিনি এবং ব্রয়লার মুরগিকে সূচক ধরে গত ৫ বছরের গড় মূল্যের একটি হিসাব করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির গড় তথ্য বাজারে প্রধান খাদ্যপণ্যের দামের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বাজেটের দামী দামী কথায় ক্লান্ত মানুষের আসল চাহিদা এদিকে। কম্পিউটার বা ইলেকট্রনিক দ্রব্য নিয়ে যারা কথা বলেন তারা শতকরা কত জন? মানুষের যদি পেট খালি থাকে সে এসব দিয়ে কী করবে ? কী করবে গড় আয় বা প্রবৃদ্ধির কথা শুনে? বাজেট যাই বলুক মানুষ চায় পেট ভরে খেতে। মানুষের দরকার শান্তি। মানুষের ইচ্ছে উন্নয়ন আর জীবন চলুক হাত ধরাধরি করে। এসবের বাইরে বাজেট কি বলে না বলে তার প্রভাব কম। যদিও এ কাজটি দেশ ও সরকারের জন্য আবশ্যক আর গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দা কথায় এটা হলো সরকারের আয় ব্যয়ের হিসাব। এর দিকে তাকালেই বুঝবেন টাকা পাওয়া যাবে বা আয় হবে বা সহয়তা মিলবে এর ওপর নির্ভর করেই সাজানো হয়েছে। আয়তন আকার সম্ভাবনা সবই নির্ভরশীল যদির ওপর। এই যদি-ই কিন্তু সমস্যা। কারণ যদি টাকা পাওয়া যায়, যদি অনুদান মেলে যদি ট্যাক্স আসে যদি সব ঠিক থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যদির মালিকেরা কি বিনা বাক্যব্যয়ে টাকা দেবে? কোনোদিন তা দিয়েছে কেউ? সেখানেই যতো গণ্ডগোল। কারণ যে টাকা দেয় তার শর্ত মানতে হয়। শর্তগুলো সবসময় আর্থিক বা অর্থনৈতিক হবে এমনও কথা নেই। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশের বেলায় এরা মুরুব্বীর ভূমিকায় থাকে বলে রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দেয়। তখন বাজেটের স্বপ্ন নির্ভরশীল হয়ে পড়ে রাজনীতির ওপর। গণতন্ত্র নির্বাচন এসব প্রশ্নও তখন বড় হয়ে দাঁড়ায়।
সবচেয়ে বড় বিষয় আমাদের বাজেটে শিক্ষা খুব বেশী গুরুত্ব পায় না। কেন পায় না সেটা এখন আমরা সবাই বুঝি। বলতে গেলে লেখাপড়া বা ডিগ্রির বিষয় এখন আর কেউ পাত্তা দেয় না। বাজেটের হিসাবটা এমন এক অংকের যেখানে আপনি ঠাঁই পাবেন না। অথচ মাথা ঘামালেই বুঝবেন বরাদ্দের গরমিল কোথায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষা খাতে ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা মোট বাজেটের ১২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিদায়ী বছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। তা ছিল বাজেটের ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান থেকে বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাবকে গতানুগতিক বলেছেন শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা। গুণগত শিক্ষার জন্য বরাদ্দের হার আরও বাড়ানোর দাবি করেছেন তাঁরা।
শিক্ষায় বরাদ্দ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির ৬ ভাগে যেতে হবে। আমরা ৩ ভাগে আছি। তবে ২০০৬ সালে দেশের যে বাজেট ছিল এখন শিক্ষা বাজেটই তার চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষায় আমরা অনেক বিনিয়োগ করছি। আরও অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, বড় বড় মেগা প্রকল্প হচ্ছে, যেগুলো আমাদের যোগাযোগের জন্য, দেশের এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার। তেমনি পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষা। সেটিই হবে বড় মেগা প্রকল্প।’
কিন্তু কে শোনে কা’র কথা। বাজেটে যাই থাক বাস্তবে শিক্ষার বিকল্প নেই। অথচ সমপ্রতি এক জরিপে দুনিয়া সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও নেই আমাদের একটিও। অথচ ভারত পাকিস্তান দু দেশই আছে সে তালিকায়। পাকিস্তানের সমালোচনা মুখর আমাদের চোখের সামনে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় চলে এসেছে সেরা তালিকায়। বাজেট যদি পাশে না দাঁড়ায় তা হলে কিভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সামনে এগুবে ? এই কথাগুলো বলার দরকার হলেও আদপে কি বলা হয়?
বাজেট আসবে বাজেট যাবে। থাকবে দেশ থাকবে জনগণ। থাকবে মানুষের মন ও আত্মার ইচ্ছে। তাই খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের পাশাপাশি লেখাপড়া সহ কল্যাণমূলক কাজের জন্য বাজেটের খাত বাড়ুক সে সব খাতে বরাদ্দ বাড়ুক এই আমাদের চাওয়া। শেখ হাসিনার মতো সাহসী নেতার সময়কালে এমন হওয়াটাই উচিৎ। না হলে বাজেটের আলোচনা হবে চর্বিত চর্বন।
লেখক : সিডনি প্রবাসী প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, শিশুসাহিত্যিক