(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চমৎকার গোলাকার ঘরটি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আমি। কাঁচের ঘর। স্টিল স্ট্রাকচারের খাঁজে খাঁজে কাঁচ লাগিয়ে দারুণ একটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। গোলাকার অবকাঠামোকে দুইভাগে ভাগ করে এক ভাগে রিসিপশন এবং সামনের খোলা অংশে লবি তৈরি করা হয়েছে। গাড়ি বারান্দা টাইপের। যেখানে গাড়ি থেকে নেমেই কাঁচের দরোজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেই রিসোর্টের রিসিপশন। ঘরটি নির্মাণে নতুনত্ব রয়েছে। রয়েছে আধুনিকতা। নান্দনিকতা তো চারদিকে ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছেই। ট্রাভেলার্স থেকে নামতেই এমন একটি নান্দনিক ব্যাপার স্যাপার দেখে ‘মিন্ট তারিকা জাঙ্গল রিসোর্ট’ সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে যেতে শুরু করলো। ঘন জঙ্গলের ভিতর হলেও আমাদের নিশিযাপন যে খুব একটা মন্দ হবে না তা যেন প্রথম দেখায় আঁচ করতে পারলাম। এমন ঘন জঙ্গলে রাত কাটাতে এসে যে বাঘভাল্লুকের খাবার হবো না তাতে অন্তত আশ্বস্ত হলাম। ওয়েলকাম ড্রিংকসের নামে দারুণ এক পানীয় দেয়া হলো। পুদিনার জুস টাইপের কিছু হবে। চুমুকে চুমুকে বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিলাম। রিসিপশনের লোকজন আমাদের পাসপোর্ট দিতে বললেন। আটজনের পাসপোর্টই একই সাথে ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিলাম। তিনি কম্পিউটারে কি কি সব তথ্য উপাত্ত টুকে আমাদেরকে চারটি রুমের চাবি দিলেন। আমাদের নাম ঠিকানা টাইপ করে চেকইন স্লিপে সাইনও করিয়ে নিলেন। রিসিপশন থেকে আমাদেরকে রুম ডিরেকশন দিয়ে সাথে একজন লোকও দেয়া হলো। এটিও নতুনত্ব। রুমের চাবি দিয়ে রিসিপশনের লোকেরা দায়িত্ব সারেন। এখানে রুম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য লোক দিলেন। আমাদের লাগেজ উনারা অন্য লোক দিয়ে পৌঁছে দেবেন বলেও জানালেন।
রিসিপশন রুম থেকে বের হয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কোথায় হোটেল, কোথায় রিসোর্ট!! চারদিকে পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। কেন আমাদের সাথে লোক দেয়া হলো তা বুঝতে পারলাম। এমন জঙ্গলের ভিতর রুম খুঁজে পাওয়াতো আর চাট্টিখানি কথা নয়! আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। বন-বনানীর ভিতর পিচঢালা সরু রাস্তা। রাস্তার পাশে চমৎকার সব গাছগাছালী। কোথাও কোথাও ঘন জঙ্গল। নানা আকৃতি দিয়ে গাছও সাজানো হয়েছে। কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় অতি সাধারণ গাছগুলোও অপরূপ হয়ে উঠেছে অন্যরকমের নান্দনিকতায়। ফ্রান্সের ভার্সাই প্রাসাদে অসংখ্য গাছ এমন করে সাজিয়ে রাখতে দেখেছিলাম। এখানে অত বেশি না হলেও বেশ কিছু গাছকেই নানা ধরনের আদল দেয়া হয়েছে। হাতি ঘোড়াও বানানো হয়েছে কৃত্রিম ভাবে। তরতাজা সব বানর খেলা করছিল এখানে ওখানে। দোল খাচ্ছিল গাছে গাছে। কিছু পথ এগুনোর পরই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছোট্ট ছোট্ট একতলা সব ঘরদোর। আমাদের নিশিযাপনের ডেরা। পাহাড় না কেটে ম্যানেজ করা হয়েছে দারুণভাবে। পাহাড় চূড়ার এই এলাকাটিতে এমনভাবে পাহাড় ম্যানেজ করা হয়েছে যেন অনেকগুলো টিলা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। এই টিলাগুলোর উপরই এক একটি ভবন। একটি ভবন থেকে অপর ভবনটি পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে। কোনটির সাথে কোনটি লাগোয়া নয়। ভবনগুলোর মাঝে আবারো টিলা, আবারো গাছ গাছালী। এক চিলতে মাঠে। সবুজ ঘাষে আচ্ছাদিত। তাতে বসে গল্প করা, চা কফি খাওয়া কিংবা আড্ডা মারার নানা আয়োজন। অর্থাৎ পাহাড়ের হেথায় হোথায় সব ছোট ছোট ভবনকে ঘিরে আবারো সব নয়নাভিরাম দৃশ্যপট তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। যেন সাজানো গোছানো সব বাড়ি। কোন পাহাড়ি জনপদের ছোট্ট বসতি। যেখানে সব বাড়িগুলোই একতলা, একই আদল। এক একটি পরিবারের নিজেদের ঘরদোর। চারটি রুম নিয়ে একটি ভবন। কোন কোনটিতে রুমের সংখ্যা মাত্র দুইটি। ইউরোপীয় স্টাইলের ছাদ। তাও আবার রঙ্গিন। প্রতিটি ভবনে উঠার জন্য বিশ পঞ্চাশটি সিঁড়ি। সিঁড়ি টপকে টপকে ঢুকতে হচ্ছে ঘরে। আমাদের রুমগুলো পড়েছে দুইটি পৃথক ভবনে। চার রুমওয়ালা ভবন থাকলেও একই ভবনে চারটি রুম খালি নেই। এতে করে আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক ও ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেক এবং সাবেক গভর্নর, কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম স্বত্বাধিকারী লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া ও লায়ন সুপ্রভা বড়ুয়া এক ভবনের পাশাপাশি দুইটি রুমে চলে গেলেন। লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা এবং আমরা (আমার স্ত্রী শামীমা নার্গিস) একটি ভবনে পাশাপাশি দুইটি রুম পেলাম।
রুমে ঢুকেই আমি বেশ বাড়ি বাড়ি একটি আবহ পেলাম। রুমটি বেশ সুন্দর। পার্টিশানহীন, তবে দু’ভাগ। কিছুটা ডুপ্লেঙ ভাবও রয়েছে। পাহাড়ের ভাঁজটি ঠিক রেখে রুমের একটি অংশে ড্রয়িং রুমের মতো করা হয়েছে। তাতে সোফা, ডিভাইন, টিভি, কফি মেকার থেকে শুরু করে নানা কিছু দিয়ে সাজানো। ওখান থেকে কয়েক সিঁড়ি উপরে উঠলেই বেডরুম। বিশাল বিছানা। এরসাথে লাগোয়া ওয়াশরুম। রুম একটি। তবে পাহাড় কেটে সমান না করায় এবং ছোট্ট একটি সিঁড়ি দেয়ায় চমৎকার একটি ডুপ্লেঙ ভাব চলে এসেছে। আমাদের ভবন থেকে অপর ভবনটির দূরত্ব একশ’ গজের মতো। তাও আবার পাহাড় এবং সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ওই ভবনে যেতে হবে। অবশ্য খোঁজখবর নেয়ার জন্য রুমে ইন্টারকম রয়েছে। এডিটর স্যার ইন্টারকমে ফোন করে লাঞ্চের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বললেন। রেস্টুরেন্ট কোথায়, রুম সার্ভিস পাওয়া যাবে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলো জেনে নিতেও স্যার আমাকে দায়িত্ব দিলেন। এই রিসোর্টে আমাদের সকালের নাস্তার টাকা রুম রেন্টের সাথে পরিশোধ করা আছে। কিন্তু আমাদের লাঞ্চ কিংবা ডিনার আলাদাভাবে করতে হবে। হোটেলে রুমে বসে খেতে চাইলে রুম সার্ভিসের মাধ্যমে আনাতে হয়। তবে বাড়তি এই সুবিধা নিতে রেস্টুরেন্টের তুলনায় অনেক বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয়। আমি রেস্টুরেন্টের লোকেশন জেনে নিয়ে স্যারকে ফোন করলাম। কিছুটা সামনে গেলেই রেস্টুরেন্ট বলে জানালাম এবং রেস্টুরেন্টে গিয়েই খেলেই ভালো হবে বলেও মতামত দিলাম। আমরা আটজনের দলটি কিছুটা বিলম্বিত লাঞ্চ করার জন্য রেস্টুরেন্টের দিকে যাত্রা করলাম।
এবার বিপরীত দিকে যাত্রা। রিসিপশন থেকে যেপথ ধরে রুমে এসেছিলাম, রেস্টুরেন্ট তার বিপরীত দিকে। আবারও পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রাস্তা। রাস্তার এক পাশে খাদের মতো। সেই খাদের গভীরেও রুম তৈরি করা হয়েছে। দুইটি রুমের ছাদ করা হয়েছে কাঁচ দিয়ে। একেবারে বনের ভিতরে কাঁচের ছাদ। এগুলো নাকি এই রিসোর্টের সবচেয়ে অভিজাত কক্ষ। আমি কিছুটা কৌতূহল নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের খাদের কাছের একটি রুমে গেলাম। দরোজা বন্ধ। কোন লোকজন নেই। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে যতটুকু দেখা গেল তাতে বুঝলাম যে, রুমগুলোর চারপাশে দেয়াল থাকলেও ছাদ পুরোপুরি কাঁচের। ঘরের ঠিক মাঝখানে বিছানা। ভর চাঁদনি রাতে কিংবা অন্যসময় আকাশের তারা গুণতে গুণতে ঘুমানোর সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি রুমের জন্য রয়েছে আলাদা সব বিলাসী আয়োজনও। এতসব আয়োজন নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। তবে ভর চাঁদনী রাতে এমন কাঁচের ছাদের তলায় শুয়ে থাকতে কেমন লাগবে কল্পনায় তা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম।
মালদ্বীপে একটি রিসোর্টে রাত কাটিয়েছিলাম। সেখানে সাগরের বুকে কতগুলো রুম দেখেছিলাম। যেখানে রুমের বিছানার বাইরে ফ্লোরটি কাঁচের। নিচে জলকেলি করছে মাছ। ছাদেও রয়েছে কাঁচের কারুকাজ। ওগুলোতে মনে হতো খোলা আকাশের নিচে সাগরের বুকে শুয়ে আছেন। মানুষকে মুগ্ধ করে টাকা আয় করাই পর্যটনের মূল মন্ত্র। আর এই কাজটি দুনিয়ার নানাদেশে নানাভাবে হয়ে থাকে। শুধু আমাদেরই —–।
আমরা হাঁটছিলাম রেস্টুরেন্টের দিকে। হেলে দুলে হাঁটা। প্রকৃতি দেখে দেখে পথ চলা। চমৎকার এই রিসোর্টের চারদিকে এত উঁচু উঁচু সব পাহাড় যে মনে হচ্ছিল হিমালয়। অথচ আমি জানি যে, হিমালয় এখান থেকে অনেক দূরে। তবে হিমাচল প্রদেশের প্রতিটি পাহাড়ই যেন হিমালয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যের আলো তেমন কড়া নয়। মিষ্টি একটি আবহ চারদিকে। প্রতিটি পাহাড়ের চূড়া যথারীতি বরফে ঢেকে আছে। চিকচিক করছে রূপালী বরফ। বরফে বরফে আচ্ছাদিত চারপাশের পাহাড়গুলো যেন কেবলই হাতছানী দিয়ে ডাকছে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী