(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বেশ ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। সাত সকালে আর্লি ব্রেকফাস্টের নামে হোটেল থেকে যা দিয়েছে তা হয়তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু নাস্তার পরও যে আমরা নাস্তা করি, একটু বেলা চড়লে চা সিঙ্গারা খাই তা চীনে জুটেনি। চীনের রাজধানী বেইজিং শহরের ফরবিডেন সিটি ও জিংশান পার্কে ব্যাপক ঘুরাঘুরি হলেও সকাল এবং দুপুরের মাঝামাঝিতে চা সিঙ্গারা টাইপের কোন খাবার খেতে পারিনি। হাঁটাহাঁটি হয়েছে প্রচুর। এতে করে স্বাভাবিক সময়ে যেভাবে ক্ষুধা তাড়া করে এখন যেন তার থেকে ঢের বেশি দাবড়াচ্ছে। ইচ্ছে করছিল কয়েকটি সিঙ্গারা এবং কফি খেয়ে ক্ষুধার রাজ্যে আয়েশের প্রলেপ দিতে। কিন্তু সেই সুযোগ নেই। বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান দেখেছি, বিভিন্ন ধরনের খাবারের বিকিকিনিও চোখে পড়েছে, কিন্তু তাদের খাবার আদৌ খাওয়া যাবে কিনা, সেখানে কি বিক্রি হচ্ছে, বার্গারের ভিতরে কিসের মাংস দিয়ে রেখেছে, কিংবা পাউরুটির মতো নিরীহ খাবারেও মাংসের কুচি মেশানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। ভাষাগত সমস্যার কারণে ব্যাপারটি আরো বেশি কঠিন হয়ে উঠেছে। আমাদের গাইড মিজ পিনং নিজের মতো করে সবকিছু দেখাচ্ছেন, ঘুরাচ্ছেন। উনার হ্যাভারশেকের ভিতরে পানির বোতল রয়েছে, রয়েছে গ্রিন টি’র ফ্লাঙ্ক। উনি ওখান থেকে মাঝেমধ্যে কি কি সব বের করে খাচ্ছেন, চুমুক দিচ্ছেন। কিন্তু দলের অন্য কারো খাওয়া না খাওয়া নিয়ে তিনি কিছু ভাবছেন কিনা কে জানে! চীনারা এত বেশি চা খায় যে, চোখে পড়ে। চা কফির প্রতি আমার দুর্বলতা বহু বছরের। দুনিয়ায় আর কোন কিছুর নেশা না থাকলেও সময়মতো চা কফি না পেলে আমার সবকিছু অসহ্য লাগে। এখানেও তাই ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের গাইড পিনং যতবারই তার গ্রিন টি’র পটে আদুরে চুমুক দিচ্ছেন, ততবারই আমার ভিতরটা নড়ে চড়ে উঠছে। কিন্তু কিছুই করার নেই, অসহায়ভাবে সময় পার করছিলাম।
মিজ পিনং যেনো আমার মনের কথাটি বুঝতে পারলেন। হ্যান্ডমাইক নিয়ে বেশ আনন্দচিত্তে বললেন, অনেক কিছু দেখলাম আমরা। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলাম। এখন আমরা লাঞ্চ করতে যাবো। পিনং বললেন, সবাই বাসে চড়ে বসুন, আমরা এখন চমৎকার একটি রেস্টুরেন্টে যাবো। সেখানে ব্যুফে লাঞ্চ। আপনাদের যার যেভাবে ইচ্ছে খাওয়া দাওয়া করবেন। বিল আমরাই পেমেন্ট করবো। তবে ব্যুফে যেসব ডিজ সার্ভ করা থাকবে তার বাইরের কিছু অর্ডার করতে গেলে নিজেদেরকে পেমেন্ট করতে হবে। তিনি আশ্বস্ত করলেন যে, রেস্টুরেন্টটিতে ব্যুফের ম্যানুতে এত বেশি খাবার থাকে যে নতুন করে কিছু অর্ডার করার দরকারই পড়ে না।
আমি ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। বনেদি রেস্তোরাঁয় যদি অথেনটিক চাইনিজ ফুড দিয়ে খাবার সাজিয়ে রাখে তাহলে আমার কি হবে! সব খাবার তো খাওয়া যাবে না! কোনটি খাবো, কোনটি খাবো না তাই বা বুঝবো কি করে! বাংলাতো দূরের কথা, ইংরেজীরও যে প্রচলন নেই পোড়ার দেশে!! মিজ পিনং এর কানের কাছে গিয়ে কথাটি খুব নিচু স্বরে বললাম। তিনি হাসলেন, দারুণ মন ছুঁয়ে দেয়া হাসি। বললেন, ‘ডোন্ট ওরি, প্রচুর খাবার থাকবে। আপনার খাবারের অভাব হবে না।’ চ্যাপ্টা নাকের সুন্দরীর কথা বলার ধরনে মনে হলো আমি কি বলতে চেয়েছি তা তাকে বুঝাতে পারিনি অথবা তিনি বুঝেন নি। তিনি হয়তো মনে করেছেন, এত মোটা মানুষের প্রচুর খাবারের দরকার, আর আমি তাকে খাবারের অভাবের কথা বলেছি! আসলে যে আমি শুকুর, শাপ, ব্যাঙ, শামুক–ঝিনুকের কথা বলতে চেয়েছি তা তিনি খেয়াল করেননি। আমি আস্তে করে কথাটি আবার বললাম। আবারো তিনি হাসলেন। অতপর বেশ সুন্দর করে বললেন, ‘ইউ ক্যান ইট ভেজিটেবল, ফিশ, এগ, ফ্রুটস!’ আমি যেনো কিছুটা লজ্জা পেলাম। মিজ পিনং আসলেই একজন পাকা ট্যুরিস্ট গাইড। বিশ্বের সব ধরনের ট্যুরিস্ট হ্যান্ডলিং করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার ঝুড়ি! অতএব আমি নিশ্চিত হলাম যে, চীনা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চে আমার খাবারের অভাব হবে না।
বাস চলছিল। বেইজিং শহরের এই রাস্তা ও রাস্তা ধরে ছুটছে আমাদের ট্যুরিস্ট বাস। বেশ কয়েকটি সিগন্যাল পার হলাম, পার হলাম অনেক পথ। ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে উঠতে গাড়ির গতি কমে যাওয়া এবং ইন্ডিকেটরের শব্দে বুঝতে পারলাম যে, গন্তব্যে এসে গেছি। এবার নিশ্চয় আর খাবার কিংবা চা কফির অভাব হবে না।
গাছগাছালী ঘেরা চমৎকার একটি বাংলো টাইপের বাড়িতে এসে থামলো আমাদের বাস। ছায়া ঘেরা পাখী ডাকা বলতে যেমনটি বুঝায় ঠিক তেমনি একটি ছায়া সুশীতল জায়গা। চীনা স্থাপত্যের এক তলা ভবন, অনেকটা টিনের ঘরের আদল। রেস্টুরেন্টটি বেশ বড়, বেশ বড় মানে বিশাল। বড় বড় গাছের ছায়ায় চমৎকার করে ঘরটি তৈরি করা। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, আগে ঘর তৈরি করা হয়েছে, নাকি আগে গাছের বাগান বানানো হয়েছে! কী যে সুন্দর এবং নান্দনিক আয়োজন চারদিকে! রেস্টুরেন্টের ঘরের বাইরেও চমৎকার সব বেঞ্চ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বসেও আড্ডা দেয়া কিংবা খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। পিনং আমাদেরকে বাইরে না বসিয়ে টিনের ঘরের মতো ঘরটির ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভিতরে ঢুকে চক্ষু কপালে উঠার উপক্রম। রেস্টুরেন্টে লোকে গিজগিজ করছে। বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ ও শিশু কিশোর ব্যস্ত টেবিলে টেবিলে। ব্যস্ত হোটেলের বয় বেয়ারার দল। সাদা কালো টাইপের ইউনিফর্ম পরিহিত বিভিন্ন বয়সের বয় বেয়ারাদের ছুটাছুটি দেখে বুঝা যাচ্ছিল যে, কি সাংঘাতিক আয়োজন সেখানে। ব্যুফে খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ছোট তোয়ালে, টিস্যু, প্লেট–বাটি, চামুচ সবই সাজিয়ে রাখা। কয়েকশ’ টেবিলে অসংখ্য মানুষ খাচ্ছেন, কেউবা খাবার নিচ্ছেন। আমার মনে হলো বেইজিং শহরে যত ট্যুরিস্ট আজকে ঘুরতে এসেছেন তাদের সবাইকে এখানে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে আসা হয়েছে।
আমাদের গাইড সম্ভবত আগেভাগে ফোন করে টেবিল রাখতে বলেছিলেন। অথবা তিনি প্রতিদিনই এই সময়ে এখানে আসেন বলে তার জন্য আলাদা করে টেবিল রাখা হয়েছে। তাকে বেশ খাতির করা হচ্ছিল। রেস্টুরেন্টের কর্মকর্তা টাইপের একজন নারী এসে আমাদের গ্রুপকে একপাশে নিয়ে গেলেন। আমাদের তিনটি টেবিল দেখিয়ে বসতে বলা হলো। গোলাকৃতির বড় বড় টেবিলে আমরা ১২ জন করে বসলাম। মিজ পিনং বললেন, আপনারা ফ্রেশ হয়ে খাবার নিয়ে এখানে বসে খাবেন। নিজেদের মতো করে তুলে নেবেন। কেউ সার্ভ করবে না, ব্যুফে।
আমি অসহায়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি কি বুঝলেন কি জানি। হাসলেন। বললেন আপনি আমার সাথে আসুন। আমি যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলাম!
অসংখ্য ডিজ, থরে থরে সাজানো রকমারি খাবার। কত রকমের খাবার যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তার হিসেব কষা কঠিন। আমাদের গাইড পিনং আমাকে একেবারে একপাশে নিয়ে গিয়ে কয়েকটি ডিজ দেখিয়ে বললেন, এগুলো সব সী ফুড। আপনি অনায়াসে খেতে পারবেন। অন্যদিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, ওখানে সব ফ্রুটস, নিশ্চয় আপনার সমস্যা হবে না। আমি অন্তর থেকে তাকে ধন্যবাদ দিলাম।
সী ফুডের সারিতে চিংড়ী মাছের কয়েকটি পদ দেখলাম, রূপচান্দা ফ্রাই থেকে শুরু করে মাছের বেশ কয়েক পদের খাবার দেখা গেলো। আমি সাদা ভাতের সাথে রূপচান্দা ফ্রাই, চিংড়ী ফ্রাই এবং কোরাল জাতীয় মাছের একটি খাবার নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলাম। সবাই সবার মতো করে খাচ্ছেন। হালকা গল্প করছেন। খাবারের মান নিয়েও কথা বলছেন। চীনা স্বাদের রান্না, আমার ভালো লাগছিল না। তবে বেশ ঝাল একটি সস টেবিলে দেয়া ছিল। সেটি মাছের উপর ছিটিয়ে আমি স্বাদে ভিন্নতা আনার চেষ্টা করছিলাম।
টেবিলের সবাই স্যুপ খাচ্ছিলেন। খাবারটি নিয়ে তাদের বেশ সন্তুষ্টও দেখলাম। আড়চোখে দেখলাম যে স্যুপের কালারটিও দারুণ। কিন্তু এটি কিসের স্যুপ তা জানার সাহস করলাম না। শুনেছি অজগরের স্যুপের প্রতি চীনাদের দারুণ আগ্রহ!! কুমিরের স্যুপ নিয়েও নাকি তাদের মাতামাতি আছে!
যাক, মাছে ভাতে বাঙালি আমি। সুন্দর করে বললে বলতে হয় ‘ভেতো বাঙালি’। মাছের তৈরি প্রচুর খাবার এবং সাদা ভাত থাকায় আমার অসুবিধা হচ্ছিল না। বেশ জমিয়ে লাঞ্চ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ আমার খেয়াল হলো যে, আমার টেবিলে ১২ জনের সবাই বিদেশী। এরমধ্যে তাইওয়ানের দুজন চীনা সংস্কৃতির হলেও বাকি সবাই আলাদা। আমি ছাড়াও টেবিলটিতে ভারতীয়, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান ছিলেন। জোড়ায় জোড়ায় বেড়াতে এসেছেন তারা। শুধু আমি একা, ইউরোপের একটি কাপলের সাথে তাদের বছর দশেক বয়সী একটি সন্তান রয়েছে। হানিমুন করতে আসা এক নবদম্পতি সারাক্ষণই কলকল করছিলেন!
আন্তর্জাতিক টেবিলটিতে আমরা যে যার খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার খেলাম। পরে কফি খেলাম সকলে। খাবারের সময় টুকটাক কথাবার্তা হলেও স্বদেশীরা যেভাবে জমিয়ে আড্ডা দিই সেভাবে হলো না। ভাষাগত সমস্যা কিংবা পরিচয়ের অভাব পরিবেশটিকে অনেকটা ভারি করে রাখলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।