(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘোর লাগা চোখে চারদিকে তাকাচ্ছিলাম। বিস্ময়ে চোখের পাতা বন্ধ করতে পারছিলাম না। কী অসাধারণ এক স্থাপনা এই লালকেল্লা! ইট পাথরের কী নান্দনিক সংমিশ্রণ! অযান্ত্রিক যুগে কি করে এমন নান্দনিক একটি স্থাপনা নির্মিত হলো কে জানে! আগ্রা থেকে রাজধানী শাহজাহানবাদে (বর্তমান পুরান দিল্লী) নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে এই সুরম্য প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল। রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছিল এখানে। এই প্রাসাদে বসেই সম্রাট শাহজাহান বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করতেন। পরবর্তী সম্রাটেরা এখানেই তাদের জীবন সাজিয়েছিলেন। এখানেই সম্রাটদের জীবনের জয়গানের জয়যাত্রা প্রতিদিনই রচিত হতো। কিন্তু এই প্রাসাদে যে একদিন এমন অতি সাধারণ মানুষ কিলবিল করবে তা কি সম্রাটদের কারো ধারণাতেই ছিল! থাকার কথা নয়। অথচ সেই কুলীন লালকেল্লায় আজ হাজার হাজার দেশী বিদেশী পর্যটক কিলবিল করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘুরেন অন্দরমহল, বাহির মহল, রং মহল থেকে শুরু করে গোছলখানা পর্যন্ত! লালকেল্লায় আমার মতো অতি সাধারণ একজন মানুষের এই ঘোরাঘুরি বিস্ময়কর একটি ব্যাপার বলেও মনে হচ্ছিল! অথচ এই প্রাসাদকে সুরক্ষিত করতে কি না করা হয়েছিল। কি না করা হতো! বিশাল দুর্গের চারদিকে সুগভীর পরিখা। নদীর মতো। সেই পরিখাতে বাস করতো অগুনতি জ্যান্ত কুমির। ফলে পরিখা সাঁতরে পার হয়ে দুর্গে অনধিকার প্রবেশ ছিল অবিশ্বাস্য। এরপরও দুর্গের সুউচ্চ দেয়াল জুড়ে থাকতো তেল। কেউ যদি কোন বিশেষ পন্থায় কুমিরের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরিখা পার হয়ে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করতো তাহলে গড়িয়ে পড়তো পরিখায়। তখন কুমিরের খাবার হতো অবলীলায়। দুর্গে অনধিকার প্রবেশের কথা কল্পনা করতেও শরীর নাকি হিম হয়ে যেতো। কথাটি বললেন, আমাদের গাইড। দুর্গের গেট পার হয়ে একটু এগুতেই একজন গাইডের খপ্পরে পড়েছিলাম। সচরাচর ম্যাপ এবং স্যুভেনির নিয়ে এসব স্থাপনা অনায়াসে ঘোরা যায়। প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তও পাওয়া যায়। নিজেদের মতো করে রয়ে সয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেই হয়। কিন্তু কাশির পান্ডার মতো এসব ট্যুরিস্ট স্পটে কিছু গাইড থাকেন। এদের থেকেও নিস্তার পাওয়া বেশ কঠিন। তারা নানাভাবে মুগ্ধ করে। কথায় যে ছিড়ে ভিজে তা এদের দেখলে আর অবিশ্বাস করার জো থাকে না। আমিও বাধ্য হয়ে গাইড সাহেবকে সাথে নিলাম। তিনি ইংরেজী আর হিন্দিভাষী। ‘ওয়েলকাম’ জানিয়ে তিনি শুরু করলেন।
গাইড আমাদেরকে নানা কিছু দেখাচ্ছিলেন। প্রতিটি স্থাপনার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিচ্ছিলেন। নানা বিষয়ে আমরা নিজেদের মতো গল্পও করছিলাম। গাইড আমাদেরকে দেওয়ান-ই-আম দেখালেন। দারুণ একটি জায়গা। উন্মুক্ত চত্বর, মুক্তাঙ্গন। খোলা চত্বরের একপাশে নান্দনিক একটি স্থাপনা। বাড়ির মতো। লালপাথরের অনেকগুলো পিলারের উপর একটি ছাদ। ঘরটির তিনদিক উন্মুক্ত। পেছনের দিকে দেয়াল, কয়েকটি কক্ষ। ছাদের নিচে বসে ডানে বামে এবং সামনে সবই উন্মুক্তভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। দিওয়ান-ই- আমে বসে সম্রাট গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। রাজকার্যের বিভিন্ন বিষয় এখান থেকে পরিচালিত হতো। রাজ্যের উজিরসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনেকেই সম্রাটের সাথে এখানে বসতেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। একটি নির্দিষ্ট সময় সম্রাটের দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দিতেন। এই ভবনটির দেয়াল, পিলার, ছাদ এবং মেঝেতে নানা ধরনের পাথর শোভা পেত। হীরা চুন্নি পান্নায় সুসজ্জিত ছিল এই স্থানটি। সবকিছু লুটপাট হয়ে গেছে। নিয়ে যাওয়া হয়েছে সম্রাটের সিংহাসন। শুধু সিংহাসন যেখানে ছিল সেই স্থানটি আজো চিহ্নিত রয়েছে। শ্বেত পাথরের কারুকাজ করা দারুন একটি জায়গা। যেখানে সম্রাটেরা বসে রাজকার্য পরিচালনা করতেন।
গাইড আমাদেরকে দিওয়ান-ই খাস দেখাতে নিয়ে এলেন। এটির স্তম্ভগুলোও বেশ সুন্দর। দিওয়ান-ই-খাস যুমনা নদীর একেবারে পাড়ে। দারুন একটি লোকেশন। এখানেও চমৎকার সব পিলারের উপর নান্দনিক শোভার একটি ছাদ। পিলারের উপরের অংশেও বেশ কাজ রয়েছে। দারুন সব কারুকাজ। এসব পিলার নাকি স্বর্ণের নানা কারুকাজে আচ্ছাদিত ছিল। কিন্তু পিলার থেকে সেই সব খুলে নেয়া হয়েছে বহু বছর আগে। যথারীতি লুটপাট হয়ে গেছে।
সম্রাটেরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ও পারিষদবর্গ নিয়ে দিওয়ানে খাসে বসতেন। শাহজাদা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখানেই সম্রাটের সাথে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলতেন। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিনির্ধারণী বৈঠকগুলো এখানেই হতো। অতি গোপনীয় সভাও। রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে জমকালো এলাকা ছিল দেওয়ান ই খাস। খাসকামরার মতো খাস। শ্বেতপাথরের তৈরি প্রাসাদের দরবার কক্ষটির সামনে মূল্যবান পাথরে সোনার পাত দিয়ে লেখা ছিল: ‘আগার ফেরদৌস বর রুয়ে জামিনাস্ত, হামিনাস্ত ও হামিনাস্ত ও হামিনাস্ত। – ‘এ ধরার বুকে যদি থাকে বেহেশতের বাগান, এই সেই স্থান, এই সেই স্থান, এই সেই স্থান।’ ইতিহাসের অতি বিখ্যাত রাজসিংহাসন ‘তখত-ই-তায়ুস’ বা ময়ূর সিংহাসনও ছিল এখানে। ওই ময়ূর সিংহাসনের শীর্ষে লাগানো ছিল বিখ্যাত কোহিনুর হীরা। যেটি এখন টাওয়ার অব লন্ডনে শোভা পাচ্ছে। এই লালকেল্লা থেকেই কোহিনুর হীরা নানা হাত ঘুরে লন্ডনে ঠাঁই পেয়েছে ব্রিটিশদের জৌলুশ বাড়িয়েছে।
দিওয়ান-ই-খাসের পাশেই ছিল সম্রাটের হেরেম। যেখানে সম্রাটের রানী উপরানী বা দাসীরা থাকতেন। সম্রাট প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন সময় হেরেমে গিয়ে আহার করতেন। নাস্তা করতেন। সময় কাটাতেন। হেরেম মহল দেখার সময় আমি স্ত্রীর হাতে ছোট্ট একটি চাপ দিলাম। সম্রাটদের ভাগ্য যে কী সুপ্রসন্ন ছিল! কত আরাম আয়েশেই না তারা জীবন কাটিয়ে গেছেন!
দেওয়ান ই খাসের একপ্রান্তেই যমুনামুখী ৮ কোনাবিশিষ্ট একটি ঝুল বারান্দা। দারুণ সুন্দর। এটির নাম মুছামা বুরজ। এখানে বসেই প্রতিদিন সকালে শাহজাহান ঝরোখা দর্শন দিতেন। মোগল সম্রাটদের এই ঝরোখা দর্শন দান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাইড বারবার ঝরোখা দর্শন ঝরোকা দর্শন বলে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সহজ করে বলতে বললাম। তিনি হাসলেন। বললেন, ঝোরখা বা ঝরকা মানে হচ্ছে বারান্দা। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সম্রাট প্রতিদিন সকালে সাধারণ প্রজাদের দেখা দিতেন। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটাতেন। এখানে বসেই সম্রাট হাতি ঘোড়াসহ যুদ্ধের পশু পরীক্ষা করতেন, দেখতেন।
গাইড জানালেন, মোঘল সম্রাট আকবরই প্রথম ঝরোখা দর্শন চালু করেন। অবশ্য তাঁর পিতা হুমায়ুনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের অভিযোগ শুনতেন। সম্রাট আকবরের পর সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং সম্রাট শাহজাহান ঝরোখা দর্শন চালু রাখেন। প্রতিদিনই সূর্যোদয়ের সময় সম্রাট বারান্দায় এসে বসতেন এবং সাধারণ দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দিতেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় ঝরোখা দর্শন বন্ধ করে দেয়া হয়। সম্রাট শাহজাহানের এই আট কোনের বারান্দায় সর্বশেষ ঝরোখা দর্শন হয়েছিল ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর। তীব্র শীতের মাঝে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ রানীকে নিয়ে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঝরোখা দর্শন দেন। ওই ঝরোখা দর্শনে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ লালকেল্লার ভিতরে অবস্থান নিয়েছিল।
গাইড আমাদেরকে সম্রাটের শোয়ার ঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন। দিওয়ান-ই-আমের পিছনের দিকের একটি জায়গা। গাইড বললেন, এটিই রাণী মহল, ডানদিকেই সম্রাটের বেডরুম। সম্রাটের বেডরুমের নাম ‘খোয়াব্গা’। বাহ, নামটি বেশ সুন্দরতো! খোয়াব মানে স্বপ্ন। কক্ষটিও দারুণ। মোগল সম্রাটেরা কেমন ঘরে ঘুমাতেন তার কোন জৌলুশ আজ আর অবশিষ্ট নেই। তবে কক্ষটির শান-শওকত কেমন ছিল তা আমি বেশ কল্পনা করতে পারছিলাম। সম্রাটের বিছানা থেকে পাশের যুমনা নদী দেখা যেত। গাইডের সাথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাণীদের ঘর দেখলাম। রাণীদের শোয়ার ঘর। পাশেই রানীদের গোছলখানা। আমরা তাও বাদ দিলাম না। ঘুরতে গেলাম। সেই যুগেও কি দারুণ সব আয়োজনে গোছলখানায় পৌঁছাতো যুমনার জল! কি অসাধারণ সব আয়োজন! চারশ’ বছর আগেকার এসব গোছলখানায় দারুণ দক্ষতায় ব্যবহার করা হয়েছে আয়নার। দেয়াল এবং ছাদে স্থাপন করা হয়েছে কাচ। কাচে কাচে ভেসে উঠে প্রতিবিম্ব। একজন মানব বা মানবীর অসংখ্য প্রতিবিম্ব গোছলখানার দেয়ালে, ছাদে। ভাবতে কেমন কেমন লাগছে যে, এসব গোছলখানায় একদিন নুরজাহান, মমতাজ কিংবা যোধাবাইর মতো ভুবনজয়ী সুন্দরীরা গোছল করতেন!
আমি স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে গাইডের পিছনে হাঁটতে লাগলাম। তিনি তখনো বলে যাচ্ছেন। অনেক কথা। আর আমার অন্তর জুড়ে বেজে চলছিল অনেক না বলা কথা। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।