দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কোলকাতার নিউমার্কেটের সন্নিকটে রেডিমেট গার্মেন্টসের দোকানটিতে কী পরিমান পোষাক যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। অবশ্য এই ধরনের বহু দোকান আমাদের চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকাতেও রয়েছে। তবে এখানে যেটি নজর কাড়লো তা হচ্ছে ডিজাইনের ভ্যারাইটি, কালেকশনের সমৃদ্ধতা। কত রঙের কত ডিজাইনের পোষাক যে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে! শার্ট, প্যান্ট, ব্লেজার, স্যুট, কোট, মুদি কোট, কটি, টাই, টি শার্ট থেকে শুরু করে ছেলেদের হরেক রকমের পোষাকের বিশাল সম্ভার। আমরা দেখছি কটি। আমরা মানে, আমি এবং আমার এডিটর স্যার, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। ‘শ্রী লেদার’ থেকে জুতা কিনে দেয়ার পর স্যার একটি কটিও কিনে দেয়ার জন্য দোকানটিতে ঢুকেছেন। কটি পছন্দ করতে গিয়ে আমরা একটির পর একটি দেখছি, গায়ে লাগাচ্ছি। আবার খুলে রাখছি। স্যার একটি পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু সেটির সাইজ হলো না। মোটা মানুষের রেডিমেট কাপড় ছোপড় পাওয়া একটু কঠিন। এখন আমরা সেই কঠিন কাজটিই করছি।
স্যার যেটি পরে চন্ডিগড়ে ঘুরছিলেন ঠিক সেই কটিই আমার জন্য চেয়েছিলেন। কিন্তু গতবছরের ওই কটি এবছর আর নেই। সেলসম্যানের ভাব দেখে মনে হলো, না থাকাটা তিনি দারুণ এনজয় করছেন। কারন গত বছরের কটি এবছর পাওয়া গেলে হয়তো তাদের আভিজাত্য নষ্ট হতো। এখন তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে, দোকানটি সবসময়ই আধুনিক, সব সময়ই টাটকা সব ডিজাইন নিয়ে থাকে। যাক, স্যার আমার জন্য অপর একটি কটি পছন্দ করলেন। সেলসম্যান আশ্বস্ত করলেন যে, সাইজ হবে। অবশেষে আমার গায়ে কটি চড়ানো হলো। শার্টের উপর কটি’টি গায়ে দিয়ে নিজেরই ভালো লাগছিল। স্যার আমাকে ঘুরিয়ে টুরিয়ে দেখলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে-এটা নাও।’
বিল পরিশোধের পর নয়া কটি আমি আর প্যাকেটে ভরতে দিলাম না। গায়ে চড়িয়েই দোকান থেকে বের হয়ে এলাম। পায়ে কচকচ করছে ‘শ্রী লেদারে’র নতুন জুতা, গায়ে চকচকে নতুন কটি। নিজেকে বেশ শানদার মনে হচ্ছিল। স্যার বললেন, চল হোটেলে ফিরে যাই। আমি মাথা নাড়লাম। হাঁটছিলাম আমরা। হেঁটেই ফিরছিলাম হোটেলে। মাত্র দুই তিন মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। হোটেল গ্র্যান্ড ওয়েবয়। স্যারের রুমেই ঢুকলাম। সেখানেই আমার স্ত্রীকে ম্যাডামের কাছে রেখেই আমরা বাইরে গিয়েছিলাম। রুমে ঢুকে দেখি লায়ন নিশাত ইমরান এবং লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনাও সেখানে এসেছেন। চারজনে মিলে দারুণ জমিয়ে তুলেছেন। আমি রুমে ঢুকতেই স্ত্রীর সন্দেহজনক চাহনি। পায়ের জুতা না দেখলেও গায়ের কটিতে ঠিকই তার চোখ আটকে গেল। তার চোখে মুখে জিজ্ঞাসা! আমিও মুখ টিপে হেসে রহস্য ছড়িয়ে দিলাম। শপিং করেছো? স্ত্রীর প্রশ্ন। একেবারে আলাভোলা টাইপের প্রশ্ন। না করলেও সমস্যা ছিল না এবং এগুলো নিয়ে তার কখনো কোন বাড়তি আগ্রহও থাকে না। সে জানে যে, আমি নিজে নিজে কোন কিছু নিজের জন্য কিনতে পারি না। সবই তো তারই কেনা। তার ধারণা দুনিয়ার সব দোকানিই আমাকে ঠকায়। আমি কিছু কেনা মানেই ঠকে আসা। কিংবা দোকানের বাসি, মেয়াদোর্ত্তীণ কিংবা পচা জিনিসটিই নিয়ে আসা। এতে করে আমি পারতপক্ষে (সত্য কথা বললে, সংসারের শান্তির জন্য) শপিং এর ধারেকাছে যাইনা।
এখন গায়ে চকচকে নতুন কটি দেখে প্রিয়তমা স্ত্রী স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তার শংকা- আমি শপিং করে ঠকে এসেছি কিনা! স্ত্রীকে বললাম , ‘স্যার জুতা এবং কটি কিনে দিয়েছেন।’ সাথে সাথে এও বললাম যে, ‘আমরা ঠকিনি। ফিঙড প্রাইজের দোকান। ঠকাঠকির সুযোগ নেই। গতবছরের কটি পাওয়া যায়নি, এটি এই বছরেরই। তাই ডেট ফেলের প্রশ্নই আসেনা। স্যারই পছন্দ করে কিনেছেন।’ আমার স্ত্রী আর কথা বাড়ালো না। স্যারের সাথে যখনি বিদেশ যাই তখনি স্যার যে আমাকে কিছু না কিছু কিনে দেন সেটি আমার পরিবারের সবারই জানা। এতে কেউ আর এখন আশ্চর্য হয়না।
আমার ম্যাডাম কামরুন মালেক বেশ খুশী হলেন। কটি অনেক সুন্দর হয়েছে বলেও মন্তব্য করলেন। ম্যাডাম ইতোমধ্যে আমার বউকে শাড়ি টাড়ি কিনে দিয়ে একাকার করে ছেড়েছেন। দিল্লীতে ম্যাডাম নিজেদের জন্য শপিং করতে গিয়ে আমার স্ত্রীর জন্যও শাড়ি কিনেছেন। চেন্নাইতেও শাড়ি কিনে দিয়েছেন। ম্যাডাম যে আমাকেও কত কিছু কিনে দেন!
স্ত্রীকে নিয়ে রুমে ফেরার জন্য দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, ‘যাও রেস্ট নাও। ডিনারের সময় বের হবো। সবাইকে ডেকে নিও। আজ বাইরে ডিনার করবো। তোমাকে একটি জিনিস দেখাবো।’ স্যার যে কত জিনিস জীবনে আমাকে দেখালেন! কোলকাতায় আবার কি দেখাবেন! আমি বেশ কৌতুহলী হলাম। নানা জল্পনা কল্পনা করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে এলাম। স্যারের রুম থেকে বের হয়েই আমি স্ত্রীর হাতটি হাতে নিলাম। যেন কতবছর পর হাতধরা! একই ফ্লোরে আমাদের রুম। জনশূণ্য লবিতে আমরা হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে রুমে ফিরলাম।
মনে কিছুটা রোমান্টিক ভাব বিরাজ করলেও স্যার যে রাতে কি দেখাবেন সেই কৌতুহল থেকে বের হতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল স্যার সুশান্ত বাবু এবং ডালিয়া বৌদিসহ কোথাও যাবেন এবং ওখানে আমাদের বিশেষ কিছু দেখাবেন। কোলকাতায় স্যারের অতি প্রিয়জন হচ্ছেন সুশান্ত বাবু দাদা এবং ডালিয়া বৌদি। ওনারাই যেন এই দূরদেশে আমার স্যার ম্যাডামের পরামাত্মীয়। স্যার এবং ম্যাডাম কোলকাতায় আসলে অধিকাংশ সময়ই ডালিয়া বৌদির বাসায় উঠেন। আবার ওনারা শুধু স্যারের বাসায় বেড়ানোর জন্য কোলকাতা থেকে চট্টগ্রামে উড়ে আসেন। আমিও একবার স্ত্রীকে নিয়ে ডালিয়া বৌদির বাসাই উঠেছিলাম। কি যে আন্তরিক মানুষগুলো! আমাদের জন্য কি যে করেছিলেন!
রাত বাড়ছিল তরতর করে। অবশ্য রাত বাড়ার ব্যাপারটি আমরা বুঝছিলাম ঘড়ির কাটার দেখে। হোটেল গ্র্যান্ড ওয়েবয়’র রুম থেকে বাইরে রাত বুঝার সাধ্য নেই। ভারী পর্দায় ঢাকা জানালা দিয়ে বাইরের রাত-দিন বুঝা যায়না।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং—-। হ্যালো না বলেই বললাম, ‘স্যার, বের হবো!’ স্যার হাসলেন। বললেন, ‘চল ডিনার করে আসি। রূপমকে ফোন করো।’ ‘রূপম’ মানে লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া। কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম মালিক। লায়ন্সের সাবেক গভর্নর। আমার স্যার ওনাকে ছোটভাই’র মতো ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। আমি ফোন করলাম। সুপ্রভা বৌদি হ্যালো বলতেই, নিচে নামতে বললাম। বৌদিকে একটু তাড়াতাড়ি নামারও তাগাদা দিলাম। দুষ্টুমি করে বললাম যে, প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। আসলে আমি নতুন কিছু দেখার জন্য ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। হোটেলের লবিতে জড়ো হলাম আমরা। কিন্তু সুশান্ত দাদা এবং ডালিয়া বৌদিকে দেখা গেল না। স্যার বললেন, ‘গাড়ির দরকার নেই। চল হেঁটে যাই। কাছেইতো।’ কাছে কিংবা দূরে সেটাতো বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার হচ্ছে কোথায় যাচ্ছি, নতুন কি দেখছি! কিন্তু রহস্যের কোন সুরাহা হলো না। স্যারের বিষয়টি মনে আছে কিনা তাও বুঝতে পারছিলাম না। তিনি আগেভাগে হাঁটতে শুরু করলেন, পেছনে আমরা। রাত বেড়েছে। ঘড়ির কাঁটা ৯টার ঘর পার হয়েছে বেশ আগে। তবে রাস্তায় মানুষের অভাব নেই। শত শত মানুষ গিজগিজ করছে। নিউমার্কেটের দিকের রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম আমরা। রাস্তার পাশে প্রচুর দোকান, শপিং মল। সবগুলোতেই আলোর ঝলকানি। চলছে দারুণ বিকিকিনি। স্যার আরো একটু সামনে গিয়ে কেএফসিতে ঢুকলেন। বললেন, ‘আজ ডিনারে কেএফসি খাবো। কারো আপত্তি আছে?’ আমি যেন কিছুটা হতাশ হলাম। ভাত না খেয়ে কেএফসিতে মুরগীর ঠ্যাঙ চিবুনোর জন্য নয়, নতুন কিছু দেখার আশা ধূলিসাৎ হওয়ায় আমার ভিতরটি কেমন যে করে উঠলো! কেএফসিতে নতুন কিছু দেখার নেই। বহুবছর ধরে কেএফসি চিনি, জানি। পৃথিবীর বহু দেশে কেএফসি খেয়ে বহু দিন এবং রাত পার করেছি। চট্টগ্রামেও গত কয়েকবছর ধরে কেএফসি জমিয়ে ব্যবসা করছে।
আমরা ভিতরে ঢুকে বসলাম। আরো বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ বিভিন্ন টেবিলে বসে খাচ্ছেন। কেউ কেউ অর্ডার করছেন। ক্যাশ কাউন্টারে বসা দুই তরুণ তরুণী অর্ডার নিচ্ছেন। টাকা গুনে নিয়ে অর্ডার স্লিপটি ঠেলে দিচ্ছেন পেছনে। সেটি চলে যাচ্ছে পাশেরই কিচেনে। তৈরি হচ্ছে খাবার। সার্ভ হচ্ছে। সেলফ সার্ভিস। আমাদের সবার জন্য বার্গার এবং চিকেন অর্ডার করা হলো। সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং কোল্ড ড্রিংঙ। আমরা চেয়ারে বসে আড্ডার জগতে চলে গেলাম। আমাদের খাবার তৈরি হলে ডিজিটাল মনিটরে নম্বর দেখা যাবে, বেলও বাজবে। কেএফসির ইউনিফর্ম পরিহিত এক যুবকের উপর আমার চোখ আটকে গেল। দারুণ স্মার্ট, সদুর্শন। কিন্তু তিনি নিজে নিজে যেন কথা বলছিলেন। হাত নেড়ে, আঙ্গুল নেড়ে, চোখের ভ্রু নাচিয়ে তিনি কার সাথে যেন শব্দহীন বিড়বিড় করছিলেন! একটু খেয়াল করে দেখলাম যে, অপরদিকেও একই ধরনের ড্রেস পরিহিত এক যুবক রয়েছেন। তারা দুজনই হাত নেড়ে চোখ নাচিয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছেন। দোকানভর্তি কাস্টমারের পাশে দাঁড়িয়ে কেএফসির কোন স্টাফ এভাবে পরস্পরের সাথে মশকরা করতে পারেন এটি আমার ভাবনাতেই ছিল না। ইন্টারন্যাশনাল একটি চেইন শপ কেএফসি। এখানে শুধু খাবারের মানই নয়, কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানও কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। যাকে তাকে এখানে নিয়োগ দেয়া হয় না। কোম্পানির হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্র্যান্ড ইমেজ নষ্ট হয় এমন কোন আচরণ এখানে কেউ করবেন না। কিন্তু এরা কী করছেন! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ