(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রাত কেটে গেলো ঘুমে। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হলো আজই মেলবোর্নকে গুডবাই জানাতে হবে। পৃথিবীর অন্যতম সেরা বাসযোগ্য দারুণ এই শহরটি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। চোখের সামনে ভাসছে চার থেকে চৌদ্দ লেনের রাজপথ, অলি গলি। শহরজুড়ে দারুণ সব আয়োজন, নাগরিক সুবিধার নানা উপকরণ। যা এ ক’দিনে আমরা চষে বেড়িয়েছি। কী যে সুন্দর এক একটি রাস্তা, কী যে সুন্দর রাস্তার আশপাশ! প্রতিটি ফুটপাত যেনো শুয়ে বসে গল্প করার জায়গা! কী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন! রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ, পাতাও ঝরছে। কিন্তু কোথাও ফুটপাতে পচা পাতার ভাগাড় হয়ে উঠেনি। অবশ্য এই শহরের বাসিন্দাদের ফুটপাতে বসার কোন প্রয়োজন পড়ে না, শহরটির হেথায় হোথায় এতো বেশি পার্ক এবং বিচ রয়েছে যে, একটু মন উদাস লাগলে কোন একটিতে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেই হলো। ছায়া ঢাকা, পাখী ডাকা এক অনন্য সুন্দর নগর, নগরজীবন। শহরটিতে আরো কয়েকদিন বেড়াতে পারলে ভালো হতো, সমৃদ্ধ হতাম। থাকা এবং বেড়ানোর সুযোগ ছিল, ঘুরিয়ে দেখানোর মতো লোকজনও ছিল। তাদের আবদারও ছিল। কারো কারো সাথে দেখাটাও করতে পারিনি। কিন্তু আমারই থাকার কোন উপায় নেই, আজই যেতে হবে।
আমাদের ট্যুর অপারেটর অস্ট্রেলিয়ার আরো কয়েকটি শহর ও নানা অঞ্চলে ঘোরাঘুরির প্ল্যান করেছেন। সেভাবেই বিমানের টিকেট, হোটেল বুকিংসহ নানা আয়োজনের সবকিছুই আগেভাগে করে রাখা হয়েছে। এখন মেলবোর্ন না ছাড়লে ট্যুর প্ল্যানের তেরোটা বেজে যাবে!
অতএব ব্যাগ গোছাতে হবে। স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে আমাদের ফ্লাইট দুপুরে। দুপুরে ফ্লাইট হলে আচ্ছামতো ঘুম দিয়ে হোটেল থেকে নাস্তা সেরে রয়ে সয়ে বিমানবন্দরের পথ ধরলে চলে। যদি ভোরে বা সাতসকালে ফ্লাইট হতো তাহলে শুধু নাস্তারই নয়, ঘুমেরও বারোটা বেজে যেতো।
নাস্তা করতে যাওয়ার আগে আমি ব্যাগটি গুছিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্যাগ মানেই চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে যাওয়া জামা কাপড়ের তল্পিতল্পা। মিনিট দশেকের মধ্যেই কাজটি হয়ে গেলো। এখন নাস্তার পর ট্যুর অপারেটরের ডাক পেলেই সাথে সাথেই বাসে চড়া যাবে।
লায়ন ফজলে করিম চৌধুরী, ডালিয়া ভাবী এবং লায়ন বিজয় শেখর দাসকে সাথে নিয়ে নাস্তা করতে গেলাম। ফজলে করিম ভাই শুধু ভাবীকে নেন নি, সাথে ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়েও নিচে নামলেন। রিসিপশনের পাশেই রেস্টুরেন্ট, তিনি লাগেজগুলো রিসিপশনে একপাশে রেখে রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। তার যুক্তি, রেস্টুরেন্ট যেহেতু নিচতলায় তাহলে সেখান থেকে আবার উপরে আসার দরকার কি? নাস্তা সেরে বাস আসলে চড়ে বসবো। কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমার রুমমেট বিজয় দা’ বললেন, কী দরকার এতো হুড়োহুড়ি করার! বাস আসার আগ পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করবো। এই কথায়ও যুক্তি আছে। স্বাভাবিকভাবে আমার রুমমেটের যুক্তির সাথে একাত্ম হয়ে বাসমেট হিসেবেও তার সঙ্গে থাকতে হলো।
আমাদের বাস চলে এসেছে। এখানে বাসে কোন সহকারী নেই। চালক আর যাত্রীরাই সব কাজ করেন। আমরা ড্রাইভারের সাথে ধরাধরি করে সবার লাগেজ বাসের পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বাস চলতে শুরু করেছে। বিশাল বাস, যাত্রী মাত্র কয়েকজন। পুরো বাসটিই আমাদের ট্যুর অপারেটরের রিজার্ভ করা, অন্য লোকের এই বাসে চড়ার সুযোগ নেই। লোকজন কমে যাওয়ার ব্যাপারে জানলাম যে, আমাদের সাথে মেলবোর্নে লায়ন্স কনফারেন্সে আসা ঢাকার লায়ন সদস্যদের কেউ কেউ মেলবোর্ন রয়ে গেছেন। তাদের কারো সন্তান আবার কারোবা ঘনিষ্ট আত্মীয় এখানে থাকেন। স্বজনদের সাথে দিনকয়েক কাটিয়ে তারা মেলবোর্ন থেকেই ঢাকা ফিরে যাবেন। এতে করে বাসটি প্রায় ফাঁকা। দুই সিট নিয়ে বসে আছেন কেউ কেউ। আমি এবং বিজয় দা’ গল্প করার জন্য পাশাপাশি সিটে বসেছি, আমাদের বিপরীত পাশের দুই সিটে করিম ভাই এবং ভাবী।
বাস চলছে। শহরের বুক ছিঁড়ে বয়ে যাওয়া বিশাল রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি আমরা। রাস্তার দু’পাশে সুউচ্চ সব ভবন, প্রচুর গাছগাছালি। ফুটপাতের পাশে গাছের ছায়ায় বসার জন্য বেঞ্চ। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখলাম না। না পথচারী, না আয়েশকারী। রাস্তায় গাড়ি না থাকলে পুরো দেশটিকে জনশূণ্য মনে করা অস্বাভাবিক ছিল না।
শহর থেকে বিমানবন্দরের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার, উত্তরপশ্চিমে। রাস্তায় কোন ট্রাফিক জটে না পড়ায় আমরা বেশ দ্রুতই বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। প্রচুর যাত্রী। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এই বিমানবন্দরে হরদম যাত্রী আসা যাওয়া করছেন। বছরে প্রায় চার কোটি মানুষ কোন না কোন গন্তব্যে যাতায়াত করতে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। এটি অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। সিডনির পর মেলবোর্নই অস্ট্রেলিয়ার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এই বিমানবন্দর থেকে আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপ এবং ওশেনিয়ার দেশগুলোর সাথে সরাসরি বিমান চলাচল রয়েছে। বিমানবন্দরটিতে চারটি টার্মিনাল রয়েছে। রয়েছে দুইটি রানওয়ে। তৃতীয় রানওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। এই বিমানবন্দর দিয়ে হরদম বিমান আকাশে ওঠে, নামে। এতো যাত্রী হ্যান্ডলিং করলেও বিমানবন্দরটি অস্বাভাবিক রকমের চকচকে,ঝকঝকে। এতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে আমার একই সাথে মন ভালো এবং খারাপ হয়ে গেলো!
আমরা ডোমেস্টিক ফ্লাইটের যাত্রী। তাই ঝামেলাও কম। বিমান ছাড়ার ঘন্টা খানেক আগে বিমানবন্দরে পৌঁছালেই হতো। কিন্তু আমরা কিছুটা আগে চলে এসেছি বলে মনে হলো। আগে আসায় লাভ হলো যে, বড় কোন লাইনের জটলায় পড়ার আগেই আমাদের বোর্ডিং হয়ে গেলো। তবে বিমান ছাড়তে বেশ দেরি আছে। কোথাও বসে অপেক্ষা করতে হবে। বিজয় দা বললেন, লাউঞ্জে চলেন, কিছু খাওয়া দাওয়া করা যাবে, সময়ও কেটে যাবে। প্রস্তাবটি পছন্দ হলো। আমরা যার কাছে যে যে ব্যাংকের কার্ড আছে, যেটি এখানে কার্যকর সেটি খুঁজে বের করে লাউঞ্জের পথ ধরলাম। ঘন্টা খানেক পর লাউঞ্জের ডিজিটাল স্ক্রিনে আমাদের ফ্লাইট নম্বর এবং গেট নম্বর দিয়ে বিমানে চড়ার ঘোষণা প্রদর্শিত হচ্ছিলো। লাউঞ্জে আড্ডা বেশ জমে উঠলেও মাঝপথে আমাদেরকে বিমানে চড়ার জন্য আসর ভাঙ্গতে হলো। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে নির্দিষ্ট গেটের দিকে যাত্রা করলাম।
ডোমেস্টিক ফ্লাইট হলেও বেশ বড়সড় একটি বোয়িং। আসনবিন্যাসও ভালো। লেগস্পেস সন্তোষজনক। টাকা কামানোর জন্য গাদাগাদি করে সিট বসানো হয়নি, ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীদেরও কিছুটা শ্বাস নেয়ার, পা ছড়িয়ে বসার মতো জায়গা দেয়া হয়েছে।
আমাদের গন্তব্য গোল্ড কোস্ট। অস্ট্রেলিয়ার অতি চমৎকার এবং পর্যটন নগরী। নামটিই বেশ রোমান্টিক। সাগরপাড়ের শহরটির ব্যাপারে অনেক কিছুই আগে শুনেছিলাম। এবার সরাসরি দেখতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় মন–মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল।
মেলবোর্ন থেকে গোল্ড কোস্টের আকাশপথের যাত্রা স্বাভাবিকভাবে আড়াই ঘন্টার মতো। তবে ফ্লাইটের আকার এবং আবহাওয়া পরিস্থিতির উপর এই সময় কিছুটা এদিক ওদিক হয়ে থাকে। ফ্লাইটের আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন মেনে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ডেমো দেখিয়ে বোয়িংটি চলতে শুরু করলো। বলে রাখা ভালো যে, আমি উইন্ডো সিটে বসেছি। তাই বাইরে চোখ রেখে বিমানবন্দর দেখতে লাগলাম। টার্মিনাল ভবনটি দারুণ, ডিজাইনে নান্দনিকতা রয়েছে, কাচগুলো চকচক করছে। বাইরে সারি সারি এয়ারক্রাফটের কাফেলা! আহা, কত বিমান এদের!
ফ্লাইট আকাশে ওঠার কয়েক মিনিটের মধ্যেই শহরের আকাশচুম্বী ভবন ও আশপাশের সবুজ বিস্তৃতি চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিলো। কী সুন্দর শহর! মেলবোর্নের আকাশ একেবারে স্বচ্ছ, নীল। ফ্লাইট থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে উপকূলের অনন্য সুন্দর বিচ, ভিক্টোরিয়ার সমতলভূমি, খামার এলাকা এবং দূরের পাহাড়ি অঞ্চল সবই দেখা যাচ্ছিলো।
নীল আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ভেলা, উড়ে উড়ে যাচ্ছিলো। আমাদের বিমানটিও কখনো কখনো মেঘের ভিতর ঢুকে পড়ছিল, কখনো মেঘ ফুটো করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।
ঘড়ির কাটা বলছিলো, আমরা গন্তব্যের কাছাকাছিতে পৌঁছে গেছি। টের পেলাম যে বিমানও আস্তে আস্তে নিচে নামছে। কেবিন ক্রুও ঘোষণা দিলেন যে, অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা গোল্ড কোস্টে অবতরণ করবো।
আমি জানালায় চোখ দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সমুদ্রের নীল জলরাশি, চিকচিক করা বিচলাইন আর উঁচু বিল্ডিংয়ের সারি চোখে পড়লো। কী যে সুন্দর সাগর, পুরো দরিয়া যেনো নীল হয়ে আছে! বিচের সাদা বালুকাবেলা আর দিগন্তজুড়ে থাকা সবুজ অন্তরে নাচন ধরালো। এটাই তাহলে গোল্ড কোস্ট, স্বর্ণালী উপকুল বা সোনার তীর!
আমাদের বিমান একেবারে নিচে নেমে আসছিল। মনে হচ্ছিলো বিমানটি নীল সাগরের বুকে নামতে যাচ্ছে। ফেনা উঁচিয়ে উপকুলে আছড়ে পড়া সাদাটে ঢেউগুলো যেনো আমাদের হাতছানী দিচ্ছিলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।








