(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
মেলবোর্ন শহরের ট্রামে চড়ছি। মাগনা। কোন টিকেট ফিকেটের ঝামেলা নেই। ফ্রি ট্রাম। সন্ধ্যার পরে বেজায় ভিড়। আমাদের লোকাল বাসের অবস্থা। তবে কোন ধাক্কাধাক্কি নেই, নেই হুড়োহুড়ি। ভদ্রলোকেরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। স্টপেজে নেমে পড়ছেন, নতুন কেউ উঠে নিজের মতো জায়গা করে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন। যারা সিটে বসেছে তাদের অনেকেই বই পড়ছেন। কেউ কেউ মোবাইল টিপছেন।
শুরু থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আরো তিন স্টপেজ পরেই আমার গন্তব্য। ট্রামের স্ক্রিনে স্টপেজের নাম দেখা যাচ্ছে। আমার হোটেলের কাছেই ট্রাম থেকে নামলাম। হোটেলের রিসিপশনে প্রবেশ করতেই সামনে পড়ে গেলাম ফজলে করিম এবং বিজয় শেখর দাশের। কোথায় চলে গেছি তা নিয়ে দুজনেই উষ্মা প্রকাশ করলেন। বাকিরা সবাই ডিনার করতে গেছেন, ওনারা যাননি। ডালিয়া ভাবী রুমে, ওনারা রিসিপশনে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার মেলবোর্ন ভ্রমণের ছোটখাটো কাহিনী বলার পর দু’জনই অভিমান করলেন। তাদের রেখে চলে যাওয়া একদম ঠিক হয়নি বলেও রাগ দেখালেন। ঘুমুচ্ছিলেন বলার পর মনে হয় আরো ক্ষেপে গেলেন! আমরা কি ঘুমাতে এখানে এসেছি। বেশ কড়া করে বললেন, আমাদের নিয়ে চলেন। আমরাও দেখবো।
আমার মগজে দুষ্টু একটি বুদ্ধি খেলে গেলো। দিনের সবকিছু দেখে এসেছি, এখন গিয়ে তো রাতের সবকিছু দেখা যায়। ফ্রি ট্রাম, একটু ভিড়ভাট্টা হলেও যাওয়া আসায় কোন সমস্যা হবে না। আমরা তিনজন আবারো পথে নামলাম।
ট্রাম স্টপেজে দাঁড়িয়েছি। ৪ মিনিট পর ট্রাম আসবে। আবহাওয়া বেশ সুন্দর, ঝকঝকে। স্বচ্চ নীলাকাশে তারার মেলা, শীত শীত আবহ। ভবনে ভবনে আলোর ঝলকানি। সবকিছু মিলে দিনের চেয়ে রাতের মেলবোর্নকে বেশি রূপবর্তী মনে হচ্ছিলো।
ট্রামে চড়লাম। ভিড় আছে। সিট না পেয়ে আমরা তিনজনই দাঁড়িয়ে থাকলাম। বিনে পয়সার ট্রাম, সিট আর দাঁড়ানো নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কই! পুরনো ধাঁচের সবুজ–হলুদ ট্রামগুলো ইতোমধ্যে আলোকিত হয়ে ওঠেছে। ট্রামের ভেতরে দাঁড়িয়ে জানালার বাইরে তাকালেই চোখে যা পড়ছে তার সবই ঝলমলে। শহরের রাস্তায় আলোয় মোড়া গাছ, রঙিন বিলবোর্ড, ফুটপাত ধরে পথ চলা সুখী সুখী নারী পুরুষ।
মেলবোর্নের ট্রাম বেশ বিখ্যাত, অনেকটা লন্ডনের লালবাসের মতো। এই ট্রাম মেলবোর্নের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অংশ। এই শহরে দলে দলে মানুষ ট্রামে চড়ে, নানা গন্তব্যে যাতায়াত করেন। এখনো অনেক যাত্রী। কেউ যাচ্ছেন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে, কেউ সিনেমা দেখতে, কেউবা শুধু রাতটা উপভোগ করার জন্য বের হয়েছেন। যেমন আমরা। ট্রাম থেমে থেমে চলছিল, আর আমরা দেখছিলাম এক মোহনীয় পরিবেশ! উজ্জ্বল উচ্ছ্বল এক শহর। অনেকটা জাদুর শহরের মতো।
সন্ধ্যার সময় ইয়ারা নদীর পাড়ে যেমন মোহনীয় আবহ তৈরি হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে পুরো শহর জুড়ে রঙের খেলা। পৃথিবীর বহু শহরই সন্ধ্যা নামার পর ক্রমে নিরব হয়ে যায়, অথচ মেলবোর্নে মনে হচ্ছে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর শহরটির ঘুম ভেঙেছে।
ফেডারেশন স্কয়ারে গিয়ে আমরা ট্রাম থেকে নেমে পড়লাম। দিনের দেখা ফেডারেশন স্কয়ারের সাথে রাতের স্কয়ারের পার্থক্য বিস্তর। বর্ণিল এক আবহ চারদিকে। আলোর খেলা যে কী পরিমাণ মোহনীয় হতে পারে তা চোখে না দেখলে লিখে বুঝানো কঠিন। স্কয়ারজুড়ে যেনো চলছে প্রাণের মেলা।
ফেডারেশন স্কয়ারে বিশাল স্ক্রিনে মনে হয় সিনেমা চলছে। চলছে বিজ্ঞাপনও। বিজ্ঞাপনচিত্রের সাথে সাথে আলোর রঙও পাল্টে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে চত্বরের রংও। চারপাশে রাস্তায় বসে আছে অসংখ্য নারী পুরুষ। কেউ এসেছে পরিবার পরিজন নিয়ে, কেউবা প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে। আমরা তিন বন্ধুও বসে পড়লাম আরো অনেক পর্যটকের গা ঘেঁষে। মনে হচ্ছিলো, এরা সবাই মেলবোর্নের রাত উপভোগ করতেই ঘর ছেড়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যে একদল শিল্পী রাস্তায় এসে শুরু করলো নাচ। তুমুল নাচ। পর্যটকরা তাদের চারপাশে জড়ো হয়ে হাততালি দিচ্ছে। সবার চোখই উজ্জ্বল, যেনো এমন মজার কান্ড কালেভদ্রেই ঘটে!
স্কয়ারের পাশেই ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশন, যেটি আমি দিনের বেলায় দেখে গেছি। রাতের বেলায় স্টেশন ভবনের হলুদ আলো ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে, ভবনটি যেনো মেলবোর্নের ল্যান্ডমার্ক, ঘড়ির টাওয়ারটি যেনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করার পর ইয়ারা নদীর কথা বললাম। সাথের দুজনকে জানালাম যে, পাশেই নদী। চলেন, ওখানে গিয়ে কফি খাবো।
ইয়ারা নদীর পাড়ে আমি সন্ধ্যা কাটিয়ে গেছি। সন্ধ্যার সাথে রাতের তেমন পার্থক্য না থাকলেও মনে হচ্ছিলো আলোর তীব্রতা এবং ভিড় বেড়েছে। নদীর ধারে সাজানো কফি শপ, রেস্তোরাঁ আর ওয়াইন বারগুলোতে অন্যরকমের জয়গান চলছে। নদীর পাড়ে গিটার বাজিয়ে গান গাচ্ছেন অনেকেই। দূর থেকে ভেসে আসছে স্যাক্সোফোনের সুর। মনে হচ্ছে নদীর পাড়ে যেনো চলছে বিশাল কোন কনসার্ট!
বাংলায় কথা বলছিলেন দু’যুবক। বাড়ি কোথায় জানতে চাইলাম এবং অবশ্যই বাংলায়। দুই যুবক বেশ খুলী হলো। বললো, বিক্রমপুর। আমরা নিজেদের পরিচয় দিলাম। বেড়াতে মেলবোর্ন যাওয়ার কথাও বললাম। যুবকেরা আমাদেরকে ভিক্টোরিয়া নাইট মার্কেট ঘুরে আসার পরামর্শ দিলেন। ফেডারেশন স্কয়ার থেকে দেড় কিলোমিটারের মতো দূরে। হেঁটে গেলে মিনিট দশেক লাগবে বলেও জানালো তারা। আমরা শহর দেখতে বের হয়েছি, রাতের শহর। সুতরাং, দশ বিশ মিনিট নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি!
শীত শীত আবহের মাঝে হাঁটতে দারুণ লাগছিল। রাস্তার দুপাশে শত শত দোকানে নানা পণ্যের পসরা। সুউচ্চ ভবনগুলোতে আলোর ঝলকানি। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, তবে কিছু পর্যটক হাঁটছেও। নারী পুরুষ, যুবক যুবতী যে যার মতো সাজানো ফুটপাত ধরে হাঁটছে। রিকশার ধাক্কা নেই, হকারের যন্ত্রনা নেই। ফুটপাতের মাঝে মাঝে গাছ, বাগান। গাছের গতরজুড়ে আলোর ঝলক।
কুইন ভিক্টোরিয়া নাইট মার্কেটে পৌঁছে মনে হলো কোন এক ভোজন উৎসবে এসে সামিল হয়েছি। রকমারি খাবারের গন্ধে আমাদের ক্ষুধা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। এটা কি নাইট মার্কেট নাকি ইন্টারন্যাশনাল কোন শো। শত শত নারী পুরুষ, নানা দেশের, নানা জাতের, নানা রঙের এবং অবশ্যই নানা ঢঙ্গের।
তুর্কি কাবাব, ইতালিয়ান পিজ্জা, জাপানি সুশি, থাই নুডলস, ভারতীয় কাবাব কারিসহ নানা খাবারের দোকান। আমরা একটি স্টলে বসে ভেজিটেবল পিৎজা এবং হট চকলেট নিলাম। খেতে গিয়ে মনে হলো, পছন্দ খারাপ করিনি।
শুধু খাবারই নয়, নাইট মার্কেটে হাতের কাজের গয়না, রকমারি ছবি, হরেক রকমের পোশাক, নানা ধরনের অলংকারসহ পর্যটকদের জন্য কুইন ভিক্টোরিয়া নাইট মার্কেট যেনো এক স্বর্গবাজার। এখানেও শিল্পীরা লাইভে গান করছিলেন। একটি শব্দও বুঝতে পারছিলাম না। তবে ছন্দগুলো যেনো পরিচিত। গান না বুঝলেও নাইট মার্কেটের গানের ছন্দে আমার ভিতরে দোলা দিচ্ছিলো। সপ্তাহে একদিন নাকি এই বাজার বসে। ভাগ্য ভালো বলেই মেলবোর্নে আসার প্রথম দিনেই নাইট মার্কেটের এলাহী কারবার দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার মেলবোর্ন প্রবাসী এক বন্ধুপুত্র ফোন করে খবর নিতে গিয়ে জানলো যে আমি নাইট মার্কেটে। বললো, কাছেই ইউরেকা টাওয়ার এবং চায়না টাউন। যেনো ঘুরে দেখি। বহু টাওয়ারে চড়েছি। তাই ইউরেকা টাওয়ার নিয়ে খুব বেশি আগ্রহের সৃষ্টি হলো না। কিন্তু আমার বন্ধুপুত্র বললো, ইউরেকা টাওয়ার না দেখে মেলবোর্ন ছাড়লে খারাপ লাগবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, টাওয়ার এখনো খোলা আছে। রাত দশটায় বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা একটি গাড়ি নিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ইউরেকা টাওয়ারে পৌঁছে গেলাম।
৮৮ তলার উপরে স্কাইডেক। কিন্তু ওখানে যেতে হলে ৩০ ডলারের টিকেট কিনতে হবে। এতোদূর এসে কি ৩০ ডলারের চিন্তা করার সুযোগ আছে? পকেট হাতড়ে বের করলাম অস্ট্রেলিয়ান টাকা। গুনে গুনে শোধ করলাম। বুকের ভিতরে খচখচ করছিল। এক টাকা মানে আমাদের ৮২ টাকা! কিন্তু উপায়ও তো নেই। মেলবোর্নে এসে ইউরেকা না দেখে যাওয়া আসলেই ঠিক হবে না। উঠে গেলাম ৮৮ তলার উপরে, স্কাইডেকে। নিচের দিকে তাকাতে গিয়ে মাথা কী হালকা একটু চক্কর দিলো! নিমিষে সয়ে নিলাম। আহ্, কী যে সুন্দর। পুরো মেলবোর্ন শহর আমার চোখের সামনে। শহরজুড়ে যেনো তারার ঝিলিক, আলোর বন্যা। রাস্তাগুলোকে সর্পিল, অন্যরকমের সর্পিল একটি আলো শহরজুড়ে। রাস্তার গাড়িগুলোকে মনে হচ্ছিলো খেলনা, গাছগাছালীকে মনে হচ্ছিলো কারো ছায়া। ইয়ারা নদী ঠিক যেনো একটি রুপালি ফিতা, পুরো শহরটিকে যেনো আলতো করে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। (চলবে)
লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।