দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ব্রিজবেনের কুইন্সল্যান্ড মিউজিয়াম কুরিল্‌পায় ডাইনোসরের বিশাল কঙ্কালের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের খুবই অসহায় লাগছিল। কত বড় প্রাণী, কোথায় হারিয়ে গেলো? কিভাবে সম্ভব এমন নিশ্চিহ্ন হওয়া? মানবজাতিও তো একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এতো ক্ষমতা, এতো অহংকার সবইতো একদিন ধুলোয় মিশে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে এই পৃথিবী, ঠিক ডাইনোসরের মতোই সব মুখ থুবড়ে পড়বে!

একসময় মনে হতো ডাইনোসর একটি কল্পনার ফসল, রূপকথা। কিন্তু পরবর্তীতে টুকটাক লেখাপড়া করে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে, ডাইনোসর ছিল। অবশ্য আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না। দুনিয়ার হাজার হাজার বিজ্ঞানী ডাইনোসরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, বড় বড় গবেষণাপত্র লিখেছেন। ডাইনোসর না থাকলে পৃথিবীর হাজার হাজার বিজ্ঞানীই মিথ্যুক হয়ে যেতো। তবে সমস্যা হচ্ছে, ডাইনোসরের যুগ এতো আগে গত হয়েছে যে, সেটির ধারেকাছে যাওয়াও আমাদের মতো মূর্খদের কম্ম নয়। বহু বহু বছর আগে পৃথিবী দাবড়িয়ে বেড়াতো ডাইনোসর। ২০ লক্ষ কোটি বছর আগে থেকে সর্বশেষ ডাইনোসরের অস্থিত্ব ছিল প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি বছর আগে! বিজ্ঞানীরা নানা গবেষনা করে ডাইনোসর যুগের সময়কাল নিশ্চিত করেছেন।

মিউজিয়ামে ডাইনোসরের কঙ্কালের নিচে ছিল জীবাশ্মের প্রদর্শনী, শিলার ভেতর আটকে থাকা দাঁত, গাছের ছাপ, এমনকি প্রাগৈতিহাসিক পোকামাকড়ের ছায়াও। লক্ষ কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর এক জ্বলন্ত দৃশ্য যেনো সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি। আমি নিজেই যেনো কোটি কোটি বছর আগেকার পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি! অন্যধরণের এক রোমাঞ্চ খেলে গেলো শরীরে, মনে! মিউজিয়ামের ভিতরে এক পাশে একটা অ্যানিমেটেড ডিসপ্লেতে ডাইনোসরদের চলাচলের দৃশ্য, শব্দ, আলো, কম্পন সব মিলে মনে হচ্ছিল যেন মাটির নিচ থেকে ওরা সত্যিই উঠে আসছে। কী ভয়ংকর, কী দুর্দান্ত, কী শক্তি এক একটি ডাইনোসরের! ডাইনোসরের গ্যালারির পরের অংশে ঢুকে দেখলাম বর্তমান অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীজগতের এক অসাধারণ প্রদর্শনী। বিশাল কুমিরের মডেল, উড়ন্ত বাদুড়, সাপ, টিকটিকি, কুকাবুরাসব কিছুই এত বাস্তব মনে হচ্ছিল যে, যেনো এখনি উড়াল দেবে। নড়ে উঠবে। একটা অংশে দেখা গেল গ্রেট বেরিয়ার রীফএর ইকোসিস্টেমের রেপ্লিকা। রঙিন মাছ, প্রবাল, সামুদ্রিক কচ্ছপ। মৃদু নীল আলোয় সবকিছু কেমন যেনো স্বপ্নময় হয়ে রয়েছে। পানির নিচের বর্ণিল জগত! মনে হচ্ছিলো, আমি পানির নিচেই ঘুরে বেড়াচ্ছি!

একটি মিউজিয়াম যে কিভাবে সুদূর অতীত এবং বর্তমানের গল্প বলে তা খুব কাছ থেকে দেখলাম। কী দুর্দান্ত আয়োজন! মিউজিয়ামের পরতে পরতেই ছড়িয়ে রয়েছে বিস্ময়! কোন কথা না বলেও এক একটি গ্যালরি কত কথাই না বলে দিচ্ছিলো। আমি ধীরে সুস্থে উপরের ফ্লোরে গেলাম। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাস, আদিবাসী সংস্কৃতি ও ঔপনিবেশিক সময়ের সংগ্রহের এক দারুণ প্রদর্শনি। দেয়ালে আঁকা ছিল নানা চিত্রকর্ম। কী দারুণ সব নকশা! রঙের কী বাহার!

এক কোণে দেখা গেল পুরনো জাহাজের কাঠের টুকরো, যেগুলো দিয়ে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা প্রথম এখানে নেমেছিল। আরেক কোণে পুরনো চিকিৎসা সরঞ্জাম, যেখানে লেখা ছিল ১৮শ’ শতকের ব্রিজবেন। কী সুন্দর করেই না, অতীতকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে আজকের প্রজন্ম বুঝতে পারে, কী অবর্ণনীয় কষ্ট আর ত্যাগেই গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ আধুনিক এবং উন্নত অস্ট্রেলিয়া।

মিউজিয়ামের একটি অংশে গিয়ে বেশ মজা লাগলো। বিজ্ঞানের নানা আবিস্কার নিয়ে মেতে উঠেছে ক্ষুদে শিশু কিশোরের দল। কেউ চৌম্বক বল ঘোরাচ্ছে, কেউ আলো দিয়ে ছায়া তৈরি করছে, কেউ ছোট রোবট চালাচ্ছে। আলো আর আয়না দিয়ে দারুণ একটি ইল্যুশন তৈরি করলো একজন। সে নিজের প্রতিবিম্বকে তিনটা কোণে ঘুরিয়ে দেখছিলো। বেশ মজা পেয়েছে কিশোর। মুখে বলছিলো, একটা আমি, দুইটা আমি, তিনটা আমি!

সময় কম, তবুও ঘন্টা খানেক আমরা মিউজিয়ামে কাটিয়ে দিলাম। নিচতলার ক্যাফেতে বসে কফিও খেলাম। জানালার বাইরে দেখা যাচ্ছে ব্রিসবেন নদী। হাতে গরম কফি। আমার মনজুড়ে তখন ডাইনোসরের পদধ্বনী এবং পানির নিচের রঙিন মাছ যেনো খেলা করছিলো।

ক্যাফে থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না, তবে গোল্ডকোস্ট থেকে ভাগিনী তাবাসসুম এবং সাজ্জাদ আবার সানশাইন কোস্টে ফিরে যাবে ভাবতেই আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করলো না। সাজ্জাদকে বললাম, চলো, এবার যাওয়া যাক। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। এমন একটি মিউজিয়াম না দেখলে সফর অপূর্ণ থাকতো। সাজ্জাদ হাসলো, তাবাসসুমকে টিপ্পনি কেটে বললো, বলছিলাম না, আংকেল পছন্দ করবেন।

সাজ্জাদ জানালো, ব্রিজবেন থেকে গোল্ডকোস্টের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটারের মতো। ট্রাফিক স্বাভাবিক থাকলে এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছানো যাবে। তবে বিকেলে রাস্তায় গাড়ি বেশি থাকে। তাই হয়তো কিছু বাড়তি সময় লাগবে। বহু লোক ব্রিজবেন গোল্ডকোস্ট যাতায়াত করে চাকরি কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য করেন। আবার অনেকেই ব্রিজবেনসানশাইন কোস্টেও রেগুলার যাতায়ত করে অফিস করেন। এখানে দূরত্ব কোন ব্যাপার নয় বলেও সাজ্জাদ মন্তব্য করলো।

মিউজিয়ামের বাইরে একটি জায়গায় আমাদের দাঁড় করিয়ে সাজ্জাদ গাড়ি আনতে গেলো। অল্পক্ষণের মধ্যে সে গাড়ি নিয়ে ফিরে আসলো। আমরা আবারো আগের মতো করে বসলাম। আমার নাতি ইভান ঘুমিয়ে গেছে। তাবাসসুম খুব সুন্দর করে তাকে চাইল্ড কার সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে এক ঘন্টায় আমরা গোল্ডকোস্ট পৌঁছে যাবো। কিছুটা স্বস্তি পেলাম।

পড়ন্ত বিকেলের দারুণ এক আবহে শুরু হলো আমাদের পথচলা। ব্রিজবেন শহরের ভবনগুলোর কাচে খেলা করছে সূর্যের আলো। একটি উজ্জ্বল আভা যেনো চারদিক ভরিয়ে দিয়েছে। কী যে সুন্দর লাগছিলো ব্রিজবেন শহর। সাজ্জাদকে বললাম, ক্রিকেট স্টেডিয়ামটা ঘুরিয়ে তারপর গোল্ডকোস্টের পথ ধরতে। সাজ্জাদ তাই করলো। আমাদের সোনার ছেলেরা দারুণ এই স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলে গেছে।

হাইওয়ে ধরে ছুটছিল আমাদের গাড়ি। কী যে সুন্দর রাস্তা, কী মসৃণ! রাস্তাটি একেবারে সোজা, বেশ চওড়াও। রাস্তার দুইপাশে সবুজের সমারোহ। কত বড় বড় গাছ, দূরে পাহাড়ের সারি! কনে দেখা মিষ্টি আলো যেনো চারপাশে উৎসবে মেতেছে। চমৎকার একটি আবহ, প্রকৃতির রঙের খেলা যেনো এই সোনালী আলোতে নয়া মাত্রা পেয়েছে।

সূর্য ডুবে গেলো পথেই, সন্ধ্যা নামার পর রাস্তার পাশের ভবনগুলোতে আলোর ঝলকানি। আরো কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর সাজ্জাদ বললো, আংকেল আমরা চলে এসেছি। আপনার হোটেলে পৌঁছাতে মিনিট দশেক লাগবে। দূর থেকে গোল্ডকোস্টের সুউচ্চ সব ভবন দেখা যাচ্ছিলো, ভবনগুলোতে যেনো আলোর বান ডেকেছে।

হোটেলের সামনে পৌঁছে সাজ্জাদ বললো, বেশ ভালো জায়গায় হোটেল নিয়েছে। কাছেই সমুদ্র, বীচ। এটা সার্ফার্স প্যারাডাইস। গোল্ডকোস্টের সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। আমি খুশী হলাম। এমন চমৎকার একটি জায়গায় হোটেল দেয়ায় ট্যুর অপারেটরকে ধন্যবাদ দিলাম। তিনি খরচ বাঁচানোর জন্য আরো ভিতরের দিকে গিয়ে হোটেল নিতে পারতেন!

আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে সাজ্জাদ ইউ টার্ণ নিলো। অনেক জোর করলাম, কিন্তু তারা নামলো না। ডিনার করে যেতে বললাম, রাজী হলো না। বললো, আংকেল, অনেক দূর যেতে হবে। রাত বেশি হয়ে যাবে। কথাটি সত্যি, তিনশ’ কিলোমিটার ফিরতি পথ যেতে হবে। গাড়ি চালিয়ে এতোদূর আসা এবং ফিরতি পথে একই দূরত্বে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটি উন্নত দেশ বলেই সম্ভব হচ্ছে। আমাদের মতো দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় তিনশ’ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে আসার পর অন্তত একদিন বিশ্রাম নিতে হবে। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিবন্ধীদের জীবন হোক সুন্দর কর্মময়
পরবর্তী নিবন্ধমাদারবাড়ী শোভনীয়া ফুটবল একাডেমির সভা