(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের কুনমিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে জিউশিয়াং গুহার ভিতরে হাঁটছি। মাথার উপর পাহাড় বলে একটি কথা শুনি, কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, বিশাল পাহাড়টি সত্যিই আমাদের মাথার উপর। গাড়ি পার্কিং করতে গিয়ে সবুজে সবুজে ঢেকে থাকা যে পাহাড়টি দেখেছিলাম এখন আমরা সেই পাহাড়ের গর্তে ঢুকে দিব্যি হাঁটাহাঁটি করছি, দেখছি নানাকিছু। একটি পাহাড়ের ভিতরে যে এতো এত্তো বিস্ময় লুকিয়ে থাকে তা আগে কোনোদিন বুঝিনি। আমি নিজেই পাহাড়সমৃদ্ধ এলাকার সন্তান। চট্টগ্রামের বিখ্যাত পাহাড়টিই আমার এলাকায়। হামাগুড়ি দেয়ার বয়স থেকেই ঘরের দাওয়ায় বসে পাহাড়ের হাতছানি দেখতাম। ছোটবেলা, বালক বেলা কিংবা দুরন্ত যৌবনে পাহাড়ের সাথে ছিল দারুণ সখ্যতা। সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ছায়ায় মায়ায় আমাদের কত অলস বিকেল, মায়াবী সন্ধ্যা বা ভর চাঁদনী রাত যে কেটেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ঘোর বর্ষায় কিংবা তপ্ত রোদে পাহাড়ের কত স্মৃতি যে অক্ষয় হয়ে রয়েছে তার কোন হিসেব নেই। পুরানো সব স্মৃতি হাতড়ে আজো চমকিত হই। কিন্তু কোনদিনই ভাবি নি যে, সেই পাহাড়ের পেটের ভিতরে এতো ঘোরলাগা বিস্ময় থাকে। এটিতে গুহা থাকায় দেখতে পারছি, চন্দ্রনাথে হয়তো গুহা নেই, কিংবা আমরা খুঁজে পাইনি। তাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পেটের ভিতরে কী পরিমান বিস্ময় রয়েছে তা অজানা থেকে গেছে।
চীনের জিউশিয়াং ক্যাভ নামের এই অঞ্চলটিতে অন্তত একশ’টি গুহা রয়েছে। সবগুলো গুহা নিয়ে রয়েছে একটি গুহার নেটওয়ার্ক। পুরো এলাকাটি ‘কাস্ট গুহার জাদুঘর’ নামেও পরিচিত। এটি শুধু ইউয়ান প্রদেশেরই নয়, বিশাল চীনের বৃহত্তম গুহাগুচ্ছ হিসেবেও স্বীকৃত। হাজার বছর ধরে সৃষ্ট এই গুহা আবিষ্কার হয়েছে বছর কয়েক আগে। সেই তখন থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি বিদেশী পর্যটক এই গুহা দর্শনে আসে। গুহার ভিতরে পর্যটকদের কোনরকমে হাঁটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলো–আঁধারীর খেলায় তৈরি করা হয়েছে মায়াবী এক পরিবেশ। চীনের প্রকৌশলীরা নানাভাবে গুহার ভিতরে কাজ করলেও গুহার আদিমতাকে নষ্ট করেন নি। গুহার ভিতরকার প্রাকৃতিক আবহ যাতে অক্ষত থাকে সেই চেষ্টাও করা হয়েছে।
গুহার ভেতরে বিভিন্ন আকৃতির বিপুল সংখ্যক স্ট্যালাকটাইট (ঝুলন্ত চুনাপাথরের স্তম্ভ) এবং স্ট্যালাগমাইট (নিচ থেকে ওঠা পাথরের স্তম্ভ) রয়েছে। যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য উপাদান হয়ে রয়েছে। এছাড়াও, এখানে নদী, জলপ্রপাত এবং প্রাকৃতিক পাথরের সেতু মিলে গুহার ভিতরকার প্রতিটি ধাপই দর্শকদের মুগ্ধ করে, করে রোমাঞ্চিত।
গুহার ভেতরে নানা স্থানে প্রয়োজনমতো রঙিন আলো দেয়া হয়েছে। যা গুহার প্রাকৃতিক গঠনগুলোকে আরও রহস্যময় ও রূপকথার গল্পের আদল দিয়েছে। নীল, সবুজ, লাল আলোয় কখনো গুহাটি মনে হয় কোনও যাদুর রাজ্য, কখনো বা মনে হয় স্বপ্নপুরী। গুহার কিছু অংশ এতটাই নিঃসাড় আর নিঃস্তব্ধ যে, সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় সময় যেন থেমে গেছে। দেয়াল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়া পানির শব্দ, আলোর–ছায়া, আর ভূগর্ভস্থ বাতাসের ছোঁয়া মিলে এক ধরণের অলৌকিকতার সৃষ্টি হয়েছে।
সুউচ্চ একটি পাহাড়ের তলদেশের এই গুহাগুলোর ভিতর যে পরিমাণ বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে তার সবটুকু একদিনে দেখা সম্ভব নয়। আমার মনে হলো অন্তত দুইদিন সকাল থেকে রাত অব্দি ঘুরতে পারলে গুহা দর্শন সুসম্পন্ন হতো। তবে গুহার ভিতরে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই। বাইরে নিশ্চয় থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যাদের অফুরন্ত সময় আছে তারা হয়তো দুই তিনদিনের জন্যই প্রকৃতির এই বিস্ময় দেখতে ছুটে আসে।
আমরা অবস্থান করছিলাম গুহার ভিতরের লায়ন হলে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মিত কোন হল নয়, পাহাড়ের তলায় বিস্তৃত একটি চত্বর। মাথার উপর পাহাড়ের তলদেশ, ছাদ। কোন খুঁটি নেই। কয়েক কাঠা জায়গা জুড়ে দারুণ একটি হলের মতো হয়ে রয়েছে। এই হলটিতে একই সাথে অন্তত দশ হাজার মানুষ দাঁড়াতে পারবে। একপাশে মঞ্চের মতোও রয়েছে। সেখানে রয়েছে একটি ক্যাফেও। দারুণ ক্যাফে। যার পরিবেশে মিশে আছে প্রাকৃতিক নিস্তব্ধতা, গুহার স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের গন্ধ, আর গহিনের কল্পনাপ্রবণ সৌন্দর্য। কফির গন্ধ চারদিক ভুরভুর করছিল। নেশা পেয়ে বসলো আমাকে। চীনা তরুণীকে কফির অর্ডার করলাম। চড়া দাম, তবে পাহাড়ের এতো গভীরে বসে এতো আয়েশ করে কোন রাজা বাদশা কি কোনদিন কফি খেতে পেরেছেন! লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবীও কফি নিলেন। টুল এবং টেবিল পাতা রয়েছে। আমরা সেখানে বসে চুক চুক করে কফি খেলাম। হলের দেয়াল জুড়ে যেনো নানা শিল্পকর্ম। একপাশে পাথর ভাঙ্গার কিছু মূর্তির মতোও রয়েছে। এগুলো কখনো কোন মানুষ তৈরি করেছে কিনা কে জানে! বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও মনে হয় পাথরে পাথর ঘষে কিছু লেখালেখি করে গেছে। হয়তো নিজের নাম, হয়তো প্রিয়তমার। কৃত্রিম–অকৃত্রিম মিলে পাথরের ভাঁজে ভাঁজে সাতরাজ্যের রূপ যেনো আশ্রয় নিয়েছে। ক্যাফের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু শিল্পকর্ম। কেউ কেউ ছবি তুলছেন, কেউ চা হাতে বসে ভাবছেন। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন প্রকৃতির গভীরে ডুবে থাকা এক গোপন শহরে এসে পৌঁছেছি।
বিল আমাদেরকে একটি বিশেষ জায়গা দেখাতে নিয়ে চললো। এটি নাকি গুহার জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট, টেরিফাইং গর্জ। খেয়াল করে বুঝলাম যে, এটি একটি ক্যানিয়ন বা গিরিখাত। প্রায় ৭০০ মিটার দীর্ঘ এবং ১০০ মিটার গভীর এই গিরিখাতটি চীনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ভূগর্ভস্থ ক্যানিয়নগুলোর একটি বলেও জানতে পারলাম। ক্যানিয়ন আমি আগেও দেখেছি। সৃষ্টির এক অপার বিস্ময় এই ক্যানিয়ন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যানিয়ন এবং অন্যতম বিস্ময় হিসেবে স্বীকৃত আমেরিকার নাভেডার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। বছর কয়েক আগে দেখা ওই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন আজো আমাকে পুলকিত করে, বিস্মিত করে। আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন উন্মুক্ত। পাহাড়ি জনপদে উপর দিকে অতল ক্যানিয়ন দেখা যায়। ওটির ভিতরে হেলিকপ্টার নিয়ে ঘোরা যায়। ক্যানিয়নের উপরে কাঁচ দিয়ে এমনভাবে পথ তৈরি করে দেয়া আছে যে তাতে হাঁটতে গেলে বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যা। চীনের গুহার ভিতরকার এই ক্যানিয়ন আমেরিকার ক্যানিয়নের মতো না হলেও পাহাড়ের পেটের ভিতরে এমন একটি গিরিখাত আমার চোখে ঘোর লাগচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো এটি বুঝি একেবারে পাতালপুরি পর্যন্ত বিস্তৃত। পাতালে যাওয়ার পথ নয়তো!
ঘোর লাগা চোখে গুহার ভিতরে হাঁটছিলাম। অপার বিস্ময়ে আচ্ছন্ন আমার মন। কিন্তু গুহার নিস্তুব্ধতার মাঝে দূর থেকে পানি পড়ার দারুণ একটি ছন্দ শুনছিলাম। টানা শব্দ, কোন ছন্দপতন হচ্ছিলো না। কোন উঁচু জায়গা থেকে বিপুল পরিমাণ পানি ক্রমাগত পড়তে থাকলে যেভাবে শব্দ হয় ঠিক সেই শব্দটিই ভেসে আসছিল। কিসের শব্দ বুঝতে পারছিলাম না। গুহার ভিতরে এতো পানি কোত্থেকে আসবে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে সেই শব্দের উৎস্যের কাছে দাঁড়িয়ে আমার শরীর মনে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। পাহাড়ের পেটের ভিতরে ঝর্ণা! গুহার ভিতরেই টুইন ওয়াটারফলস। পাহাড়ের বুক চিরে বের হওয়া ঝর্ণা দুটি থেকে প্রায় ১০০ ফুট নিচে বিশাল ধারায় ক্রমাগত পানি পড়ছিল। আর তৈরি করছিল এক কলকল শব্দ। সৃষ্টি করছিল এক মোহনীয় আবহ। ঝর্ণা দুইটি থেকে পৃথক দুইটি ধারায় পানি পড়লেও একটু সামনে গিয়ে একই ধারায় মিলিত হয়ে সামনে যাচ্ছে। পানির যে কী বেগ! তীব্র বেগে ছুটছে সামনে। শুধু আমরাই নাই, আরো অনেক পর্যটক মুগ্ধ হয়ে সেই পানি পড়া এবং কলকল করে মিলিত স্রোতে সামনে যাওয়ার অপূর্ব দৃশ্য দেখছিলেন।
পানির গতিপথ খুঁজতে গিয়ে একটি পাথরের সাঁকো পেলাম। চারদিকে এতো এত্তো পাথরের ভিড়ে পাথরের সাঁকো! বেশ মানানসই হলেও ব্যাপারটি দারুণ লাগছিল। সাঁকোর নিচ দিয়ে তীব্র বেগে ছুটছে দুইটি ঝর্ণা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ পানি। সাঁকোর নিচ থেকে আবারো একটি গভীর খাদে গিয়ে পড়ছে। ওখান থেকে আবারো ছুটছে সামনে।
বিল জানালো যে, এটি একটি নদীর জন্মস্থান। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছে একটি নদী। যা পাহাড় থেকে বের হয়ে বিভিন্ন জনপদের উপর দিয়ে আরো কয়েকটি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই পানির শেষ গন্তব্য দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের গুয়াংজু হয়ে চীন সাগর বলেও জানালো বিল। এই পানি গুয়াংজু যাচ্ছে! নিজে নিজেই চমকে উঠলাম।
বিল যেনো খুশিতে টগবগ করছে। আমার কাছে জানতে চাচ্ছিলো কেমন লাগছে, দারুণ না জায়গাটা। বিলের দিকে তাকালাম। আমার চোখে ছিল কৃতজ্ঞতার ছায়া। বিল হদিশ না দিলে এমন একটি জায়গায় আসা আমার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব ছিল না। বিল আমাদের এমন এক জায়গায় এনেছে, যেখানে প্রকৃতি নিজের ভেতরটুকু অকাতরে খুলে দিয়েছে।
নদীর জন্মস্থান দেখার স্থানটি অনেকটা ওয়াচ পয়েন্টের মতো। অনেক লোকেরই একসাথে দাঁড়িয়ে পানি গড়ানোর দৃশ্য দেখার সুযোগ রয়েছে। আমি সেখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটি নদীর জন্ম আমার চোখের সামনে! কী অপার বিস্ময়! এই মুহূর্তে আমি যেন প্রকৃতির সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে উঠলাম। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত শরীরটায় যেন নতুন করে সঞ্জীবনী শক্তি ঢুকে গেল। এই দেখা, এই উপলব্ধি আমার এক জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দৃশ্য হয়ে থাকবে বলেও মনে হচ্ছিলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।