দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৮ জুন, ২০২২ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

গুহা অভিযান চলছিল আমাদের। এই অভিযান মানে হাঁটাহাঁটি। গুহার ভিতরে দলবেঁধে ঘুরছিলাম আমরা। উঠোনে হাঁটার মতো করে পথ চলছিলাম। এত মসৃণভাবে মাটি কাটা হয়েছে যে পথ চলতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। একপাশে মাটির সিঁড়ি করে রাখা হয়েছে। অনেকটা ডুপ্লেক্স বাড়ির মতো। সিঁড়ি চলে গেছে উপরে। আমরা একটির পর একটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরের দিকে উঠছিলাম। সিঁড়িটিও চমৎকার। বেশ সুন্দর, গোছানো। ধাপগুলোও একেবারে নিখুঁত। পাথর কাটাকুটি করে এভাবে একটির পর একটি সিঁড়ি কোন প্রযুক্তিতে যে তৈরি হয়েছিল কে জানে! পাকা সিঁড়ি নয়, তবে পাকার চেয়ে মজবুত এবং সুন্দর মনে হচ্ছিল। আমরা বেশ স্বাচ্ছন্দে গুহার তলা থেকে বেশ উপরে উঠে গেলাম। গুহার পরতে পরতে সাতরাজ্যের বিস্ময়! পাহাড়ের ভিতরে গুহা বানিয়ে তাতে এতকিছু কেন করা হয়েছিল, কী করে করা হয়েছিল কে জানে! এত সুনসান আয়োজন, এত মসৃন করে পাহাড় কেটে গুহা তৈরি আধুনিক যুগে খুব একটি কঠিন নয়, কিন্তু আড়াই হাজার বছর আগে! মাথায় কিছু ঢুকছিল না। চারদিকে পাহাড়ের মাটি, পাথর। মাঝখানে চমৎকার গুহা, ঘরের মতো। একটু রঙ করে দিলে পাকা দালান মনে হবে। এত বড় গুহাটি এত নিখুঁতভাবে খনন করতে কত মানুষ যে মাঠে নেমেছিল কে জানে! কত বছর সময় লেগেছিল? এত দীর্ঘসময় ধরে এত কষ্ট করে এই পাহাড়ের গহীণ জঙ্গলে এসে গুহা বানানোর দরকারটিবা কী ছিল! কিভাবে খনন করা হলো তারও কোন তথ্যউপাত্ত বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি। গুহার ধারেকাছে কিংবা আশেপাশের গ্রামগুলোতে বহু অনুসন্ধান চালিয়েও এই গুহা খননকাজে ব্যবহৃত কোন যন্ত্রপাতি বা পরিত্যক্ত কিছু বিজ্ঞানীদের হাতে পড়েনি। কোন চিহ্নও কোথাও নেই। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নটি জোরালো হয়ে উঠে যে, আসলেই কি গুহাগুলো কোন মানুষে বানিয়েছিল? এই ধরনের বহু প্রশ্ন শুধু আমার মাথায় নয়, গুহা আবিস্কারের পর থেকেই মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। বহু প্রশ্ন কিন্তু কোন উত্তর নেই। যত দেখি তত বিস্ময় জাগে, কিন্তু কিছ মাথায় ঢুকে না। তবে গুহাটি দেখতে না আসলে যে একটি অনেক বড় জিনিস মিস করে ফেলতাম তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।

আমরা হাঁটছিলাম,গুহার ভিতরে। আনন্দ করতে করতে উৎসবমুখর পরিবেশে পথ চলছিলাম আমরা। পথ চলছিলেন আরো অনেকেই। নানা বয়সের প্রচুর নারী পুরুষ গুহা দেখতে এসেছেন। বিশ্বের নানা দেশ থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার পর্যটক এই গুহা ঘুরতে আসেন। হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিল, কত মানুষের কত রক্ত ঘাম জড়িয়ে রয়েছে এই গুহায়। এই গুহা কৃত্রিম নয়, গুহার ভিতরের পাথরের দেয়ালে হাতে আঁকা নানা ছবি বলে দেয় এই গুহা তৈরি করা হয়েছে। আহা, কত মানুষের কত রক্ত, কত মানুষের কত ঘামের বিনিময়ে আমাদের আজকের এই আনন্দ! আমার মনে হলো, বহু মানুষের বহু রক্তঘামে তৈরি গুহার ভিতরে আমরা একদল মানুষ নানাভাবে আনন্দ করছি। আমাদের আজকের এই আনন্দের পেছনে কত যুগ আগের কত মানুষের কত ত্যাগ জড়িয়ে রয়েছে! পরবর্তী প্রজন্মের আনন্দের জন্য এভাবেই বুঝি রক্তঘাম দিয়ে যায় মানুষ! আহা, তা কি কেউ আর মনে রাখে। তিন প্রজন্ম কোনরকমে টিকে থাকলেও চার প্রজন্মে হারিয়ে যায় কোটি কোটি মানুষ। আজকের অতি দাপুটে মানুষটির নাম তার স্বজনেরাই মনে করতে পারে না। আমাদের অনেকেই যেমন মনে করতে পারেন না দাদুর বাবার নাম! আজকের এই আমি মাত্র তিন প্রজন্ম পরেই হারিয়ে যাবো। আমার সন্তানের সন্তান কিংবা তার সন্তানেরা আর আমাকে মনে রাখবে না, রাখতে পারবে না। তাহলে কার জন্য লুটপাট করে মানুষ, কিসের জন্য!

সিঁড়ি বেয়ে একেবারে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিলাম আমরা। খাড়া সিঁড়ি। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে আমার মতো মোটা মানুষের জন্য। লায়ন ফজলে করিম এবং লায়ন বিজয় দা আমাকে না উঠার পরামর্শ দিলেন। মোটা মানুষ, পড়ে টড়ে গেলে বিপদ। কিন্তু এতদূর এসে উপরে উঠার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। পাহাড়ি পথ। মাটি ও পাথর কেটেকুটে তৈরি রাস্তা, সিঁড়ি। এই পথ ধরে উপরে উঠার কষ্ট এবং ঝুঁকি দুটোর সাথেই আমি পরিচিত। জীবনে বহুবার সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিখরে উঠেছি। বহু বর্ণিল সময় কাটিয়েছি ওই পাহাড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে। যখন তখন পাহাড়ে চলে যাওয়া কিংবা প্রকৃতির বুকে গা ভাসিয়ে দেয়ার সুখ অন্যরকম। পাহাড়ী পথ পাড়ি দেয়ার অবর্ণনীয় কষ্ট যে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর সাথে সাথে উবে যায় তাও বেশ জানি আমি। চীনের এই পাহাড়ী গুহার সিঁড়ি ডিঙ্গাতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছিল, পুরো শরীর জুবুথুবু হয়ে গিয়েছিল ঘামে। বুক শুকিয়ে যাচ্ছিল। পানির বোতল সাথে ছিল। ঠিক কতটুকু পানি খেলে বুকের তৃষ্ণা মিটে কে জানে! তবে এটুকু জানি যে, পথ শেষে তৃপ্তির যেই হাসিটা আসবে তাতে সব কষ্ট নিমিষেই মিলিয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলাম আমরা। সহজভাবে বললে সকাল থেকে প্রায় বিকেল অব্দি ঘুরছি আমরা। পাহাড়ী গুহায় দিনের বেশিরভাগ সময় পার করে টের পেলাম যে, শরীর থেকে শুধু ঘামই নয়, আমাদের শক্তিও ঝরে গেছে। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে আমার, আমাদের। আমাদের সকলেরই একই সাথে খাওয়ার কথা মনে পড়লো।

অনেকটা সমস্বরেই আমরা ক্ষুধা লাগার কথা বলে উঠলাম। আমাদের সাথে থাকা জ্যাক কোম্পানির কর্মকর্তা মিজ জেসি লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। বেশ সুন্দরী এই তরুণীকে লজ্জিত হতে দেখে আমারই লজ্জা লাগছিল। এভাবে ক্ষুধার কথা না বললেই হতো। আমার মনে হলো খাবারের দেরি হওয়ায় মিজ জেসি নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। খাবারের ব্যবস্থা করতে দেরি হওয়ায় তিনি বারবার সরি বলতে লাগলেন। বিষয়টি আসলে মোটেও তেমন নয়। এটা জেসির বাড়ি নয় যে দাওয়াত দিয়ে এনেছেন। ট্যুরিস্ট স্পট, প্রচুর লোক। আমরা ঘুরছি, ঘোরাঘুরি শেষ হলে খেতে যাবো এটিই স্বাভাবিক। গুহা এবং পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে আমরা দেরি করেছি, এই দেরির সাথে জেসির কোন সম্পর্ক নেই। তার লজ্জিত হওয়ারও কোন কারণ নেই। শুধুমাত্র ভদ্রতাবশতঃ তিনি বিব্রত হচ্ছেন। জাপানীদের ভদ্রতা নিয়ে নানা গল্প চালু আছে, জাপান সফরকালে খুব কাছ থেকে তাদের অনেককিছু দেখেছিলাম, কিন্তু চীনা নাগরিকদের মাঝেও যে অনেকের ভদ্রতা জ্ঞান বেশ টনটনে তা মিজ জেসিকে দেখে বুঝতে পারলাম। টেবিল ভর্তি খাবার। আগেই বলেছি যে, বিশাল দেশ চীন। বহু মানুষ। তাদের সবকিছুই বড়, বিশাল। রেলস্টেশনে যান মাথা ঘুরে যাবে। বিমানবন্দরে যান, মাথা চক্কর দেবে। বাস স্টপেজে যান, পথ ভুলে যাবেন। খাবারের রেস্টুরেন্টে যান. তাক লেগে যাবে। এক একটি রেস্টুরেন্ট আমাদের দেশের স্বাভাবিক সাইজের রেস্টুরেন্টের চেয়ে কয়েকগুণ বড়। পাহাড় থেকে নেমে আমরা গাড়িতে চড়ে মাঝপথে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকেছি। আমাদের ড্রাইভারই এই রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এখানেই আমাদের বিলম্বিত লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা কি খাবো না খাবো তা জেনে নিয়ে অর্ডার করা হয়েছে। অর্ডার করে মিজ জেসি টেবিলে বসে থাকেন নি। তিনি ওয়েটারের সাথে মনে হয় শেফের সাথে কথা বলতে চলে গেছেন। চীনা মানুষগুলোকে সুস্থির হয়ে বসে থাকতে দেখিনা। এরা সারাক্ষণই কোন না কোন কাজ করে। কাজ না থাকলে অকাজ! জমকালো আয়োজনে লাঞ্চ পর্ব সাঙ্গ হলো। কত কিছু যে খেলাম। সবই চীনা খাবার। কোনটি খাওয়া যাচ্ছিল, কোনটি যাচ্ছিল না। কোনটির টেস্ট কিছুটা মুখে লাগে, আবার কোনটি একেবারে লাগেনা। কোন কোনটি পাতে নিতেও ইচ্ছে করে না। যেই চাইনিজ খাবারের জন্য চট্টগ্রামে আমরা দেওয়ানা হয়ে উঠি, চীনাদের সেই খাবার নিয়ে আমাদের দুর্গতি যদি ঠিকঠাকভাবে লিখতে পারতাম! অবশ্য খাবারে এত ভ্যারাইটি যে টুকটুক করে কিছু কিছু খেলেও পেট ফুলে উঠে। প্রচুর ফলমূল দেয়া হয় লাঞ্চে, ডিনারে। ডেজার্টে রকমারি মিষ্টি জাতীয় খাবার। এতে করে মেইন ডিসে কিছু গোলমাল হলেও স্টাটার এবং ডেজার্ট দিয়েই বেশ টিকে যাচ্ছিলাম।

খাবারের টেবিলেও আমাদের আলোচনার মুল বিষয় ছিল গুহা। এত সুন্দর করে গুহাগুলো কেন তৈরি করা হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আমরাতো দূরের কথা মিজ জেসিও বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি নিশ্চিত নন। নিশ্চিত নন আমাদের চালকও। তিনি সবসময় ট্যুরিস্ট নিয়ে আসেন, দেখেন কিন্তু গুহাগুলো কেন তৈরি হয়েছিল বা কারা তৈরি করেছিল সেই সম্পর্কে কিছু জানেন না। এগুলো মানুষে বানিয়েছে নাকি জ্বীনে তৈরি করেছে কে জানে! অবশ্য চীনে জ্বীন নিয়ে কোন আলোচনা হয় না, তাদের অনেকেরই ধারণা ভিনগ্রহ থেকে এলিয়ন টাইপের কিছু এসে গুহাগুলো বানিয়েছিল। তারা যাওয়ার সময় তাদের সব সরঞ্জাম নিয়ে গেছে। এতে করে গুহা থাকলেও এগুলো কি করে খনন হয়েছে, কোন যন্ত্র ব্যবহার হয়েছে তার কোন যতি চিহ্নও গুহায় কিংবা ধারে কাছের কোথাও নেই। কথাটির যুক্তি আছে, তবে এই যুক্তি বিশ্বাস করতেও কষ্ট আছে।

লাঞ্চ শেষে কফির অর্ডার করেছিলাম। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি আবারো সেই গুহা নিয়েই চিন্তা করতে লাগলাম।

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণে চাই একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ