(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চারদিকে জ্বলে উঠতে শুরু করে রকমারি আলো। স্ট্রিট লাইটগুলোও জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। আলো ছড়াতে শুরু করেছে ফ্লাইওভারের লাইটগুলো। বিভিন্ন ভবনের পুরো দেয়াল জুড়ে টিভির পর্দার মতো বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হচ্ছিল। সেগুলোর আলোর তীব্রতা বেশ চোখে লাগছিল। চারদিকে আলো আর আলো, আলোকোজ্জ্বল গুয়াংজু! কিন্তু শহরের আলো নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। আলোর সৌন্দর্যও আমাকে মুগ্ধ করছিল না। আমার যাবতীয় আগ্রহ একটি পবিত্র স্থানকে নিয়ে। আমি খুব করে চাচ্ছিলাম মাগরিবের নামাজ শুরু হওয়ার আগে মসজিদটিতে পৌঁছাতে। কিন্তু সেটিই শেষতক হবে কিনা তা কেবল সময়ই বলে দেবে।
গাড়ির স্টিয়ারিং কিংবা স্কেলেটর কোনটিই আমার হাতে নেই। এতে করে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছারও কোন দাম নেই। আমি ইচ্ছে করলেও কোন গাড়িকে পেছনে ফেলে সামনে যেতে পারছিলাম না। পারছিলাম না ওভারটেক করতে। আমি ইচ্ছে করলেও ফাঁকফোকর ধরে সামনে এগুতে পারছিলাম না। গাড়ির স্পিডমিটারের কাটা ৬০ এর ঘর থেকে ৮০তে নিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগই আমার ছিল না। অতএব অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কিংবা আমার বন্ধু ইউছুপ আলী ভাইর আর কিছু করার ছিল না।
আমরা যাচ্ছি মহান সাহাবি হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর মাজার জেয়ারত করতে। গুয়াংজু শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর মাজার জেয়ারত করবো। আগেই বলেছি , হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং ঘনিষ্ট সাহাবি ছিলেন হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)। ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.) আত্মীয়ও। পৃথিবীতে ১৭তম মুসলিম হিসেবে ইসলামের প্রচার এবং প্রসারে এই মহান সাহাবীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়। পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় যে ১০জন মানুষ জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ পেয়েছিলেন হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) তাঁদের মধ্যে একজন। গাড়ি থেকে নামার সময় মসজিদের আজান কানে এলো। মোয়াজ্জিনের আজান প্রায় শেষ হতে চলেছে। নামাজ শুরু হতে আর খুব বেশি সময় নেই। তবে মনে মনে আল্লাহর দরবারে শোকরানা আদায় করলাম যে, নামাজ শুরুর আগে অন্তত মসজিদে পৌঁছাতে পেরেছি। অচিন শহরের অচিন রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ এবং রকমারি গাড়ির যে কিলবিল ব্যস্ততা দেখেছি তাতে সময়মতো মসজিদে পৌঁছা নিয়ে সংশয়ে ভুগছিলাম। আমরা বাসা থেকে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছি, তাই ওজু করার জন্য সময় ব্যয় করতে হলো না। দ্রুত মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম।
বেশ সুশীতল, ছায়া ঢাকা পাখী ডাকা একটি জায়গায় হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর মসজিদ। মসজিদের অনতিদূরেই মাজার। চারদিকে ক্ষয়ে যাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। দেয়াল ক্ষয়ে যাচ্ছে, রঙ চটে গেছে, পলেস্তার খসে পড়েছে। তবে এলাকায় প্রচুর গাছগাছালী, একেবারে জংলার মতো। বড় বড় গাছগুলো নুয়ে আবার মাটি স্পষ্ট করতে চাচ্ছে। যেন পবিত্র এই স্থানটিতে গাছও সেজদারত। অন্যরকমের একটি স্নিগ্ধতা চারদিকে, রয়েছে একটি পবিত্র আবহ। সাজানো গোছানো একটি বাগানের ভিতরে বেশ সুন্দর পথ চলার রাস্তা। এরই মাঝে গড়ে তোলা চমৎকার মসজিদটিতে চলে সৃষ্টিকর্তার আরাধনা! প্রথম দর্শনেই ভালো লাগার অন্যরকমের এক তৃপ্তি আমার মন ভরিয়ে দিল।
চীনের গুয়াংজুর হুয়াইশেং নামের এই মসজিদটি বহু পুরানো। চীনে ইসলাম প্রচারের শুরুর দিকের মসজিদ এটি। পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে ইসলামের যাত্রা শুরু হয় প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে। এই মসজিদ ওই সময়কার। ধারণা করা হয় যে, মসজিদ মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর স্মরণে গড়ে তোলা হয়েছিল। তাই নামকরণ করা হয়েছিল হুয়াইশেং মসজিদ। যেটির বাংলা জ্ঞানী লোকের স্মরণে মসজিদ। গুয়াংজুতে আরো কয়েকটি মসজিদ রয়েছে, তবে হুয়াইশেংই শহরের কেন্দ্রীয় বা প্রধান মসজিদ। চীনের খ্যাতনামা মসজিদগুলোর মধ্যেও হুয়াইশেং মসজিদ অন্যতম।
ঐতিহাসিকেরা নিশ্চিত যে, মসজিদটি সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ৬২৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রায় ১৪শ’ বছর আগেকার মসজিদটি বিভিন্ন সময় সংস্কার হয়েছে, মেরামত হয়েছে, পুনর্নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু চীনা নির্মাণ শৈলীতে হাত দেয়া হয়নি। মসজিদটির পরতে পরতে চীনা স্থাপত্য ও নির্মাণ শৈলীর পরশ অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।
মসজিদে প্রবেশ করেই আমার শরীর মন কেমন যেন করে উঠলো। আহা, পুরানো মসজিদ, কত জনের কত সেজদা রয়েছে এই মসজিদে! কত জনের রয়েছে কত নিঃশ্বাস, কত আকুতি বুকে নিয়ে এই মসজিদ টিকে রয়েছে!!
মুল মসজিদটি টিনের চৌচালা ঘরের মতো। আশে পাশে আরো কয়েকটি ঘর রয়েছে। সবমিলিয়ে বেশ বড় মসজিদ, ছিমছাম। বহু মানুষ একই সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে পারেন এই মসজিদে। বারান্দা, উঠোনসহ আশেপাশের খোলা চত্বর মিলে কয়েক হাজার মানুষের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। শুক্রবারে জুমার নামাজে প্রচুর জনসমাগম হয়। দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসেন। এরমধ্যে পর্যটক যেমন থাকেন, তেমনি চীনের স্থানীয় কিছু বাসিন্দাও রয়েছেন। আমরা নামাজ আদায় করলাম। ইমাম সাহেব বেশ সুললিত কণ্ঠে কোরান তেলোয়াতের মাধ্যমে আমাদের নামাজ পড়ালেন। তিনি চীনা মুসলিম, গুয়াংজুর স্থানীয় বাসিন্দা বলেও জানতে পারলাম। ছোটখাটো শরীর, দাঁড়ির সংখ্যা একেবারে কম। মঙ্গোলিয় চেহারার ইমাম সাহেব ওই কয়েকটি দাঁড়িই বেশ যত্ন করে রেখেছেন। তাঁর চেহারার মধ্যে অন্যরকমের একটি গাম্ভীর্ষ আছে, শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।
নামাজ শেষে আমরা বের হয়ে আসলাম। মুসল্লীদের অনেকেই চলে যাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) এর মাজার জেয়ারত করতে যাচ্ছেন। আমরা মাজার জেয়ারত করতে রওয়ানা হলাম। মসজিদের অনতিদূরেই মাজার। একেবারে পাশেই, তবে ছোট্ট একটি গেট পার হয়ে মাজার কম্পাউন্ডে প্রবেশ করতে হয়। আমরা ওই গেট পার হয়ে মাজারে প্রবেশ করলাম। দুর্বল বৈদ্যুতিক বাতির পাশাপাশি আগরবাতি এবং মোমের আলোয় ভরে ছিল মাজারগৃহ। অনেকগুলো গাছের ছায়ায় মাজার ঘর। ধারে কাছেও বহু গাছ। একেবারে ভিন্ন রকমের আবহ চারদিকে। অন্যরকমের একটি ঘ্রাণ মৌ মৌ করছিল চারদিক। মাজারের ছোট্ট ঘরটিতেও বেশ কয়েকজন মানুষ বসে আছেন। কেউ কেউ কোরান পড়ছেন, নিজেদের মতো করে দোয়া দুরুদ পড়ছেন, কেউবা তসবিহ গুনে জিকির করছেন। কেউ বসে আছেন, কেউবা দাঁড়িয়ে। আমি এবং ইউছুপ আলী ভাই একপাশে দাঁড়ালাম, নিজেদের মতো করে দোয়া কালাম পড়ে জেয়ারত সম্পন্ন করলাম।
ফেরার সময় বেশ কিছু পথ পায়ে হাঁটতে হলো আমাদের। মসজিদ অঙ্গন থেকে বের হয়ে আসার পর সাধারণ ব্যস্ত সড়ক। শত শত গাড়ি চলছে সেখানে। গিজগিজ করছে মানুষ। নানা ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে। বহু অভাবী মানুষও দেখা গেল। আহা, পৃথিবীর দেশে দেশে অভাবী মানুষগুলোর চেহারা বুঝি একই! গাড়িতে চড়ে ঘরে ফিরছিলাম। কোন শপিং মলে ঘুরবো কিনা জানতে চাইলেন ইউছুপ আলী ভাই। বললেন, রাত হয়ে গেছে। এখন আর তেমন কিছু করতে পারবেন না। শপিং মলে ঘুরতে পারেন। রিভার ক্রুজ করতে পারেন। পার্ল রিভারে জাহাজ ভ্রমণ। তবে এত হুড়োহুড়ি করে সেটা করা ঠিক হবে না বলে জানিয়ে ইউছুপ ভাই বললেন, কাল পরশু সময় করে করবেন। পার্ল রিভার উদযাপনে সময় লাগে! বাসায় ফিরে আসলাম। শাহীন ভাবী অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। ঘরে ঢুকে সোফায় বসার আগে ইউছুপ আলী ভাই চা বললেন, চা খাবো, বাইরে আমরা কিছু খাইনি। আমি হাসলাম। হাসলেন, শাহীন ভাবী। বাইরে কিছু খেলে কি চা খেতে অসুবিধা আছে? শাহীন ভাবী চীনা ভাষায় কাজের মহিলাটিকে কি যেন বললেন। একটু পরই দেখি ট্রেতে ধুমায়িত চা, সাথে রকমারি নাস্তার বিরাট এক পসরা।
আমাদের গল্প চলছিল। বন্ধুত্বের গল্প, বন্ধুদের গল্প। চীনের গল্প, হংকং এর গল্প, চট্টগ্রামের গল্প। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আমাদের গল্পগুলোতে ভর করে আমাদের সময় যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছিল। মাঝে মধ্যে গল্পে সামিল হচ্ছিলেন শাহীন ভাবী। রকমারি খাওয়া দাওয়ার যোগানের পাশাপাশি গল্পের মসল্লায়ও তিনি বুলাচ্ছিলেন আদুরে পরশ। সুখী সুখী এক আবহের মাঝে রাতের ডালপালার বিস্তার ঘটছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।