(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বেশ রাতে হোটেলে ফিরলাম। মেলবোর্ন শহরেও মনে হচ্ছিলো সোডিয়াম লাইটের আলোর চেয়ে চাঁদের আলো বেশি ঝলমল করছে। মাথার উপরে চাঁদ, নীল আকাশ। ভবনে ভবনে আলোর ঝলকানি। দুর্দান্ত এক রোমান্টিক আবহ চারদিকে। রাস্তায় গাড়ি চলাচল কমে এসেছে। শহরে যে মানুষ পায়ে হাঁটে, যাদের আমরা পথচারী বলি– তেমন কাউকে দেখছিলাম না। চারদিকে সুনসান। লবিতে কয়েকজন লায়ন সদস্য আড্ডা মারছিলেন। আমরাও সামিল হয়ে গেলাম। লানন্স কনফারেন্সের আসল মজাটাই এই আড্ডা। কত ধরণের গল্প যে হয়!
বেশ রাত করে রুমে ফিরলাম। আমার রুমমেট লায়ন বিজয় শেখর দাশ কফি নিলেন না, আমি ধুমায়িত এক মগ কফি করে নিলাম। কল বেল বাজছিল, দরোজা খুলে দেখি লায়ন ফজলে করিম ভাই। ভাবীকে রুমে একা রেখে তিনি চলে এসেছেন আমাদের রুমে। কফি অফার করলাম। বললেন, এতো রাতে কফি খেলে নাকি ঘুম আসবে না। অথচ কফি না খেলেই আমার ঘুম ধরে না! ফজলে করিম ভাই জানালেন, সকালে কয়েকজন লায়ন সদস্য অনেক দূরে কি একটি দেখতে যাবেন। ওনারা গাড়ি ভাড়া করেছেন। চাইলে আমরাও যেতে পারি।
লাফিয়ে উঠলাম। যাবো মানে, অবশ্যই যাবো।
আমার খুব মনে পড়ছিলো আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে। স্যারের সাথে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছি। এই ধরনের অনেক লায়ন্স কনফারেন্সে স্যারের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছি দুনিয়ার নানাদেশ। স্যারের কোন গুণ না আমি অর্জন করতে না পারলেও একটি শিক্ষা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছি। স্যার তাইওয়ানে বিমান বন্দরে যাওয়ার ঘন্টা দুয়েক আগে আমাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলেন দারুণ একটি যাদুঘরে। আমার পরাণ টিপটিপ করছিলো। কিন্তু স্যারকে কিছু বলতে পারছিলাম না। যদি জাপানের ফ্লাইট মিস করি! আমার অসহায় ভাব দেখে স্যার বললেন, আরো চিন্তা করো না। ঠিক সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে যাবো। এখানে রাস্তায় ট্রাফিক সিস্টেম আছে, সবকিছু ঘড়ি ধরে চলে। কোন সমস্যা হবে না। স্যার আমাকে ওইদিন বলেছিলেন, যেখানেই যাও কিছু কষ্ট বা খরচ হলেও ধারে কাছে যদি দেখার মতো কিছু থাকে তাহলে তা অবশ্যই দেখে আসবে। কারণ জীবনে তুমি দ্বিতীয় বার ওখানে আর যাওয়ার সুযোগ নাও পেতে পারো।
স্যারের কথাটি বেশ মনে ধরেছিল আমার। তাই যেখানে যাই না কেন, ধারে কাছে কিছু থাকলে দেখে আসি। তাই ট্যুর প্রোগ্রামে না থাকলেও অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন একটি জায়গা দেখার সুযোগের কথা শুনে আমি রাজি হয়ে গেলাম। রাজি হলেন বিজয় দা’ও। কোথায় যাচ্ছি সেটা না জানলেও আমরা প্রোগ্রাম করে নিলাম যে , ভোর ছয়টায় গাড়িতে চড়বো।
ওয়েক আপ কল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। মোবাইলেও এলার্ম দিলাম। যাতে গোলমাল না হয়।
ঘুম ভেঙ্গে গেলো। লায়ন ফজলে করিম ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। বিজয় দা’সহ নিচে নেমে আসলাম। আরো কয়েকজন লায়ন সদস্য অপেক্ষা করছেন। আমাদের নেয়ার জন্য একটি মাইক্রোবাস আসবে। মিনিট কয়েকের মধ্যে গাড়ি এসে হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। অস্ট্রেলিয়ান ড্রাইভার আমাদেরকে গাড়ির উঠার তাড়া দিলেন। বললেন, এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। পুলিশ দেখলে মামলা দিয়ে দেবে।
আমরা তড়িঘড়ি করে সবাই গাড়িতে চড়ে বসলাম। ঢাকার একজন লায়ন সদস্য দলনেতা। তার কাছ থেকে জানলাম যে, আমরা যাচ্ছি মেলবোর্ন শহর থেকে প্রায় পৌনে তিন’শ কিলোমিটার দূরে। আসা যাওয়ায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটার!! ভিতরে ভিতরে কিছুটা ভড়কে গেলাম। এতো দূর যাবো!!
দলনেতা বললেন, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটার নাম গ্রেট ওশান রোড। মেলবোর্নের অন্যতম পর্যটন স্পট। এটা না দেখলে নাকি অস্ট্রেলিয়া দেখাই বৃথা।
নামেই বুঝা যাচ্ছে যে, এটি একটি রাস্তা। একটি রাস্তা কি করে পর্যটন স্পট হয় বুঝতে পারছিলাম না। রাস্তাটি নাকি যুদ্ধ ফেরত সৈনিকেরা বানিয়েছেন। তাও আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা অস্ট্রেলিয়ান সৈনিকেরা। ১৯১৯ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রায় চৌদ্দ বছর সময় ধরে ৩ হাজার সৈনিক রাস্তাটিতে শ্রম ও ঘাম ঢেলে দিয়েছেন। রাস্তাটিকে মেলবোর্নের স্বর্গ বলা হয়। দুনিয়ার সেরা মেরিন ড্রাইভ এবং পৃথিবীর অন্যতম একটি ভয়ংকর সুন্দর রাস্তা হিসেবেও চিহ্নিত গ্রেট ওশন রোড। এটি প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ। টর্কি থেকে অ্যালান্সফোর্ড পর্যন্ত। এই রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে যুদ্ধাহত সৈনিকদের কর্মসংস্থান প্রদান এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণে একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। রাস্তাটি ভিক্টোরিয়া রাজ্যের দক্ষিণ–পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এবং এটি বিশ্বের বৃহত্তম যুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে পরিচিত।
রাস্তাটি সমুদ্রের পাশে পাহাড়ি অঞ্চলে তৈরি, রাস্তার দু’পাশের অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পুরো পথটিই নাকি ভরপুর। অস্ট্রেলিয়ানেরা এই রাস্তাটিকে শুধু একটি রাস্তা হিসেবে বিবেচনা করে না, তারা মনে করে এটি তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতির অংশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার।
আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। শহরের ব্যস্ততা আর গগনচুম্বী ভবন পেছনে ফেলে আমরা চলছিলাম এক অজানা রাস্তা দেখতে। শহর পেছনে ফেলে কিছু পথ এগুতেই আমরা সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। গাড়ির এসি বন্ধ করে দিয়ে কাচ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ভেসে আসছে হাওয়ার শব্দ। শোনা যাচ্ছে ঢেউয়ের গর্জন। অদ্ভুদ সুন্দর একটি আবহ, পরিবেশ। কখনো রাস্তার পাশে বিশাল উঁচু পাহাড়, আবার কখনো দিগন্ত বিস্তৃত মহাসাগর। এটিই গ্রেট ওশান রোড। একটি রাস্তা যে কী করে এমন সুন্দর হয় তা চোখে না দেখলে লিখে বুঝানো অসম্ভব। রাস্তা ধরে এগুচ্ছি, পাশে আছড়ে পড়ছে মহাসাগরের ঢেউ। কখনো আবার রাস্তার পাশেই ঘন অরণ্য, সবুজ চাদরে মোড়া দশদিক। দুপাশের বিশাল বিশাল গাছগুলো পুরো রাস্তাটিকে ঢেকে রেখেছে। আলো ছায়ার মোহনীয় খেলা চলছে রাস্তাজুড়ে।
আমাদের গাড়ি ছুটছিল। রাস্তায় অনেক গাড়ি। বিপুল গতিতে ছুটছে গাড়িগুলো। আমরা নানাস্থানে থামলাম। মহাসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে, কখনো সুউচ্চ পাহাড় পেছনে রেখে ছবি তুললাম। একটু আধটু ঘুরেফিরেও দেখলাম।
দুপুর গড়াতে শুরু করেছে। আমরা পৌঁছে গেলাম গ্রেট ওটওয়ে ন্যাশনাল পার্কে। গ্রেট ওশান রোডের পাশেই অস্ট্রেলিয়ার অনন্য সুন্দর এই ন্যাশনাল পার্ক। যত দূর চোখ যাচ্ছিলো শুধু অরণ্য, সবুজ আর সবুজ। এক একটি গাছ যে কত উঁচু মাথা বাঁকা করে দেখতে হচ্ছিলো। গাছের মাথায় কোকাবুরা ডাকছে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো যেনো সোনালী আভা ছড়াচ্ছে। আমরা হাঁটলাম ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে। ছোট ছোট ঝরনা, পাখির ডাক, আর আমাদের পদচিহ্নে ভেজা মাটি। পথের শেষে এসে দেখি এক জলপ্রপাত। আমরা চুপ করে তাকিয়ে রইলাম জলের ধারায়। চমৎকার ছন্দে পানি পড়ছিল। বেশ উঁচু থেকে পানি পড়ছিলো পাথরে। অদ্ভুদ শব্দ হচ্ছিলো। ঘন অরণ্যের মাঝে ঝর্ণার এই গান যেনো পৃথিবীর সেরা কোন মেলোডি! অনেকক্ষণ বনের ভিতরে হাঁটলাম। ভয়ও লাগছিলো। হিংস্র প্রাণী আছে কিনা কে জানে, সাপ খোপও অবশ্যই থাকবে। তাই অতি সাবধানে পা ফেলছিলাম।
গ্রেট ওশান রোডের পাশে থাকায় আমরা ঘুরে ফেললাম অ্যাঙ্গেল সি সমুদ্রসৈকত ও এ্যাপেলো বে। বিকেল গড়াতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলে পৌঁছালাম অনন্য সুন্দর আরেকটি ট্যুরিস্ট স্পট টুয়েলভ অ্যাপস্টলসে। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে ভারত মহাসাগরের তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতেও টিকে থাকা অনন্য আকর্ষণীয় স্থান এই টুয়েলভ অ্যাপস্টলস। সূর্য তখন পেছনে হেলে পড়েছে, আর মহাসাগরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা চুনাপাথরের সেই বিশাল স্তম্ভগুলোর গায়ে পড়ছে লাল–কমলা আলো। কী যে সুন্দর লাগছিলো! মনে হচ্ছিল, এ দৃশ্য শুধু চোখে দেখার নয়, এটি হৃদয় দিয়ে অনুভব করার।
মন ভরে সবকিছু দেখলাম। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সফর এতো সুন্দর হবে তা দেশে থাকতে কল্পনাও করিনি। আমাদের গাড়ি ফিরতি পথে ছুটছে। প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কিলোমিটার জার্ণির ধকল শরীরের উপর দিয়ে গেছে। তবে দিনশেষে রাতে ফিরতি পথে মনে হয়েছে, আজকের দেখাটা না দেখে মেলবোর্ন ছাড়লে এক জীবনের আফসোস থেকে যেতো। ভোরে যাত্রা শুরু করে রাতে রুমে ফিরে পুরো দিনজুড়ে যা কিছু দেখলাম, সবশেষে আমার মনে মনে হলো, এমন নৈসর্গ্যের লালন করতে যোগ্যতা লাগে! (চলবে)
লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।