(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি। কয়েকদিনের টানা জার্নিতে শরীর মুড়ির মতো মুড়মুড়ে হয়ে আছে। কখন যে ভেঙ্গে পড়ে কে জানে! চীন থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে হংকং এবং হংকং থেকে মেলবোর্ন! কয়েকটি দেশ বা শহরের নাম লিখে দিলাম, কিন্তু বিমানের ইকোনমি ক্লাসে এই হাজার হাজার মাইল পথ ওড়া যে কী কঠিন তা লিখে বুঝানো অসম্ভব। তাই অবচেতনে ঘুমিয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে হলো। বিজয়’দার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গার পর বুঝতে পারলাম যে, ঘুমটি খুবই দরকার ছিল। শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছিল, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আছি ভাবতেই মনও বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো।
বিজয়’দা বললেন, লাঞ্চে যেতে হবে। নিচে সবাই অপেক্ষা করছেন।
আমরা একটি ট্যুর অপারেটর কোম্পানির মাধ্যমে মেলবোর্ন এসেছি। আমাদের থাকা খাওয়া এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় ঘোরাঘুরির দায়িত্ব তাদের। এর বাইরে কোন শপিং বা দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে হলে সেটা নিজেদের আলাদা করে ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যুফে নাস্তার আয়োজন হোটেলেই থাকে। লাঞ্চ কিংবা ডিনারের আয়োজন সচরাচর বাইরে করা হয়। কোন বাংলাদেশী হোটেল পাওয়া গেলে সেখানে, নাহয় ইন্ডিয়ান কিংবা পাকিস্তানী হোটেলে। বিদেশে দেশীয় খাবার যে কী অমৃত লাগে!
ট্যুর অপারেটর সচরাচর কোন একটি হোটেলে পুরো গ্রুপের খাবারের আয়োজন করেন। এতে কিছু টাকা পয়সা হয়তো সাশ্রয় হয়। একই সাথে অনেক কাস্টমার পাওয়ায় রেস্টুরেন্টের মালিক হয়তো কিছু ছাড়টাড় দেন। সবকিছুতে ব্যবসা করার এক দুর্দান্ত বুদ্ধি থাকে ট্যুর অপারেটরদের। আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ট্যুর অপারেটরও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। তিনিও গ্রুপে গ্রুপে সবকিছু এমনভাবে ম্যানেজ করছেন যে, আমার মনে হচ্ছিলো যে ব্যবসাপাতি ঠিকঠাকভাবে এগুচ্ছে।
দ্রুত তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলাম। ডালিয়া ভাবীকে নিয়ে নেমে আসলেন লায়ন ফজলে করিম ভাই। আমরা চারজন একপাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, একটু পরপরই ট্রাম যাচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় ট্রাম পুরোপুরি ফ্রি, টিকেট লাগে না। তবে কিছু কিছু এলাকায় টিকেট লাগে। আমাদের হোটেলের সামনেই ট্রাম স্টেশন, দুচার মিনিট পরপরই ট্রাম আসছে, যাচ্ছে। কোন কোনটিতে যাত্রী অনেক, কোনটি ফাঁকা। ফাঁকা দেখে একটিতে চড়ে বসবো কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু করিম ভাই বললেন, উল্টাপাল্টা কিছু করিয়েন না। খাবার মিস হয়ে যাবে। ট্যুর অপারেটরের সাথে না গেলে লাঞ্চ মিস। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
একটি শহরকে কিভাবে এতো পরিষ্কার রাখা সম্ভব কে জানে! প্রচুর গাছ, কিন্তু রাস্তায় গাছের পাতা নেই। দিনে কতবার ঝাড় দেয় কে জানে! পঞ্চাশ লাখের মতো মানুষের বসবাস মেলবোর্নে। কিন্তু রাস্তায় তেমন কোন মানুষজন নেই। ফাঁকা ফাঁকা। চারদিকে সুনশান, মনে হচ্ছিলো শান্তিরা সব ওড়াওড়ি করছে।
আমাদের গ্রুপে ২৫ জনের মতো নারী পুরুষ। আমরা চারজন চট্টগ্রামের, বাকিরা ঢাকার। সবাই খাবারের জন্য নিচে নেমে এসেছেন। আমাদের ট্যুর অপারেটরও এসে গেছেন। এসে গেছে বাসও। আমাদেরকে খুবই তাড়া দেয়া হলো বাসে চড়ার জন্য। এখানে হোটেলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে যাত্রী বোঝাই করার কোন সুযোগ নেই। যদিও রাস্তাঘাট ফাঁকা, তবুও। আমরা দ্রুত বাসে চড়ে বসলাম। যদি আমরা এক দুইজন বা চারজনও হতাম, তাহলে ট্রামে চড়ার সুযোগ নিতাম। কিন্তু ২৫ জনকে ট্রামে চড়িয়ে একটি রেস্তোরায় নিয়ে যাওয়া কঠিন।
আমাদের বাস চলছে। শহরের বুক ছিঁড়ে ছুটছে বাস। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! সবগুলো রাস্তার নামই ব্রিটিশ, এলাকার নাম। ভিক্টোরিয়া, কলীনস স্ট্রিট, হারবার এসপ্ল্যানেড, ডকল্যান্ড, স্মিথস্ট্রিট। ব্রিটিশ শাসকেরা অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে গেলেও তাদের নামগুলো এরা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। ব্রিটেনের রাণীকে এখনো অস্ট্রেলিয়ার জনগন দারুণভাবে সম্মান করে, নিজেদের রাণী মনে করে। এখনকার রাজাকেও মনে করে নিজেদের রাজা। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার মানুষের অন্যরকম আবেগ কাজ করতো। এখনকার রাজা তৃতীয় চার্লস কিংবা রাজ পরিবারের অপরাপর সদস্যদের প্রচন্ড ভালোবাসে অস্ট্রেলিয়ার সিংহভাগ মানুষ। তাই ব্রিটিশেরা চলে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া নামগুলো বেশ যত্ন করে আগলে রেখেছে অস্ট্রেলিয়ার মানুষ। আমি লন্ডনে বিভিন্ন সড়ক কিংবা এলাকায় যেসব নাম দেখেছি, মেলবোর্নেও সেসব নাম দেখে মজা লাগছিল।
আমাদের বাস চলছিল। নান্দনিক রাস্তাঘাট, চোখ জুড়ানো স্থাপত্য আর অনেকগুলো পার্ক পার হলাম। আসলে পুরো শহরটিই তো পার্কের মতো। আমাদের বাস একটি ভবনের সামনে দাঁড়ালো। আমাদেরকে দ্রুত নেমে আসতে বলা হলো। আগেই বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানি রেস্তোরাঁয় আমাদের দুপুরের খাবার খাওয়ানো হবে। আমার অস্ট্রেলিয়ান খাবার খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। পরবর্তীতে কোন বেলায় নিজেদের মতো করে অস্ট্রেলিয়ান খাবার খেয়ে নেবো বলেও করিম ভাইকে জানালাম। তিনি রাজী হলেন।
আমাদেরকে লাহোরী দস্তরখানা নামের একটি রেস্তোরায় নিয়ে আসা হয়েছে। দরজা খুলতেই খাবারের ঘ্রাণ এসে মগজে ধাক্কা দিল। মসলার গন্ধ, গ্রিলের পোড়া ধোঁয়া আর তন্দুরি রুটির সুবাস। মনে হলো আমাদের স্টেডিয়াম পাড়া কিংবা পুরান ঢাকার কোন রেস্তোরায় পৌঁছে গেছি। ভেতরে গিয়ে দেখি, জায়গাটা খুব বড় নয়, তবে বেশ গোছানো। দেয়ালে ঝুলছে লাহোরের বাদশাহী মসজিদের ছবি, সঙ্গে ক্যালিগ্রাফিতে কিছু আয়াত। কাঠের টেবিল আর ধাতব চেয়ার, আলাদা কিছু নয়, কিন্তু পরিবেশটা মনে হচ্ছিলো একেবারে পরিচিত। আমাদের জন্য টেবিল আগে থেকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদেরকে টেবিল দেখিয়ে দেয়া হলো।
আমি খুবই আশ্চর্য হলাম যে, এক বাংলাদেশী তরুণী আমাদেরকে টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গেল। আমাদের খাবারের অর্ডারও আগে থেকে দেয়া ছিল। নির্দিষ্ট আইটেম, রুটি, বিরিয়ানী, তান্দুরী চিকেন এবং খাশির পায়া। তবে কেউ ইচ্ছে করলে খাশির পায়ার পরিবর্তে বিফ নিহারি নিতে পারেন। রুটির পরিবর্তে নানের পরিবর্তে রুমালি রুটি কিংবা লাচ্ছা পরোটা নেয়ারও সুযোগ রাখা হয়েছে। সাথে সালাদ। অনেক মানুষ একসাথে খেতে বসলে সুবিধা হচ্ছে মিলেমিশে খাওয়া যায়, রকমারি আইটেম ইচ্ছে মতো শেয়ার করে নেয়া যায়।
দুইজন তরুণ–তরুণী আমাদের খাবার সার্ভ করছিলেন। পানির বোতল এগিয়ে দিচ্ছিলেন। সালাদের সাথে কিছু বাড়তি পেঁয়াজ এবং কাঁচামরিচ দেয়ার জন্য আমি তরুণীকে ডাকলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তরুণীর বাড়ি ঢাকায়, তিনমাস আগে মেলবোর্নে এসেছেন। এখানে পিএইচডি করছেন। সপ্তাহে বিশ ঘন্টা কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পরিচিত একজনের সাহায্যে এখানে কাজ পেয়েছেন। ঘন্টা হিসেবে বেতন, বেশ ভালো বলেও তরুণী সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
আমাদের টেবিলটি জানালার পাশে। বাইরে ঝলমল করছে দুপুর, মেলবোর্ন শহরের এই অঞ্চলটিকে বেশ প্রানবন্ত মনে হলো। ছিমছাম রাস্তা ধরে ছুটছে ট্রাম, রাস্তায় মানুষের আনাগোনা, অনেকেই পর্যটক। তারা কেউ কেউ ছবি তুলছে, কেউবা মোবাইলে কথা বলছে। কেউবা ছুটছে নিজের গন্তব্যে। জানালার ওপারে চমৎকার ফুটপাথ। একই সাইজের গাছের সারি। মাঝে মাঝে বসার বেঞ্চ আর ফুলের টব। টুলে বসে অলস সময় কাটানো মানুষ দেখা গেলো না। সবাই ব্যস্ত, কারো হাতে সময় আছে বলে মনে হচ্ছিলো না। অবশ্য, এই ভরদুপুরে কেউ গাছের ছায়ায় বসে থাকার কথাও নয়। সন্ধ্যা বা বিকেল হয়তো কেউ কেউ বসেন। তাছাড়া শহরটিতে এতো বেশি পার্ক আছে বলে জানলাম যে, ফুটপাতে গাছের ছায়ায় বসার দরকার কি, ইচ্ছে করলেই তো ধারে কাছে কোন পার্কে গিয়ে বসা যাচ্ছে যখন তখন।
আমাদের খাবার সার্ভ করা হয়েছে। দারুণ টেস্টি সব খাবার। প্রচুর তেল মসলা দেয়া। নান পরোটা নিহারী পায়া সবই আমরা ভাগাভাগি করে উৎসবের আমেজে খেলাম। শেষে ডেজার্ট হিসেবে নিলাম গাজরের হালুয়া। ওপর দিয়ে কাজুবাদাম আর পেস্তার কুচি ছড়ানো। মুখে দিয়েই মনে হলো, আসলেই মজা। এমন স্বাদের হালুয়া বহুদিন পরে খেলাম। সত্যি কথা বলতে কি, বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করলাম। ট্যুর অপারেটর এতোদূরে লাঞ্চ করাতে নিয়ে আসায় অনেকেই কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। এখন সবার মুখের রোশনাই দেখে মনে হচ্ছে, পেটের পূজার চেয়ে বড় কিছু নেই দুনিয়াতে। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।