(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতন। শুধু কী রবি ঠাকুর! কত গুণী মানুষের আনাগোনা ছিল এই শান্তিনিকেতনে! কতজনের কত স্মৃতি! কত সৃষ্টি এই শান্তিনিকেতনের পরতে পরতে। এখানের ধুলোবালিতে বেড়ে উঠেছেন কত জ্ঞানী গুনী, এখানের গাছের ছায়ায় বিকশিত হয়েছে কত মন, মনন। আম কাঁঠাল লিচু কিংবা ছাতিম তলায় রচিত হয়েছে কত মহাবাক্য, কত অমৃত বচন! জীবনে অনেক স্থানে গিয়েছি। বহু রাজা বাদশাহর বাড়ী দেখেছি। দেখেছি রাজদরবারের নানা আয়োজন। ইতিহাস এবং ঐতিহ্য মোড়ানো বহু কিছু দেখলাম। কিন্তু শান্তিনিকেতন যেন পৃথিবীর যে কোন রাজদরবার থেকে সমৃদ্ধ, যে কোন রাজবাড়ি থেকে উজ্জ্বল। শান্তিনিকেতন যেন সবকিছু থেকে আলাদা, অন্যরকমের কিছ। এমনতর একটি স্থানে যাওয়ার সুযোগ আমার ভিতরে অন্যরকমের এক উত্তেজনা সৃষ্টি করলো। ভিতরে বাইরে আমি সেই উত্তেজনা বেশ টের পাচ্ছিলাম। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সময় লাগে। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিতে হয়। পুরোদিন থাকার আঞ্জাম রাখতে হয়। জামাকাপড় পাল্টাতে হলে তারও ব্যবস্থা রাখতে হয়। এসব করতে অন্যান্য সময় যে পরিমান বেগ পেতে হয় বা সময় লাগে আজ মনে হলো তা লাগছে না। চোখের পলকে সব কাজই হয়ে গেল। একটি ট্রলিব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমরা দ্রুত লিফটের বোতাম টিপতে সক্ষম হলাম।
পাঁচতারকা হোটেলে নানা ধরণের আকর্ষণ থাকে, থাকে নানান সুযোগ সুবিধা। তবে এগুলোর অন্যতম হচ্ছে সকালের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট। তাড়াহুড়ো না করে রয়ে সয়ে এই ব্রেকফাস্ট এনজয় করার মজাটাই আলাদা। গল্প করতে করতে নাস্তা করা কিংবা শেষ করেও শেষ না হওয়া কফির আড্ডা ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করে। অথচ আজ শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য সেই আয়েশি নাস্তা কোরবানি করলাম আমরা। ব্রেট-বাটার এবং কলা দিয়ে দ্রুত সেরে নিলাম নাস্তা। অতি প্রিয় কফিও খেলাম না। অনেকটা দৌড়ের উপর গিয়ে গাড়িতে চড়লাম। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে একদমই ছিল না। প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার পথ। পাড়ি দিতে লাগবে বহু সময়। সবকিছু দেখে আবার ফিরে আসতে হবে। এখানে সময় নষ্ট করলে রবি দাদুর স্মৃতি হাতড়াতে বেগ পেতে হবে।
গাড়ি ছুটছিল। কোলকাতা নিউমার্কেটের পাশের হোটেল গ্র্যান্ড ওয়েবয় থেকে যাত্রা করেছি আমরা। শহরের অলি গলি এবং রাজপথ ডিঙ্গিয়ে গাড়ি ছুটছে। ড্রাইভার বললেন, অনেকগুলো পথ আছে শান্তিনিকেতন যাওয়ার। বিভিন্ন পথের দূরুত্ব ভিন্ন ভিন্ন। তবে তিনি এশিয়ান হাইওয়ে-১ বা দুর্গাপুর এঙপ্রেসওয়ে ধরে যাবেন বলে জানালেন। এই পথে বর্ধমান পেরিয়ে গুসকরা পার হলেই নাকি শান্তিনিকেতন। বর্ধমানের নাম শুনে কিছুটা চমকে উঠলাম। এটা কি কবি কাজী নজরুল ইসলামের বর্ধমান! ড্রাইভার জানালেন যে, হ্যাঁ। কাজী নজরুলের বর্ধমান। এই বর্ধমানের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন কবি। কবির স্মৃতিবিজড়িত নানা কিছু এখনো চুরুলিয়ায় রয়েছে বলেও জানালেন ড্রাইভার। তবে একই পথে রবি নজরুলের স্মৃতি হাতড়ানোর এমন সুযোগ আমাকে বিমোহিত করলো। রুট ম্যাপ সম্পর্কে ধারণা থাকলে আগে থেকে ট্যুর প্ল্যানটা সাজানো যেতো। একটি রাত এখানে কাটানো গেলে দুই কবির স্মৃতিধন্য দুইটি এলাকা ঘুরে দেখা যেতো। এখন আর সেই সুযোগ নেই। আমাদের জাতীয় কবি এবং বিদ্রোহী কবি নজরুলকে স্মরণ করলাম। দোয়াও করলাম। তবে আজকের দিনটি রবি ঠাকুরের স্মৃতিধণ্য শান্তিনিকেতনে কাটানোর জন্য বর্ধমান পেছনে ফেলে আমরা সামনে এগুতে লাগলাম।
হাইওয়ে ধরে ছুটলেও মনে হচ্ছিল গ্রামের ভিতর দিয়ে পথ চলছি আমরা। চারদিকেই নিখাদ গ্রাম। আমাদের গ্রামেরই মতোই। সবুজ সবুজে একাকার চারদিক। ধানের জমি, ফসলের মাঠ, পুকুর ডোবা, মাঠের মাঝখানে একাকি দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ তালগাছ। সবই কাছে ডাকছিল আমাদের। অপূর্ব নানা আয়োজন হাটে, মাঠে, ঘাটে। কোথাও কৃষানি ধান লাগচ্ছে, কোথাও বা নিংড়ে দিচ্ছে ভূমি। মায়াভরা অলস সকাল পার করছে দাওয়ায় বসে। রাস্তার পাশে ঝুপড়ির চা দোকান, দোকানের সামনে দুপেয়ে কাঠের টুল। তার উপর পা তুলে বসে আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন কেউ কেউ। পুরোদস্তর গ্রামের ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমরা ক্রমেই শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি হচ্ছিলাম।
পথিমধ্যে চালক জানালেন, চা খেতে হবে। নাহয় তার নাকি ঘুম পাচ্ছে। ড্রাইভারের ঘুম পাচ্ছে শুনে আমার বুকের ভিতরে টিপটিপ করতে লাগলো। চলতে চলতে ড্রাইভার যদি ঘুমিয়ে যান তাহলে আর রবীন্দ্র স্মৃতি নয়, সরাসরি রবীন্দ্র দর্শন হয়ে যাবে! নিজে নিজে হেসে উঠলাম। রবীন্দ্রনাথকে এত ভালোবাসেন এমন একজন মানুষও মরে গিয়ে রবীন্দ্র দর্শন করতে রাজী হবেন বলে মনে হয় না। মানুষ আসলেই যেন কেমন! স্মৃতি হাতড়াবে তবে সরাসরি দেখা করতে রাজি হবে না। এই যেন দেশে থাই খাবারের জন্য পাগল হয়ে যাওয়া মানুষগুলোও থাইল্যান্ড গিয়ে দেশী খাবারের জন্য হাজার হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দেয়ার মতো অবস্থা!
আমি ড্রাইভারকে কোথাও থেমে চা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলাম। আমরাও চা খাবো বলে জানালাম। রাস্তার পাশে একটি রেস্টুরেন্টে থামলাম আমরা। রেস্টুরেন্ট না বলে চা দোকান বললে ভালো। একই জায়গায় লাগালাগি করে অনেকগুলো দোকান। প্রায় সবগুলোই চা নাস্তা ও মিষ্টির দোকান। তবে সিগারেটসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে এমন দোকানও রয়েছে। গ্রামীণ বাজারের আবহ, তবে বড় কোন বাজার নয়। হাইওয়ে ধরা চলাচল করে এমন গাড়িগুলো এখানে থেমে চা নাস্তা করে বলেও মনে হলো। তবে কোন দোকানেরই তেমন কোন শান-শওকত নেই। নিখাদ একটি গ্রামীণ দোকান। কাঠের চেয়ার, টুল, টেবিল। চেয়ার টেবিল সবই পুরানো, রঙ চটা। আমরা বসলাম। ধূতির উপর গামছা মুড়িয়ে এক যুবক আসলো। কি খাবো জানতে চাইলো। ভাত মাছ তরকারি সবই আছে বলে জানালো। আমরা চা এবং সিঙ্গারা দিতে বললাম। যুবক বেশ দ্রুত আমাদের সিঙ্গারা দিল। সাইজ এবং ডিজাইন আমাদের সিঙ্গারার মতোই। পেঁয়াজ এবং কাঁচামরিচ দিয়ে সনাতনি পদ্ধতিতে সিঙ্গারা খেলাম। প্রতি প্লেটে দুইটি করে সিঙ্গারা দেয়া হয়েছিল। আমি এবং আমার স্ত্রী একটি করে খেয়ে অপরটি প্লেটে রেখে দিলাম। আমাদের গাড়ির চালক দুইটি খেলেন এবং বললেন যে, প্লেটে দেয়া খাবার ফেরত নেবে না, দুইটিই খেতে হবে। বিষয়টি আমার মনে পড়লো এবং পছন্দও হলো। খাবার ফেরত নিয়ে তা আবার অন্যজনকে দেয়া আসলে স্বাস্থ্যসম্মতও না। আমি দ্বিতীয় সিঙ্গারাটাও সাবাড় করলাম। কড়ি দিয়ে কিনে শুধু শুধু ফেলে যাওয়ার কোন মানে হয়না। চা দিতে বললাম। কি চা খাবো তাও জানতে চাইলো যুবক। ‘দুধ চা’ বলে অর্ডার করলেন আমাদের ড্রাইভার। আমি কিছু বলার আগে ড্রাইভারই অর্ডার করছেন। জল দিতেও বলে দিলেন তিনি। দুধের চা আসলো। গ্রামের গরুর দুধের চা। সর ভাসছিল। মাটির কাপে দেয়া অতি সামান্য পরিমানের চা, দুয়েক চুমুক দেয়ার পরই ফুরিয়ে গেল! এত অল্প চা তে কী মন ভরে, তৃপ্তি হয়? মেজাজই খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তবে পরিমানে কম হলেও চা’টুকু অমৃতের মতো লাগলো। আমি আরো তিন কাপ চা দেয়ার জন্য বললাম। কিন্তু ড্রাইভার এবং আমার স্ত্রী প্রায় সমস্বরে বললো, না না আর খাবো না। ফলে শুধু আমিই দ্বিতীয় কাপ চা নিলাম। আমার মনে পড়লো যে, সকাল থেকে চা কফি কিছুই খাইনি। এত বেলা পর্যন্ত চা না খেয়ে থাকার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। অথচ আজ রবীন্দ্র স্মৃতি দর্শনের তাড়াহুড়োয় সব এলোমেলো হয়ে গেছে। বেলা করে খাওয়া সকালের প্রথম কাপ চা প্রথম প্রেমের মতোই তৃপ্তিকর ছিল!
চার ঘন্টারও বেশি সময় পর আমরা পৌঁছলাম শান্তিনিকেতনে। পথে চা নাস্তা করা ছাড়াও একবার গাড়ির চাকা পাল্টাতে হয়েছিল। বেশ দ্রুত গাড়ি চালিয়েছিলেন আমাদের অভিজ্ঞ চালক। তবুও চার ঘন্টারও বেশি সময় লাগায় কিছুটা অসন্তোষ চালকের মুখে। আরো একটু আগে আসতে পারলে ভালো হতো। এখন ফিরতি পথে তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। আমি তাকে এই বলে আশ্বস্ত করলাম যে, ফিরতি পথে আমাদের তেমন কোন তাড়া নেই। রয়ে সয়ে গেলে হবে। হোটেলে গিয়ে ঘুমানো ছাড়া আজ আমাদের আর কোন কাজ নেই। ফলে শান্তিনিকেতন থেকে সন্ধ্যা করে ফিরতি পথ ধরলেও খুব বেশি অসুবিধা হবে না। ড্রাইভার সায় দিলেন। তিনি আমাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনারা আপনাদের মতো ঘুরে ফিরে দেখুন, গাইড নিয়ে নিন। আমি আমার মতো থাকবো। ফিরার সময় হলে ফোন করবেন। কোন ধরনের চাপ নেয়ার দরকার নেই বলেও তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন। গাড়ি থেকে নেমে লালসে রঙের মাটিতে পা দিতেই আমার শরীর মন কেমন যেন করে উঠলো। শান্তিনিকেতনে আমি! সত্যি সত্যি শান্তিনিকেতনে পৌঁছে গেছি! এই মাটি, এই আলো, এই হাওয়ায় তৈরি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ! আমার শরীর যেন কাঁপছিল! কাঁপছিল আমার মনও!
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।