(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। হিমাচল প্রদেশজুড়েই শুধুই পাহাড়। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল শুধু পাহাড়ই দেখছিলাম। কোথাও কোন বসতি নেই। কোন শহর নেই। নেই কোন বাড়িঘর। এই একটি মাত্র রিসোর্ট ছাড়া ধারে কাছে কোথাও বুঝি আর কোথাও কিছু নেই। বন–বনানী ঘেরা রিসোর্টটির জনাকয়েক মানুষ ছাড়া কোথাও জনমানবও বুঝি নেই। প্রকৃতির নিজস্ব ভাষা বুঝি মৌনতা। আর এজন্যই মনে হয় চারদিকে এমন সুনসান নীরবতা। নীরবতারও যে একটি রূপ আছে, সেই রূপও যে মানুষকে মোহবিষ্ট করে তা বেশ টের পাচ্ছিলাম আমি। চারদিকের মোহনীয় রূপে মাতোয়ারা হওয়া আমরা জনাকয়েক মানুষ ধীরলয়ে হাঁটছিলাম। আমাদের পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ মনে হয় কোথাও ছিল না। আমাদের গন্তব্য রেস্টুরেন্ট।
ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিমলা থেকে পাহাড়ী পথে ৪৫ কিলোমিটার এসেছি আমরা। কি ভয়ংকর সৌন্দর্য যে পথে পথে দেখেছি তার বর্ণনা আংশিক আপনাদের দেয়া হয়েছে। চেইলের গহীন জঙ্গলের ভিতরে গড়ে তোলা পাহাড়ী একটি রিসোর্টে আমাদের ঠাঁই হয়েছে। মিন্ট তারিকা জাঙ্গল রিসোর্ট। পাঁচ তারকা মানের আবাসিক হোটেল। তবে সচরাচর যেমন হোটেলে আমরা থাকি এটি তেমন নয়, অন্যরকম। তবে সব আয়োজনই চোখ ধাঁধানো। তাক লাগানো, দুর্দান্ত। ভার্সিন ফরেস্টের ভিতরে গড়ে তোলা রিসোর্টটির পরতে পরতে যে কী এক অসাধারণ মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তা লিখে বুঝানো অসম্ভব। অন্তত আমার মতো অক্ষম লেখকের পক্ষে তা কোনদিনই সম্ভব নয়।
পাহাড়ের উপর দিয়ে বয়ে চলা একটি রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম আমরা। কিন্তু পথ ফুরিয়ে গেল। আমাদেরকে বেশ কয়েক ধাপ নিচের দিকে নামতে হলো। নেমেই রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ের ভাঁজে গড়ে তোলা হয়েছে এক তলা একটি ভবন। সেখানেই রয়েছে মিন্ট তারিকা জাঙ্গল রিসোর্টের রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টটি বড়সড় হলরুমের মতো, খোলামেলা। আমাদের আটজনকে দুইটি টেবিল জোড়া দিয়ে বসার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো। খুব দ্রুতই টেবিল সাজিয়ে দেয়া হলো। ম্যানু দেখে অর্ডার করলেন আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। আমার ম্যাডাম লায়ন গভর্নর কামরুন মালেক স্যুপের অর্ডার করতে বললেন। লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং সুপ্রভা বড়ুয়া বৌদি সবজি জাতীয় কিছু দিয়ে খাবারের পক্ষে মত দিলেন। লায়ন মনজুর আলম মনজু ভাই আমাদের সাথে নেই। রাশু ভাবীকে রিসিভ করতে তিনি দিল্লী চলে গেছেন। এতে করে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রার শুরু থেকে অনেক পথ আমরা একসাথে ঘুরলেও পাহাড়ী জনপদ চেইলের সৌন্দর্য উপভোগ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়ে গেলেন। ভাবীকে নিয়ে দিল্লীতে তিনি সুখে শান্তিতে থাকলেও আমরা খুব মিস করছিলাম। লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনার তেমন বিশেষ কোন পছন্দ নেই বলে জানিয়ে খাবারের অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমাদেরকে শসা কেটে দেয়া হয়েছে। সালাদ হিসেবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় তরতাজা শসা! মেইন ডিস সার্ভ হওয়ার আগেই আমরা শসা সাবাড় করে দিলাম।
বেশ খোশমেজাজে লাঞ্চ সারলাম। কিন্তু রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মনে হলো বিকেল হয়ে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বিকেল! কেমন যেন লাগলো। একদিনের জন্য এসেছি। রেস্টুরেন্ট থেকে রুমে পৌঁছলাম আমরা। এডিটর স্যার এবং ম্যাডাম বললেন যে, আর কোথাও যাবেন না। রুমেই থাকবেন। একই সুরে কথা বললেন লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া এবং সুপ্রভা বড়ুয়া বৌদিও। নিশাত ইমরান এবং গুলশান আকতার চৌধুরীও ঘুমাবেন বলে জানালেন। তাহলে আমরা দুই বুড়োবুড়ি আর কি করি! ঘুমিয়ে যাবো কিনা চিন্তা করছিলাম। কিন্তু ঘুমানোর চেয়ে রিসোর্টের চারদিকে পাহাড় দেখলে ভালো হবে বলে মত দিলেন আমার স্ত্রী। আমিও সায় দিলাম। রুমে না গিয়ে রিসোর্টের হেথায় হোথায় ঘুরতে লাগলাম। বেশ সময় যাচ্ছিল আমাদের। বানরের ছোটাছুটি কিংবা পাখীর উড়াউড়ি দেখতে দেখতে পার করছিলাম সময়। মানুষ এবং প্রকৃতির চমৎকার সব আয়োজন চোখ ভরে দেখছিলাম। মনও ভরে উঠছিল।
হাঁটতে হাঁটতে রিসোর্টের রিসিপশনের সামনে পৌঁছে গেলাম। সামনে পড়লেন আমাদের ট্রাভেলার্সের ড্রাইভার। কোথাও ঘুরতে যাবো কিনা জানতে চাইলেন। পাল্টা প্রশ্ন করলাম তাকে। কোথায় যাওয়া যায়? তিনি বললেন, আপনাদের প্যাকেজে তো প্যালেস, মন্দির এবং ক্রিকেট স্টেডিয়াম পরিদর্শনের ব্যবস্থা আছে। ওই তিনটিই দেখার মতো। এখানে আর তেমন কিছু দেখার নেই। কি যে দেখার আছে আর কি যে নেই! চারদিকে এত রূপ যে কোনটা দেখে কোনটা ফেলি অবস্থা। আমি রিসিপশন থেকেই ইন্টারকমে এডিটর স্যারকে ফোন করলাম। ড্রাইভারের সাথে আমার আলাপ এবং প্যাকেজে স্থানীয় তিনটি দর্শনীয় স্থান থাকার কথা বললাম। স্যার বললেন, তোমার ম্যাডাম ঘুমিয়ে গেছে। এখন আর কোথাও যাবো না। রূপম বড়ুয়া দাদার কাছ থেকেও একই উত্তর পাওয়া গেল। লায়ন নিশাত ইমরানের রুমে কেউ ফোনই তুললেন না। অতএব আমরা দুজনই শুধু ট্রাভেলার্সে সওয়ার হলাম। অবশ্য আগেভাগে রিসিপশনের যুবকের কাছ থেকে এভাবে ঘুরতে যাওয়া কতটুকু নিরাপদ তা জেনে নিলাম। তিনি এক গাল হেসে বললেন, চেইল ক্রাইম ফ্রি। এখানে কোন সমস্যা হবে না। তিনি রিসোর্টের একটি কার্ড দিয়ে নিজের ফোন নম্বর লিখে দিলেন। কোন সমস্যা হলে ফোন করতে বললেন।
যাত্রা করলাম আমরা। পাহাড়ের বুক জুড়ে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা ধরে এগুচ্ছিল আমাদের বাহন। আমরা দুজন গল্পে গল্পে সময় পার করছিলাম। ড্রাইভার আমাদেরকে প্রথমে নিয়ে গেলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্রিকেট স্টেডিয়াম। পাহাড়ের এত উঁচুতে কি করে যে এমন একটি স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হলো তা আমাদের চোখে ঘোরের সৃষ্টি করলো। ১৮৯৩ সালে মহারাজা ভূপেন্দ্র সিংহ ক্রিকেট খেলার এই মাঠটি গড়ে তোলেন। অবশ্য স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে শুরু করে আনুষাঙ্গিক স্থাপনাগুলো পরবর্তীতে করা হয়েছে বলেও জানা গেল। মহারাজার সময়কালে এখানে প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হতো। দারুন জমে উঠতো ক্রিকেট খেলা। রাজা নিজেই উপস্থিত থেকে খেলা উপভোগ করতেন। বন্ধুবান্ধবদের দাওয়াত দিয়ে এনেও খেলা দেখাতেন। বড় মাপের কোন অতিথি বা অন্য রাজ্যের রাজা মহারাজা আসলেও মহারাজা ভূপেন্দ্র সিংহ প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করতেন। পরবর্তীতে মহারাজা স্টেডিয়ামসহ সবকিছু দান করে দেন। মিলিটারি স্কুলের খেলার মাঠ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়েছে বহু বছর। বর্তমানে এটিতে ফুটবল এবং বাস্কেট বল খেলারও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ক্রিকেট স্টেডিয়াম ঘুরতে আসেন। বিশ্বের সর্বোচ্চ এই ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে দৈনিক আজাদীর আমার প্রিয় সহকর্মী স্পোর্টস রিপোর্টার নজরুল ইসলামের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। আহ, এই স্টেডিয়াম যদি নজরুল দেখতো তাহলে কী সুন্দর একটি রিপোর্ট করতে পারতো। লর্ডসের সামনে দাঁড়িয়েও নজরুলের কথা আমার খুব মনে পড়ছিল। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম আমরা। বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি খেলার মাঠ হিসেবে যতটুকু না মুগ্ধ করলো আমাকে তার থেকে ঢের বেশি মুগ্ধ করলো এটির নান্দনিকতা। এমন রূপও হয়! পাহাড়ও এমন সুন্দর হয়! পাহাড় চূড়ার পুরোটাই ঢেকে আছে বরফে। চিকচিক করছে। কি অপরূপ পসরা পাহাড়ের!
ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের রূপ বেশি। সবই উপভোগ করছিলাম। মনে হচ্ছিল এই ক্ষণ যদি অনন্তকাল চলতো। এই সময় যদি না ফুরাত! ফিরতে হলো আমাদের। গাড়িতে চড়লাম। ড্রাইভার বললেন, এবার প্যালেস দেখাতে নিয়ে যাবেন। আমরাও সায় দিলাম।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম ‘চেইল প্যালেসে’। এক পাহাড় থেকে অপর পাহাড়ে। চেইল প্যালেস বর্তমানে হিমাচল ট্যুরিজিম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি আবাসিক হোটেল। তারকাখচিত হোটেল। প্রথম দেখাতেই ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছিল হোটেলটিকে। মনে হচ্ছিল কোথায় যেন দেখেছি! অথচ আমি আগে কোনদিন চেইল আসিনি। একটু খেয়াল করতে বুঝতে পারলাম যে, বলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’–এ এই ভবনটিকেই ‘চাঁচড় ভবন’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। দম ফাটানো হাসির সেই সিনেমাটি কয়েকবার দেখেছি টিভিতে। এতে করে ভবনটিও দেখা হয়েছে। তবে একেবারে চোখের সামনে মহারাজা ভূপেন্দ্র সিংহের হাতে গড়া প্যালেসটি নতুন করে যেন মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল। (চলবে) লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।