দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ হেলেদুলে হোটেল থেকে বের হলাম। অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্টের তারকাখচিত হোটেল, বিশাল লবি, ঢাউস সাইজের রিসিপশন। সেখানে কম্পিউটারে কাজ করছেন জনা চারেক স্মার্ট তরুণীরা। কী বাহার তাদের একেক জনের! রঙ করা চুল এবং ঠোঁট নাচিয়ে তারা হোটেলে চেকইন করা লোকজনকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। লিফট থেকে বেরোনোর পরই চোখে পড়ছিল বিশাল ডেস্ক, আমি তাদেরকে একপলক দেখলাম, কিন্তু তারা আমাদের দেখলো কিনা কে জানে! ডেস্কের সামনে কয়েকজন নারীপুরুষ চেকইন করছিলেন। তরুণীরা তাদের নিয়েই ব্যস্ত! আসলে এরা অত্যন্ত প্রফেশনাল, যতটুকু হাসি দরকার ঠিক ততটুকই হাসেন, কথাবার্তার মাপঝোঁকেও একটুও এদিকওদিক নেই। বাক্যের আগে পিছে দুইবার ‘স্যার’ করেন। সাদা চামড়ার লোকজন যখন আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করেন তখন আমার ভিতরটা বেশ পুলকিত হয়ে উঠে। আসমানে থাকা দেশগুলোর নাগরিকদের কাছ থেকে এমনতর সম্মান পেলে মনে হয় বাপদাদাদের যে অপমান অপদস্ত করা হয়েছিলো তার কিছুটা হলেও শোধ নেয়া হচ্ছে।

লবিতে বসে কফি খাওয়া যায়, কিন্তা আমরা বসলাম না। হোটেলের সেন্সর নিয়ন্ত্রিত দরোজা পার হয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। গা ছুঁয়ে গেলো শীতল একটি আবহ, সমুদ্র ছুঁয়ে আসা নোনতা বাতাস। হোটেল পেছনে রেখে আমরা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। হোটেলটির একেবারেই কাছেই সমুদ্র। একটি রাস্তা পার হলেই বিচ, সাগরের গর্জন। এটি নাকি গোল্ডকোস্টের প্রধান এবং অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বিখ্যাত বিচসার্ফার্স প্যারাডাইস। লায়ন ফজলে করিম এবং লায়ন বিজয় শেখর দাশ একদিন আগ থেকেই গোল্ডকোস্টে রয়েছেন। তারা এখানে আমার সিনিয়র, বেশি কিছু জানেন। তাই তাদের দেখানো পথ ধরেই মাত্র দু’মিনিটেই পৌঁছে গেলাম সাগরপাড়ে। বিচটির নামই বলে দিচ্ছে যে, এটি সার্ফারদের স্বর্গরাজ্য। তাই বলে, রাতবিরাতেও এতো সার্ফার নারীপুরুষ দেখবো ভাবিনি। বিভিন্ন শহরে নারীপুরুষকে এমন পোশাক পরে হোটেলের সুইমিং পুল থেকে রুমে ফিরতে দেখেছি, কিন্তু সেই একইধরনের সাজে সাগর থেকে হোটেলে ফিরতে এর আগে কোনদিন দেখেছি বলে মনে পড়লো না। সরাসরি তাকাতে পারছিলাম না, কিন্তু চোখতো দেখবেই। তাই আড়চোখে দেখছিলাম। রাতে সার্র্ফিং করে হোটেলে ফিরছিলেন তারা, আবার আমাদের আগে পিছেও বেশ কয়েকজন সার্ফার বোর্ড নিয়ে বিচের দিকে যাচ্ছিলেন। সাগরের ঢেউয়ের উপর ভর করে কী আনন্দেই না মেতে উঠেন তারা! সার্ফিং আমি কোনদিন করিনি, তবে সাগরের ঢেউয়ের উপর গা ভাসিয়ে অন্যরকমের আনন্দ পেয়েছি বহুবার।

সার্ফার্স প্যারাডাইসের সাগরপাড়ের রাস্তাটি দুর্দান্ত। মেরিন ড্রাইভ। রাস্তার একপাশে বিস্তৃত সাগর, অপর পাড়ে সব সুউচ্চ ভবন। হোটেল, আবাসিক ফ্ল্যাট, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অফিস। কী যে সুন্দর একেকটি বিল্ডিংএকেবারে আকাশ ছোঁয়া। বহু বড় বড় কোম্পানির নিয়ন সাইন ভবনগুলোর শীর্ষে, ঠিকরে ঠিকরে আলো বেরুচ্ছে।

রাস্তাটিতে স্ট্রিটলাইট জ্বলছিল। দারুন উজ্জ্বল আলো, কিন্তু একেবারে নরোম। চোখে লাগছিলো না। পর্যটকেরা যেনো পুরোরাত আনন্দের সাথে হাঁটতে পারেন, সময়কে উপভোগ করতে পারেন সেজন্য চমৎকার এই আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাস্তার পাশে, বিচের পাড়ে অনেক দোকান, বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের স্ট্রিটফুড, স্যুভেনির, আইসক্রিম। সার্ফিং বোর্ডের বেচাকেনাও চলছিল। আবার এসব বোর্ড নাকি ভাড়াও নেয়া যায়। ব্যাপারটি দারুণ লাগলো। ট্যুরিস্টদের কারো সার্ফিং করার ইচ্ছে করলে একটি বোর্ড ভাড়া নিলেন, নেমে পড়লেন সাগরে। যাওয়ার সময় বোঝা টানার দরকার নেই, দোকানে ফেরত দিয়ে গেলেই কেল্লাফতে! সার্ফিং বোর্ড দেশ থেকে বয়ে আনানেয়ার কোন ঝামেলাই থাকলো না। মেরিন ড্রাইভের পাশে মদবিয়ারের ছড়াছড়িও চোখ এড়ালো না। সাগরপাড়ের ঘাষেঢাকা মাটিতে বসে অনেকেই আসর বসিয়ে দিয়েছেন, তবে কোন মাতাল বা মাতলামী চোখে পড়লো না। তারা নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছিলেন, কাউকে ডিস্টার্ব করছিলেন না। অন্ততঃ আমাদের দিকে তারা ফিরে তাকানোরও গরজ বোধ করলেন না। মাতাল না হলেও তাদের মগজে যে দোলার সৃষ্টি হয়েছে তা তাদের আনন্দের মাত্রা দেখে বুঝা যাচ্ছিলো। উন্মুক্ত আকাশের নিচে সাগরপাড়ে বসে কী মাতোয়ারাই না তারা হয়ে উঠেছিলেন নিজেদের নিয়ে!

রাত নেমেছে অনেক আগে, কিন্তু চারপাশের আবহ দেখে মনে হচ্ছিলো সবেমাত্র সবকিছু শুরু হয়েছে। ‘দ্য নাইট ইজ টিল ইয়াং’ বলে একটি কথা মাঝেমধ্যে শুনতাম। কথাটি মনে হয় গোল্ডকোস্ট থেকেই গেছে। বেশ কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গিটার বাজিয়ে গান করছিলেন। অনেকেই তাদের দেখছেন, কেউ কেউ খুশী হয়ে কড়িও ফেলছেন। একটি গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই হাততালী দিয়ে উৎসাহিত করছিলেন। শিল্পীও আবারো গিটারে নতুন সুর তুলছিলেন। আমরাও কিছুক্ষণ গান শুনলাম। কিন্তু সুর এবং ছন্দ শরীরে কিছুটা দোলা জাগালেও একটি শব্দও বুঝলাম না। একটিও পরিচিত গান কেউ গাইলেন না। তবুও অন্যদের দেখাদেখি আমরাও হাততালি দিতে আলসে করছিলাম না।

আমরা হেঁটে বিচে গিয়ে নামলাম। চমৎকার বিচ, শুকনো বালু, ধবধবে সাদা। যেনো পরতে পরতে সোনা মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। গোল্ডকোস্ট নাম মনে হয় এই বিচের বালু থেকেই এসেছে। রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে সাগরের কাছাকাছিতে যেতে স্ট্রিট লাইটের আলো মিইয়ে গেলো। কিন্তু আলোর যেনো অভাব ছিলো না। হঠাৎই খেয়াল হলো যে, রাতের আকাশে হাসছে মস্ত বড় একটি চাঁদ, সুপারমুন নাকি? ভর চাঁদনি, চারদিকে জ্যোৎসার কলকলানী, সাগরের কলতান। আমি গুনগুন করে উঠলাম, ‘আজ জ্যোৎম্নারাতে সবাই গেছে বনে-’। সাগরে এসে বনের গান! সুর পাল্টে গুনগুনিয়ে শুরু করলাম– ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে-’। প্রকৃতির কী অপূর্ব আয়োজন চারদিকে। সারাগায়ে জ্যোৎস্না মেখে ঘরছি বিচে! ব্যাপারটি কাকতালীয় হলেও দারুণ উপভোগ্য মনে হলো। এমন চাঁদনি রাতে সাগরের কলতান শোনার শান্তিটা একটু অন্যরকম। আমার মনটি ভালো হয়ে গেলো।

বিচে হাঁটছিলাম। ধবধবে সাদা বালি, চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে। আমরা হেঁটে একেবারে পানির কাছে চলে গেলাম। এক একটি ঢেউ এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। জ্যোৎস্নায় ঢেউগুলোও সারাগায়ে রঙ মেখেছে। কী অপরূপ সাজেই না কলকল করছে সমুদ্র, কী বর্ণিল সাজেই না এগিয়ে আসছে এক একটি ঢেউ। সাগর যেনো মিতালী পাকিয়েছে তটের সাথে! কানে কানে বলে যাচ্ছে অনেক না বলা কথা। কী রোমান্টিক এক পরিবেশ, কী লোভনীয় আবহ! আমরা তিন বন্ধু নিজেদের মধ্যে গল্প করে সময়টা জীবনের সেরা স্মৃতিতে পরিণত করছিলাম।

বিচ থেকে পেছনে তাকিয়ে শহরের স্কাইলাইন দেখে ভিতরটা হু হু করে উঠলো। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিচ আমাদের, অথচ এমন একটি স্কাইলাইন আমাদের হয়ে উঠেনি! সাগর পেছনে রেখে আমি শহরের স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আকাশে হেলান দেয়া এক একটি ভবন, অসংখ্য। কাঁচে মোড়া বিল্ডিংগুলোতে শহরের আলো প্রতিফলিত হয়ে যেন নিজস্ব এক আবহ তৈরি করে নিয়েছে। উপরের তলাগুলোর জানালায় হলুদধবল আলো জ্বলে রয়েছে, বিচ থেকে মনে হচ্ছিলো রাতের আকাশে তারা ঝিলিমিলি করছে। একটি সমুদ্রশহরের যতগুলো গুণ থাকা দরকার তার সবই রয়েছে গোল্ডকোস্টে। কী যে সুন্দর! অস্ট্রেলিয়া সরকার গোল্ডকোস্টকে স্বর্ণালি উপকুলে পরিণত করেছে, করেছে পৃথিবীর আরো বহুদেশ। অথচ আমাদের সাগরপাড়ের কোথাও আমরা গোল্ডকোস্ট তো দূরের কথা সিলভারকোস্টও বানাতে পারিনি। পৃথিবীতে সাগরনদীর পাড়কে সবচেয়ে দামি জায়গা বলা হয়, অথচ আমাদের দেশে সাগর কিংবা নদীর পাড়ে জাল শুকানো হয়! আমাদের নদীগুলো দখল হয়, দূষণের কবলে পড়ে। কেউ কেউ নদী দখল করে বালাখানা বানিয়ে নিজেদের পাশাপাশি প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করে নদীর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আমাদের সবাই জানে, কিন্তু কেউ টু শব্দটি করেনা! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূমিকম্পে ভয় নয়, সতর্কতায় থাকতে হয়
পরবর্তী নিবন্ধচর্যাপদ : বাংলার হাজার বছরের ভাষা, দর্শন ও আত্মপরিচয়ের প্রথম দরজা